চীনের রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য কমিশনের প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত চীনে ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর এখন সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। অন্যদিকে মারা গেছেন ৩ হাজারের বেশি মানুষ। অনেকেই জানতে চান, রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর কেমন চিকিত্সা পেয়ে থাকেন? বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিত্সাপদ্ধতি কি আলাদা? বর্তমানে রোগীদের সুস্থ হওয়ার অভিজ্ঞতা আগামীতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দূর করার ক্ষেত্রে কী কী তাত্পর্য রয়েছে? এসব দিক বিবেচনায় সাংবাদিকরা সম্প্রতি বেশ কয়েকজন করোনাভাইরাস থেকে সেরে উঠা রোগী ও চিকিত্সকের সাক্ষাত্কার নিয়েছেন। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা শুনবো তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা।
১. সতর্কতার সঙ্গে যত্ন নেওয়া, চীনের ঐতিহ্যবাহী চিকিত্সা ও পাশ্চাত্য চিকিত্সার যৌথ প্রয়োগ
সম্প্রতি চীনের শানতুং প্রদেশের লিন ই শহরের গণ-হাসপাতালে বেশ কয়েক দিন চিকিত্সা ও যত্নের পর দুই জন রোগী কোভিড-১৯ রোগ থেকে মুক্ত হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। চিকিত্সকরা তাদেরকে সুস্থ হওয়ার জন্য ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানান। দু'জন রোগী বলেন, সবার যত্নের জন্য অনেক ধন্যবাদ। বিশেষ করে গণ-হাসপাতালের চিকিত্সক ও নার্সদের ধন্যবাদ জানাতে চাই। তারা নিজের প্রাণের ঝুঁকি উপেক্ষা করে আমাদের রক্ষা করেছেন।
লিন ই শহরের গণ-হাসপাতালের উপ প্রধান চাং ছিং হুয়া বলেন, রোগী মিস্টার চেং ২২ জানুয়ারি ভাইরাসে আক্রান্ত হন। তার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। ভাইরাস প্রতিরোধ, প্রদাহ প্রতিরোধ, ইমিউন ব্যবস্থা জোরদার, পুষ্টি সরবরাহ এবং সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট, চীনা ঐতিহ্যবাহী ওষুধ ও পাশ্চাত্য ওষুধ যৌথভাবে প্রয়োগের পরও তাঁর অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না। এর পর হাসপাতালের বিশেষজ্ঞদল এবং প্রাদেশিক পর্যায়ের বিশষেজ্ঞরা রোগীকে নতুন চিকিত্সা দেওয়ার প্রস্তাব দেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আট দিন পর রোগীর নিউমোনিয়া আস্তে আস্তে ভালো হয়। বর্তমানে তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়ে গেছেন।
কয়েকদিন আগে নভেল করোনাভাইরাসের রোগী মিস্টার ওয়েই, মিস্টার ছি, এবং মিস্টার ছুং চীনের শানতুং প্রদেশের ওয়েই হান শহরের বুকের হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যান। রোগীরা জানায়, সঠিক চিকিত্সা এবং নার্সের দিন-রাত যত্নের কারণে আমি এই রোগ থেকে সেরে উঠতে পেরেছি। হাসপাতালে থাকাকালে প্রতিদিন অনেক বিশেষজ্ঞ আমার খোঁজ খবর নেন, চিকিত্সকরা ২৪ ঘণ্টা আমার অবস্থার ওপর নজর রাখেন। এভাবেই আমি দিন দিন ভালো হয়ে উঠি।
৬ ফেব্রুয়ারি, চীনের শানতুং প্রদেশের ইয়ান থাই শহরের ছিশান হাসপাতাল থেকে মিস লিউ করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যান। তিনি বলেন, চিকিত্সক ও নার্সরা আমার যত্ন ও চিকিত্সা করার জন্য দিন-রাত ব্যস্ত ছিলেন। পরিশ্রমে তাদের চোখ লাল হয়ে যেত। আমার শরীর দিন দিন ভালো হয়ে উঠতে লাগল। তাদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
