১৭ মার্চ পর্যন্ত চীনের নানচিং শহরে নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমণের সংখ্যা টানা ২৮ দিন ধরে শূন্য। শহরটি কীভাবে এই সাফল্য অর্জন করেছে? বলা যায়, এ শহরের প্রত্যেকই এক মুহূর্তের জন্য বিষয়টি হালকা করে দেখেন নি। তাদের আচরণ অনেক বিদেশির চোখে বেশ নতুন ও বুদ্ধিদীপ্ত।
সুপারমার্কেটে যাওয়া বা বাসে ওঠা, যাই হোক-না-কেন, সবার আগে শারীরিক তাপমাত্রা চেক করতে হবে। লিফটের বোতাম পুশ করার জন্য বিশেষভাবে রাখা টিস্যুও ব্যবহার করতে হবে। হাতের সঙ্গে বোতামের স্পর্শ এড়াতে টিস্যু দিয়ে বোতাম পুশ করা যায়। মানুষের সেলফোনে মহামারী সংক্রান্ত ম্যাপ আছে। ম্যাপে মহামারীর চিহ্নিত স্থানগুলো এড়িয়ে যেতে বলা হয়েছে।
রেস্টুরেন্টে খাওয়ার জন্য প্রথমে রেজিস্টার করতে হবে। নিজের নাম, আইডি নম্বর এবং ফোন নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য লিখতে হবে। খাবারের জন্য পে করতে চাইলে নগদ নয়, নিজের সেলফোনে পে করা যায়। রেস্টুরেন্টে কর্মরত লোকেরা প্রতি ঘণ্টায় নিজের শারীরিক তাপমাত্রা মাপতে পারেন এবং তারা প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরে কাজ করেন।
জনগণের জীবনযাপনসহ বিভিন্ন দিক স্বাভাবিক হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নানা প্রতিষেধক ব্যবস্থাও ভালোভাবে নিশ্চিত করা হয়। টানা ২৮ দিন ধরে নতুন করে সংক্রমণ দেখা না দেওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট বিচ্ছিন্নতা ব্যবস্থা শিথিল করা হয়নি।
তথ্যচিত্রে আমরা দেখতে পাই যে, পরিচালক হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে থাকা একজন সহকর্মীকে দ্রব্য পাঠাতে চান। দরজার সামনে নিরাপত্তারক্ষী তাকে থামিয়ে দেন। সহকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে নিরাপত্তারক্ষী। তারপর দ্রব্য হাতে নেওয়ার পর নিরাপত্তারক্ষী তা লিফটে রাখেন। তিনি বলেন, আপনার সহকর্মী নিজেই এসব দ্রব্য নিয়ে যাবেন। যাত্রীবাহী লিফট থেকে তা মালবাহী লিফটে রূপান্তরিত হয়েছে।
এসব ঘটনা দেখতে বেশ সহজ মনে হয়। আসলে বাস্তবায়ন করা তেমন সহজ নয়। এতে বিশাল জনশক্তি ও উপাদান যোগান দিতে হয়। তা ছাড়া, শহরের প্রতিটি মানুষের সমর্থন ও ত্যাগ স্বীকারও এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এসব শুধুমাত্রই চীনের নানচিং শহরে ঘটেছে, তা নয়। দু'মাসের মধ্যে প্রত্যেক চীনা এমন কিছু-না-কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।
এখানে হয়তো অনেকের প্রশ্ন যে, কেন তথ্যচিত্রটি নানচিং শহরে তৈরি হলো?
