বাকেট লিস্ট
  2020-03-05 14:45:09  cri

' বাকেট লিস্ট ' নামে জাপানের এই চলচ্চিত্রে পারিবারিক মমতার বন্ধনে ভরপুর এই চলচ্চিত্রটিতে কমেডি বা হাস্যরসের মাধ্যমে পরিবারের মূল্যবোধ, জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কিত বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে।

হয়তো অনেক শ্রোতা 'The Bucket List' এই নাম শুনলেই একটি মার্কিন চলচ্চিত্রের কথা ভাবেন। হ্যাঁ, জাপানের এই চলচ্চিত্রটি যুক্তরাষ্ট্রের সেই ক্ল্যাসিকাল শিল্পকর্ম অবলম্বনেই রিমেক করা হয়। জাপানের এই চলচ্চিত্রে একজন ধনী মানুষ এবং একজন সাধারণ মানুষের গল্প তুলে ধরা হয়। তবে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা দু'জন পুরুষ দু'জন নারীতে রূপান্তরিত হয়।

শিংচি নামে এক নারী হচ্ছেন সবিনয় ব্যক্তিত্বের একজন গৃহিণী। তার বয়স ৭০ বছরের বেশি হলেও তিনি পরিবারের নানা গৃহকর্মে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি স্বামী ও ছেলের যত্ন নিয়ে থাকেন।

তার স্বামী সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সারাদিন সোফায় বসে টিভি অনুষ্ঠান দেখেন। তার সঙ্গে শিংচি কথা বললে খুব ধীরে ধীরে জবাব দেন তিনি।

ছেলে সারা দিন নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে থাকে এবং রুমে কম্পিউটার গেমস খেলে।

এভাবে পরিবারে তিনজন থাকলেও শিংচির সঙ্গে কথা বলার মতো একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায় না।

এ অবস্থায় কেউ খেয়াল করেনি যে, শিংচি'র শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

অসুস্থ হলে তিনি একা একাই হাসপাতালে ভর্তি হন।

সর্বশেষ এক শারীরিক পরীক্ষায় চিকিৎসক তাকে জানিয়ে দেন যে, তিনি পাকস্থলি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং খুব দ্রুত মারা যাবেন। বিনা মেঘে বজ্রপাতের সম্মুখীন হয়ে শিংচি খুব শান্তভাবে সব বাস্তবতা মেনে নেন।

হাসপাতালে থাকার সময় আরেকজন অসুস্থ শিংচি'র ঘরে আসেন। তার নাম মোচি।

মোচি বাণিজ্যিক মহলে একজন প্রভাবশালী মহিলা। তিনি জাপানের টপ শ্রেণীর বিলাসি চেইন হোটেলের মালিক।

একটি ঘটনায় হাসপাতালে শিংচি'র সঙ্গে একই রুম শেয়ার করতে বাধ্য হন তিনি।

এভাবে দুই নারীর মধ্যে অনেক মজাদার গল্প শুরু হয়।

একদিন শিংচি তামাক না খাওয়ার জন্য এক মেয়েকে পরামর্শ দেন। কিন্তু সে সময় হঠাৎ মেয়েটি মাটিতে পড়ে যায়। তারপর মেয়েকে আইসিইউতে পাঠানো হয়।

তারপর মেয়ের ছোট ভাইয়ের মুখে সে জানতে পারে যে, তার বোন মারা গেছে। মারা যাবার সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর।

জীবন এত নাজুক দেখে দু'জন অনেক বিস্মিত হয়ে পড়েন।

তারা সেই মেয়ের একটি ডায়রি পেয়ে যান। ডায়ারিতে লেখা ছিল, মেয়েটি যেসব কাজ করতে চায় এবং যা কখনও করে নি এমন সব কাজের তালিকা।

তাই তারা দু'জন মেয়ের জন্য তার অমীমাংসিত ইচ্ছাগুলো বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেন।

