৩৭ বছর বয়সি পিয়ান দো তিব্বতের শিকাজের মানুষ। ২০১৪ সালে তিনি লাসা শিশু কল্যাণ সদনে যোগ দেন। তবে তার পেশা একটু বিশেষ ধরনের। তিনি একজন মা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
শিশু কল্যাণ সদনের প্রধান নো পু চুও মা জানিয়েছেন, তারা ৩০০টি শিশুকে ১৮টি পরিবারে ভাগ করেন এবং প্রতিটি পরিবারের জন্য একজন 'মা' নিয়োগ করেন। যারা শিশু কল্যাণ সদনে ভর্তি হয় তাদের বা-বামা নেই। বর্তমানে এখানকার সবচেয়ে ছোট শিশুটির বয়স মাত্র ৩ মাস এবং সবচেয়ে বড় শিশুটি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। যদি তারা আরও শিক্ষা গ্রহণ করতে চায় তাহলে শিশু কল্যাণ সদন তাদেরকে আর্থিক সহায়তা দেবে। নো পু চুও মা বলেন, 'আমরা শিশুদেরকে একজন শিক্ষক বা তত্ত্বাবধায়ক দিতে চাই না। আমরা তাদেরকে একটি পরিবার দিতে চাই। যখন তারা বাড়িতে ফিরে আসে তখন অন্য সাধারণ মানুষের মতো মা-কে দেখতে পায়।'
২০১৫ সালে, পিয়ান দো নম্বর ১০ পরিবারের মা হন বা অন্যভাবে বললে, ২২টি শিশুর মা হন। তিনি ও শিশুরা দুটি বাড়িতে বাস করেন। প্রতিটি বাড়িতে চারটি করে শয়নকক্ষ এবং একটি বসার ঘর আছে। বাড়ির একটি রুম ভোজনশালা হিসাবে ব্যবহার করা হয়, বাকিগুলো শয়নকক্ষ। বসার ঘরে আছে সোফা, টিভি ও ফ্রিজসহ আসবাবপত্র ও গৃহস্থালী যন্ত্রপাতি। পিয়ান দো এ বাড়ি সাজানোর দায়িত্ব পালন করেন। শিশুদের জীবনযাত্রার ব্যয় সরকারী তহবিল থেকে আসে। প্রতিমাসে সরকার নির্দিষ্ট অংকের টাকা পিয়ান দোর একটি ব্যাংক-একাউন্টে জমা দেয়। তিনি সকল শিশুর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেন। অবশ্য শিশু কল্যণ সদন পিয়ান দোর কাজ তত্ত্বাবধান করে।
তবে শুরুতে পিয়ান দো তার কাজ নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, 'আমাদের পরিবারে মেয়ের চেয়ে ছেলে বেশি এবং কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আমার চেয়ে তারা লম্বা। শুরুতে আমি তাদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলব, বুঝতে পারছিলাম না।'
পিয়ান দো নিজে একজন অনাথ। ছোটবেলায় বাবা-মা হারিয়েছেন। তিনি আশা করেন, অন্য শিশুরা তার মতো আর এই ব্যথা অনুভব করবে না। তাই তিনি শিশু কল্যাণ সদনে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে বাস্তবতা হল, যখন বিভিন্ন শিশুর সঙ্গে কথা বলেন, তিনি মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে ফেলেন। তিনি বলেন, শুরুতে শিশুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা তার জন্য বড় সমস্যা ছিল।
ক্য শাং ২২টি শিশুর অন্যতম এবং পিয়ান দো একসময় এ ছেলের সঙ্গে ভাব জমানোকে সবচেয়ে কঠিন মনে করতেন। এ ছেলে তার কোনো কথা শুনতো না। এমনকি, সে কখনও কখনও উষ্মা প্রকাশ করতো। পিয়ান দো আলাদাভাবে ক্য শাংয়ের সঙ্গে একবার কথা বলেন এবং ক্য শাং তাকে জানায়, একসময় ক্য শাং প্রাথমিক স্কুলে সে পঞ্চম শ্রেণীর একজন ছাত্র। একবার পিতামাতা সম্মেলন আয়োজন করা হয় স্কুলে। কিন্তু সেখানে পিয়ান দো যাননি। আসলে, ওই দিন অনেক শিশুর শিক্ষাঙ্গনেই পিতামাতার সম্মেলন ছিল এবং পিয়ান দোর পক্ষে সব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। তাই তিনি তার বদলে পরিবারের বড় একজন সদস্যকে