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে এ প্রামাণ্যচিত্রের পরিচালকের কথা উল্লেখ করতে হয়। এ প্রামাণ্যচিত্রের পরিচালকের নাম তাকেউচি রিও। এই জাপানি পরিচালক নানচিং শহরে বাস করেন।
এ তথ্যচিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে তাকেউচি রিও বলেন, সে সময় জাপানে মহামারীর অবস্থা দিন দিন ভয়াবহ হতে দেখে তিনি অনেক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি দেখেন, জাপান সরকারের মোকাবিলা ব্যবস্থা এবং এ ভাইরাসের বিষয়ে অধিকাংশ জাপানি যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি। বিশেষ করে বর্তমানে চীনে মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনতে দেখে কোনো কোনো জাপানি ভুল মনে করে যে, মহামারী তেমন ভয়াবহ নয়। তবে তারা জানেন না, বিশাল সাফল্য অর্জনের পিছনে রয়েছে চীন সরকার ও চীনা জনগণের বিরাট পরিশ্রম।
তিনি বলেন, নভেল করোনাভাইরাস মহামারী প্রতিরোধের পর চীনের চিকিত্সকরা ঝুঁকি উপেক্ষা করে প্রথমফ্রন্টে কাজ করেছেন। চীনা জনগণ ব্যক্তিগত জীবনের নানা সুবিধাও ত্যাগ করেছে। বলা যায়, প্রত্যেক চীনার ওপর বিভিন্ন মাত্রায় প্রভাব পড়েছে। সবার পরিশ্রমের ফলে বর্তমানের সাফল্য এসেছে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, তার এই চলচ্চিত্র জাপানে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বর্তমানে এনএইচকে, টিবিএস ও ফুচি টেলিভিশন নেটওয়ার্কসহ দশটিরও বেশি জাপানি গণমাধ্যম তার এই তথ্যচিত্র প্রচার করেছে এবং তার সাক্ষাত্কারও নিয়েছে।
তিনি বলেন, এর আগে জাপানি জনগণ শুধুমাত্র মহামারী প্রসঙ্গে নানা অনুষ্ঠান দেখত। এখন তারা জানে যে, চীনের মহামারী পরিস্থিতি ধাপে ধাপে ভালোর দিকে যাচ্ছে। তবে এর পিছনের গল্প তারা জানত না।
চীনের গণমাধ্যমের কাছে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে তিনি স্বীকার করেন, আসলে তিনি জাপানিদের জন্য এ তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। তবে এ তথ্যচিত্র চীনাদের মধ্যে যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। যা আগে কল্পনা করেন নি তিনি। তিনি বলেন, এর প্রধান কারণ হলো, তারা এ তথ্যচিত্রে একজন বিদেশির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চীনে মহামারী প্রতিরোধের নানা দিক তুলে ধরেছেন।
তিনি আরো বলেন, একদিকে মহামারী চীনের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এবং ছোট আকারের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অন্যদিকে মহামারীর কারণে অনেক নতুন বাণিজ্যিক সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, অনলাইনে লেখাপড়া, দূর থেকে কাজ করা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার প্রভৃতি।
সাক্ষাত্কারে তিনি আরো বলেন, মহামারীর সময় সবাই খুব কম বাইরে যায় এবং প্রতিদিন বাসায় থাকে। এভাবে পরিবারের সদস্যদের একসাথে থাকার সময় বেড়েছে এবং তাদের মমতার বন্ধনও বেড়েছে। তিনি বলেন, আধুনিক সমাজে সেবা, সান্নিধ্য ও বিনিময়ের অভাব রয়েছে। মহামারীর পর জনগণের মানসিকতা ও মূল্যবোধও পরিবর্তিত হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
এ প্রামাণ্যচিত্রের শেষে পরিচালকের কথা আমার মনে গভীর দাগ কেটেছে। তিনি বলেন, আমি নানচিং শহরে আর্থিক ক্ষতির বিনিময়ে মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা অনুভব করতে পারি। অবশ্যই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিজস্ব নীতি আছে। আমার এই ভিডিও তৈরির উদ্দেশ্য, সবাইকে চীনের নেওয়া সব পদক্ষেপগুলোর মেনে চলার আহ্বান জানানো। পাশাপাশি এ ভিডিওয়ের মাধ্যমে সবাইকে কিছু অনুপ্রেরণা দেওয়া। ফলে নিজের অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ব্যবস্থা জারি করা যায়। কারণ একই আকাশের নীচে থাকা মানবজাতির একটাই লক্ষ্য; তা হলো সুস্থভাবে বেঁচে থাকা।
লিলি/তৌহিদ/শুয়ে