ছি শান হাসপাতালের ক্রিটিকাল মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের প্রধান নিউ ছুয়ান চেং বলেন, মিস লিউ আমাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর আমরা পুরো শহরের শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করি, আমরা শ্রেষ্ঠ চিকিত্সাপদ্ধতি ব্যবহার করি। চীনা ঐতিহ্যবাহী ওষুধ এবং পাশ্চাত্য ওষুধ একসাথে প্রয়োগ করার পর রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন। এখন যেসব রোগী আমাদের হাসপাতালে চিকিত্সাধীন আছেন, তাদের অবস্থাও ভালোর দিকে যাচ্ছে।
সাংবাদিকরা জানতে পারেন, ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, শানতুং প্রদেশে মোট ৬৩জন করোনাভাইরাসের রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তারা সবাই চীনের ঐতিহ্যবাহী চিকিত্সাপদ্ধতি এবং পাশ্চাত্য চিকিত্সা পদ্ধতির মাধ্যমে চিকিত্সা সেবা দিয়েছেন।
৬ ফেব্রুয়ারি সকালে শানতুং প্রদেশের ছিংতাও শহরের ছেংইয়াং জেলায় সনাক্ত হওয়া প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়ে দেন। হাসপাতালে চিকিত্সাধীন ছেং ইয়াং জেলার গণ-হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ তাঁর চিকিত্সা করেন, এ ছাড়া, আরও ১৬জন চিকিত্সক ও নার্স তার যত্ন নিয়েছেন।
২. অবসাদের অনুভূতি দূর করা, সুস্থ হওয়ার আস্থা সুসংবদ্ধ করা
৮ ফেব্রুয়ারি বিকালে, শানতুং প্রদেশের দ্য চৌ শহরে আরো দুইজন রোগী সুস্থ হয়। তাদের চিকিত্সকরা মনে করেন, সুস্থ হওয়ার জন্য শুধু রোগীকে ভালো চিকিত্সা সেবা দেওয়াই নয়, বরং রোগীর মানসিক অবস্থার ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে, সময়মতো তাদের মানসিক সাহায্য দিতেও হবে।
শানতুং প্রদেশের দ্য চৌ শহরের গণ-হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিভাগের উপ প্রধান ছেং হুই চেং বলেন, 'মানুষের মানসিক অবস্থা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। স্থিতিশীল মানসিক অবস্থা হলো ভাইরাস পরাজিতকারী শক্তিশালী ব্যবস্থার মধ্যে অন্যতম। তাই আমরা ভাইরাস প্রতিরোধ ও চিকিত্সার কাজের পাশাপাশি আমরা মনোব্যাধির চিকিত্সকও বটে। আমরা ভাইরাস প্রতিরোধে রোগীর মনের ভয় জয় করাকেও গুরুত্ব দেই। তাদের মনের নেতিবাচক অনুভূতি দূর করি'।
শানতুং প্রদেশের লাই চৌ শহরের সনাক্ত হওয়া প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী মিস্টার ওয়াং হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সময়টি ছিল চীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বসন্ত উত্সবের সময়। আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে থাকা এবং রোগের সৃষ্ট খারাপ অনুভূতির কারণে তাঁর মানসিক অবস্থাও খুব খারাপ হয়। তাঁর চিকিত্সক, লাই চৌ শহরের গণ-হাসপাতালের চিকিত্সক লি মিং সৌ বলেন, এজন্য হাসপাতাল রোগীর বিশেষ মনোব্যাধির চিকিত্সকও নিয়োগ করেছেন। প্রতিদিন তাঁর খোঁজ খবর নেয়ার সময় চিকিত্সকরা তাঁকে উপযুক্ত সান্ত্বনাও দেন। তাঁর মনকে উষ্ণ করেন। অল্পের সময়ের মধ্যে মিস্টার ওয়াং-এর মানসিক অবস্থা অনেক ভালো হয়, তিনি সক্রিয়ভাবে ডাক্তারের চিকিত্সার সঙ্গে সহযোগিতা করতে শুরু করেছেন এখন তিনি সুস্থ হয়ে নিজের বাসায় ফিরে গেছেন।