ক্য শাংয়ের পিতামাতা সম্মেলনে পাঠান। ছোট ক্য শাং যেমন বিষণ্ণ তেমন আশাহীন হয় এতে এবং একজন অবাধ্য সন্তানে পরিণত হয়। পিয়ান দো প্রথমবারের মতো বুঝেন যে, ক্য শাংয়ের মতে পিতামাতা সম্মেলনে না-গিয়ে পিয়ান দো তাকে অবহেলা করেছেন। তখন থেকে, শত ব্যস্ততার মধ্যেও পিয়ান দো সবসময় ক্য শাংয়ের পিতামাতা সম্মেলনে অংশ নিতে থাকেন। অবশ্য তিনিও পরিবারের একটি সম্মেলন আয়োজন করেন। তিনি সকল শিশুকে বলেন, 'আমরা বড় একটি পরিবার। আমি প্রত্যেকের সমান যত্ন নিতে পারি না। তবে, আমি তোমাদেরকে ভালবাসি। আমি ব্যস্ত হলে বড় ভাই ও বোন আমাকে সাহায্য করবে। তারাও তোমাদের পরিবার।'
প্রতিটি শিশুর মন স্পর্শকাতর। পিয়ান দো আশা করেন, বড় এ পরিবারের মাধ্যমে তাদেরকে শিশুরা ভালোবাসার ছোঁয়া পাবেন। যে-কোন সময়ে তারা যদি পেছনে তাকিয়ে দেখে, নিজের পরিবার দেখতে পাবে।
তিব্বতে, কোন শিশু একা থাকতে পারে না। ২০১৫ সাল থেকে তিব্বতে অনাথদের দত্তক গ্রহণের নীতি বাস্তবায়িত হয়। বর্তমানে তিব্বতে শিশু কল্যাণ সদন ১১টি এবং সব জাতীয় মানদন্ড অনুযায়ী নির্মিত। প্রতিটি শিশু প্রতিমাসে ১০০-১৩৫০ ইউয়ানের ভাতা পায় এবং পাশাপাশি প্রাক বিদ্যালয় থেকে হাই স্কুল পর্যন্ত ১৫ বছরের বাধ্যতামূলক শিক্ষা গ্রহণ করে।
সারা তিব্বতে ৫৪০০ জন অনাথ শিশু সরকার ও সমাজের যত্নে নতুন পরিবার পেয়েছে। প্রতিটি শিশুর আছে উজ্জ্বল একটি ভবিষ্যত।
ক্য শাং পরে পিয়ান দোর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ একজন সন্তান হয়। এখন সে জুনিয়র হাই স্কুলের ছাত্র। প্রতিবার পিতামাতা সম্মেলনে পিয়ান দো ক্য শাংয়ের শিক্ষকের কাছ থেকে প্রশংসা শুনতে পান। পরিবারের ৬ জন সদস্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছে। তবে তারা প্রতিমাসে নিয়মিতভাবে পরিবারের ছোট ভাই-বোনদের জন্য টাকা পাঠায়। তারা কেউ কেউ পুলিশ অফিসার হয়েছে, কেউ কেউ পিয়ান দোর মতো কল্যাণকর সংস্থায় কাজ করছে। পিয়ান দের একজন মেয়ে, ২৩ বছর বয়সী মাই মা একজন হেলিকপ্টার পাইলট।
পিয়ান দো যখন শিশুদের কথা বলেন, মুখে সবসময় থাকে মৃদুহাসি। তিনি বলেন, 'আমি অভিভূত হই। প্রতিটি শিশু আমাকে গৃহকাজে সাহায্য করে।' গত বছর পিয়ান দোর জন্মদিনের সময়, কয়েকটি শিশু তাকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে যাচ্ছিল এবং বাকিরা বাড়িতে গোপনে তার জন্য একটি জন্মদিনের পার্টি আয়োজন করে। যখন তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন এবং সব প্রস্তুতি দেখেন, তার মনে পড়ে যে ওই দিন তার জন্মদিন।
পিয়ান দো বলেন, 'আমি নিজেও জন্মদিনের কথা ভুলে যাই। তখন আমি ভাবলাম, তাদের মা হওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে ভাল একটি সিদ্ধান্ত।'
তিব্বতি নববর্ষের সময়ে, শিশুরা সবাই স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে আসে এবং সবাই একটি টেবিলে বসে একসাথে নববর্ষের খাবার খায়। বারান্দায় লাগানো হয় কিছু আলংকারিক কার্ড। এর মধ্যে একটি কার্ডে লেখা আছে একটি ইংরেজি বাক্য। পিয়ান দো কোনো ইংরেজি জানেন না। তবে তার শিশুরা বুঝতে পারে। এ কার্ডে লেখা আছে: I know what love is, because I have you। আমি জানি ভালবাসা কি, কারণ আমার তুমি আছো। (শিশির/আলিম)