হাসপাতালে চিকিত্সা-সাগ্রহী পাঠানো, হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকা মানুষদেরকে খাবার সরবরাহ করা, পাবলিক জায়গায় মানুষের তাপমাত্রা মাপা এবং জীবাণুমুক্ত করার মতো নানা ক্ষেত্রে রোবট ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে এবার। এমন চাহিদা অস্থায়ী বা রোবট শিল্পের জন্য একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
মানুষের বদলে রোবট কাজ করায় মহামারিতে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি হ্রাস পায়। বিশেষ করে মহামারির সময়ে জীবাণুমুক্ত করার কাজে নিয়োজিত রোবট খুবই জনপ্রিয়তা পায়। উ হান ও শাং হাইসহ নানা শহরের হাসপাতালে রোবট জীবাণুমুক্ত করার কাজ করেছে। রোবট বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় রেখে সক্রিয়ভাবে জীবাণুমুক্ত করতে পারে। ঐতিহ্যিক বায়ু নির্বীজন এবং অতিবেগুনী নির্বীজন যন্ত্রের তুলনায় রোবটের কাজ আরও উন্নত। রোবট যেখানে রোগী এবং চিকিত্সকরা বেশি যায় সেখানে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে জীবাণুমুক্ত করার কাজ করতে পারে।
হ্য ফেই-এর একটি কোম্পানির নতুন তৈরি রোবট সক্রিয়ভাবে মানুষের তাপমাত্রা মাপতে পারে। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা জানান, এ রোবট এখন চীনের উহান, সিআন ও হ্য ফেইসহ নানা শহরে ব্যবহৃত হচ্ছে।
নানা জায়গায় রোবট রোগীদেরকে ওষুধ ও খাবার সরবরাহ করেছে। তারা মানুষের মতো দরজা খুলতে পারে, বন্ধ করতে পারে, এমনকি লিফট ব্যবহার করতে পারে!। মেডিকেল স্টাফরা বিভিন্ন ওষুধ রোবটের ভিতরে রাখেন এবং রোগীর রুম ও বিছানার নম্বর রোবটে ইনপুট দেন। তারপর রোবট এ ওষুধ রোগীর কাছে পৌঁছে দেয়। এভাবে মেডিকেল স্টাফদের ভাইরাসে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা কমে। তা ছাড়া, কোন কোন রোবট প্রচারণার কাজ করে। তারা ২৪ ঘন্টার মতো হাসপাতালের হল ও পাবলিক সেবা এলাকায় মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের তথ্য জানাতে আসা-যাওয়া করে।
সংবেদনশীল পরিবেশ ছাড়া, রোবট নানা শহরে মহামারি মোকাবিলায় আরও বেশি সেবা দিয়েছে ও দিচ্ছে। সু চৌ শহরে, ক্রলার স্প্রে রোবট এক ঘন্টায় ৪০ হাজার বর্গমিটার আয়তনের বড় একটি জায়গা জীবাণুমুক্ত করতে পারে। শাংহাই শহরে, চালকনহীন নির্বীজন গাড়ি প্রতিদিন নিয়মিতভাবে রাস্তা জীবাণুমুক্ত করে এবং পাশাপাশি মাস্ক না-পরা লোকদের সতর্ক করে দেয়।
কমিউনিটতে সকল বাসিন্দার তথ্য সংগ্রহ বড় এবং জটিল একটি কাজ, তবে রোবটের সাহায্যে তা সহজ হয়ে যায়। টেলিফোন-রোবট এক মিনিটের মধ্যে ৯০০টি ফোন করতে পারে এবং সব বাসিন্দার তথ্য জানাতে এবং তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। চীনের ৩০টি প্রদেশের ৩ কোটি ৭০ লাখের বেশী মানুষকে ফোন করেছে ফোন-রোবট।
লজিস্টিক খাতে মানবহীন কর্মকান্ড দীর্ঘ সময় ধরে খুব আলোচ্য একটি বিষয়। মহামারির কারণে এ ধরনের কর্মকাণ্ড দ্রুত বাস্তবায়ন হয়। চিং তুং ও মেই থুয়ান নিজ নিজ মানবহীন লজিস্টিক গাড়ি বের করে। উহান শহরে কোভিড-১৯ হাসপাতালে চিকিত্সা-সামগ্রী পরিবহনের ৭০ শতাংশ চিংতুং মানবহীন লজিস্টিক গাড়ির মাধ্যমে করা হয়। অন্যদিকে, মেই থুয়ান অ্যাপ্লিকেশনে অর্ডার দিলে মেই থুয়ানের মানবহীন গাড়ি বাজার থেকে শাকসবজি কিনে কমিউনিটিতে পৌঁছে দেয়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মানুষে-মানুষে কোনো যোগাযোগ নেই! মেই থুয়ান কোম্পানি মানবহীন ডেলিভারিকেন্দ্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তি জানান, গেল দু'মাসে মানবহীন লজিস্টিক গাড়ির কাজ আগের চেয়ে বেড়েছে। এখন প্রায় ৩০টি গাড়ি কাজ করছে।