শানতুং প্রদেশের ওয়েই হান শহরে হাসপাতালের চিকিত্সা বিশেষজ্ঞ গ্রুপের প্রধান, ওযেই হান শহর হাসপাতালের সংক্রমিত রোগ বিভাগের উপ প্রধান চেং চিং বলেন, দৈনন্দিন চিকিত্সা ছাড়া, হাসপাতাল সব রোগী ও সংশ্লিষ্ট চিকিত্সকের জন্য একটি উইচ্যাট গ্রুপও তৈরি করা হয়। রোগীদের কোনো প্রশ্ন থাকলে তাঁরা উইচ্যাটের মাধ্যমে চিকিত্সক ও নার্সদের জানাতে পারেন। অনেক সময়, আমরা রোগীদের মানসিক সহযোগিতা দেই, সুস্থ হওয়া রোগীর অভিজ্ঞতা জানিয়ে তাদের উত্সাহিত করি।
শানতুং প্রদেশের ইয়ান থাই শহরের রোগী মিস্টার লিউ এখন সুস্থ হয়েছেন। তিনি বলেন, সরকার এবং চিকিত্সকের যত্ন ও সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি সব রোগীদের বলতে চাই, নিরাশ হবেন না, হতাশ হবেন না, নিজের মন্দ অনুভূতিকে পরাজিত করুন, সুস্থ হওয়ার আস্থা বৃদ্ধি করুন। চিকিত্সকের কথা অনুসারে সহযোগিতা করুন, আপনিও নিশ্চয়ই এই রোগ থেকে সুস্থ হতে পারবেন। আমি নিজেই এরকম একটি উদাহরণ।
৩. বিজ্ঞানসম্মত খাওয়া-দাওয়া করা, হাসপাতাল ছাড়লেও আরো কয়েক দিন আইশোলেশনে থাকা
বেশ কয়েকজন করোনাভাইরাসের রোগী সাংবাদিককে জানান, এ ভাইরাসকে পরাজিত করতে চাইলে বিজ্ঞানসম্মতভাবে খাওয়া-দাওয়া করা খুব প্রয়োজন। তাঁরা বলেন, চিকিত্সক তাদের শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী, বিশেষ করে তাদের জন্য রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধিকারী পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করেন। প্রতিটি খাবার খুব সুস্বাদু। এখন চিকিত্সকের কথা স্মরণ করে তাঁরা বুঝতে পারেন যে, অসুস্থের সময় কোনো কিছু খাওয়া বা পান করতে না পারলে, কোনও ভালো ওষুধে কাজ হবে না। নিজের শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে নিউমোনিয়া যাবে না।
নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধের সময় শানতুং প্রদেশের বেশ কয়েকটি হাসপাতাল রোগীদের খাওয়া-দাওয়ার ওপর বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। বিজ্ঞানসম্মতভাবে রোগীদের উপযোগী খাবার দিয়েছে। রোগীদের কথা অনুযায়ী, প্রতিদিন তাদের খাবারে তিনটি শাকসবজির মিল, দুইটি মাংসের মিল ও ফল থাকে। এতে রোগীর পুষ্টি নিশ্চিত করা যায়।
শানতুং প্রদেশের বিন চৌ শহরের কেন্দ্রীয় হাসপাতালের ক্রিটিকাল মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের প্রধান খুং লিং কুই বলেন, রোগী সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যাওয়ার পরও বাসায় নিজের শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বার বার হাত ধুতে হয়, প্রতিদিন ঘরে বিশুদ্ধ বাতাসের প্রবাহ নিশ্চিত করতে হয়। তিনি জনসাধারণকে বলতে চান, নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করা যায়, নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং চিকিত্সা করা যায়। সবার উচিত চিকিত্সকের প্রতি আস্থা রাখা, বিজ্ঞানের প্রতি আস্থা রাখা, সক্রিয়ভাবে চিকিত্সকের সঙ্গে সহযোগিতা করা, যাতে দ্রুত এ ভাইরাসের মহামারী পরাজিত করা যায়।
(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)