মহামারি চলাকালে, রোবট দ্রুত কাজ শুরু করতে পেরেছে। তার মূল কারণ হচ্ছে এ বিষয়ের প্রযুক্তিগত ভিত্তি গভীর। পাশাপাশি মহামরি এমন সুযোগ তৈরি করে যে, এ রোবট-পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হয়। চীনা রোবট শিল্প উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০১৯ অনুযায়ী, রোবটের বৈশ্বিক বাজার ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে পরিষেবা রোবট তাদের স্বর্ণ সময়ে প্রবেশ করবে। ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী রোবট বাজারের পরিমাণ ছিল ২৯৪০ কোটি ডলারের বেশি। এর মধ্যে পরিষেবা রোবট খাতের পরিমাণ ৯৪৬ কোটি ডলার। চীনা পরিষেবা রোবটের বাজার হবে ২২০ কোটি ডলার এবং তার অনুপাত ২৩ শতাংশ।
ডেলিভারি-রোবটের জন্য অটোপাইলট প্রযুক্তি প্রয়োজন এবং টেলিফোন রোবটের জন্য Intelligent speech recognition প্রযুক্তি প্রয়োজন। এ দুটি প্রযুক্তি গেল বছরগুলোতে বেশ অগ্রগতি অর্জন করে। মহামারি হবার পর পু থু নামের একটি কোম্পানি দেশের ১০০টি হাসপাতালের জন্য স্মার্ট ডেলিভারি-রোবট উপহার দেয়। এর আগে তারা নিম্নগতির অটোপাইলট বিষয় নিয়ে বেশ গবেষণা করে। বিশেষ করে তাদের রোবট আগে রেস্টুরেন্টে ব্যবহার করা হয়। তাই তারা দ্রুত এর ভিত্তিতে হাসপাতালের জন্য বিশেষ রোবট তৈরি করতে পারে।
এর আগে, বেশ কয়েকটি কোম্পানিও মানবহীন ডেলিভারি প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করে। তবে তাদের গবেষণার ফলাফল শুধু পরীক্ষার পর্যায়ে থাকে। অন্য ক্ষেত্রেও রোবট বড় ভূমিকা পালন করে। শিশুশিক্ষা ও Accompanying robot-এর উদাহরণ দিয়ে বলি, স্কুল বন্ধ হবার পর শিশুরা মূলত বাসায় শিক্ষা গ্রহণ করছে। তখন এমন রোবটের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। মহামারি দেখা দেওয়ার পর শিক্ষা বিষয়ক অ্যাপ্লিকেশনের চাহিদা ২২৬ শতাংশ বেড়েছে।
চীনা শিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত 'নতুন প্রজন্মের কৃত্রিম বুদ্ধি শিল্প উন্নয়নের তিন বছরের পরিকল্পনা' অনুযায়ী, ২০২০ সালে, চীনে বাস্তবায়িত হবে পরিবার পরিষেবা রোবট; স্মার্ট গণ সেবা রোবটের উত্পাদন ও ব্যবহারও বাড়বে।
মহামারির সময়ে রোবটের ভূমিকা বাজারের স্বীকৃতি পায়। মানুষ রোবটের সঙ্গে আরও পরিচিত হয় এবং গ্রহণ করতে শেখে এ নতুন প্রযুক্তি। পাশাপাশি বাজারে চাহিদা বাড়ছে। যেমন, এখন যদিও কলকারাখানায় উত্পাদনকাজ শুরু হয়েছে এবং বিভিন্ন অফিস-আদালত খুলছে, তবে মানুষে মানুষে যোগাযোগ কমাতে রোবটের ব্যবহার হচ্ছে।
কেউ কেউ মনে করে, দীর্ঘসময়ে রেস্টুরেন্ট শিল্পের দুটি বড় সমস্যা হল মানুষ নিয়োগ ও উত্পাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ। রোবট তাদের জন্য নতুন একটি বাছাই। প্রযুক্তি উন্নয়নের সাথে সাথে উত্পাদন ব্যয় কম হবে এবং মানুষের বদলে নানা কাজ করতে পারবে রোবট।
এখন চীনে অনেক চেন রেস্টুরেন্ট রোবট ব্যবহার শুরু করেছে এবং তারাও বলছে যে, মহামারি শেষ হবার পর তারা আরও বেশি রোবট 'নিয়োগ' করবে।
এআই, ৫জি ও বিগ ডাটাসহ নানা প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে পরিষেবা রোবট বাজারের রয়েছে বিশাল সুপ্ত শক্তি ও উন্নয়নের অবকাশ। মহামারি শেষ হবার পর এ শিল্প দ্রুত উন্নয়নের একটি সময়ে প্রবেশ করবে। আনুমানিক হিসেব অনুযায়ী, চীনে পরিষেবা রোবটের বাজার হবে ৪০০ কোটি ডলারের।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বুদ্ধিমান ভয়েস, চিত্রের স্বীকৃতিসহ নানা প্রযুক্তির গবেষণা আরও দ্রুততর করা উচিত। ছিংহুা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগ ডেটা সিস্টেম সফটওয়্যার ন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাবরেটরি চিফ ইঞ্জিনিয়ার ওয়াং ছেন বলেন, আকজকাল যান্ত্রিক এবং পুনরাবৃত্তির কাজ রোবট দক্ষতার সঙ্গে করছে। ভবিষ্যতে রোবটের বুদ্ধিমান উন্নয়ন হবে এবং আরও বেশি খাতে তারা কাজ করতে পারবে। (শিশির/আলিম/রুবি)