তাদের প্রথম গন্তব্যস্থান হলো লস অ্যাঞ্জলস। সেখানে তারা 'অবতরণ ছত্রের' (রোলার কোস্টার ?) অভিজ্ঞতা নিতে চান। তারপর তারা সেই ডায়রিতে উল্লেখিত নানা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। যেমন, মোচি'র ব্যক্তিগত বিমানযোগে কোটিপতির ভ্রমণ অভিজ্ঞতা গ্রহণ করা, পিরামিড দেখতে মিশর ভ্রমণ করা ইত্যাদি।

বাইরে থেকে দেখা যায়, শিংচি এবং মোচি মেয়েটির অমীমাংসিত ইচ্ছাগুলো বাস্তবায়ন করছেন। তবে তাদের এই ভ্রমণের মাধ্যমে মৃত্যুবরণের আগে পরিবার নয়, কোম্পানি নয়, নিজেদের জীবনের জন্য কিছু সময় কাটানোর সুযোগ দেওয়া হয় তাদেরকে।

নিজের বাবা মাকে ধন্যবাদ দেওয়া হলো মেয়ের ডায়রিতে উল্লেখিত আরেকটি ইচ্ছা।

এই ইচ্ছা বাস্তবায়নে মোচি কিছু দ্বিধায় পড়ে যান। কারণ, ছোটবেলায় তার মা মারা যান। বাবার প্রতি তার মনে ঘৃণা আছে। কারণ, বাবা বিশাল ঋণ নিয়ে পালিয়ে যান। তারপর বাবার সঙ্গে আর দেখা হয়নি।

নার্সিং হোমে মোচি বাবার সঙ্গে আবার দেখা করেন। বাবা আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত হন। তিনি কিছু মনে রাখতে পারেন নি। তবে তার মুখে বারবার মোচি'র নাম উচ্চারিত হয়। এই দৃশ্য দেখে মোচি'র হৃদয় গলে যায়। তিনি বাবাকে ক্ষমা করে দেন।

ডায়রিতে মেয়ের বিয়ের পোশাক পরার ইচ্ছাও লিখেছিল। শিংচিকে দিয়ে এই ইচ্ছা পূরণের জন্য গোপনে প্রস্তুতি নেন মোচি।

কারণ শিংচি'র বিবাহের অনুষ্ঠানে শাশুড়ির অনুরোধে জাপানের ঐতিহ্যবাহী পোশাক বা কিমোনো পরা হয়। তিনি কখনও বিয়ের পোশাক পরেন নি।

অপ্রত্যাশিত ব্যাপার হলো শিংচি'র স্বামীসহ পরিবারের সদস্যরাও মোচি'র আমন্ত্রণে ঘটনাস্থলে আসেন। শিংচি ও তার স্বামী তাদের বিয়ের ৫০তম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

শিংচি'র কাছে সবচেয়ে সুখের বিষয় স্বামীর উপস্থিতি নয়, বরং দেরিতে হলেও তার ক্ষমা প্রার্থনা ও আন্তরিক স্বীকারোক্তি।

শিংচিকে স্বামী বলেন, যদি আমাদের পরের জীবন থাকে, তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে?

হ্যাঁ, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অনেক কঠিন। তাই না? আমি অযোগ্য একজন স্বামী। তুমি আমার হয়ে আমার মাকে দেখভাল করো, আমার সন্তানকে লালন-পালন করো। কিন্তু সবসময়ই আমি তোমার অনুভূতিকে অবহেলা করি। তুমি কখনও নালিশ করো নি। আমি পরিবারের সব তুচ্ছ কাজ তোমাকে দিয়ে করিয়েছি। এখন তোমার জীবন শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। তবে আজ থেকে আমি প্রচেষ্টা চালাতে চাই। তোমার সুখের জন্য আমি চেষ্টা করতে চাই। আর কোথাও যাবে না, আমার পাশে থাকো। না, আসলে আমি তোমার পাশে থাকতে চাই।

বলা যায়, জাপানের এই চলচ্চিত্রটিতে ওরিজিনাল গল্পের ওপর সম্মান করার ভিত্তিতে সূক্ষ্ম ও বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে পূর্ব দেশের পরিবারের নারীদের অসীম ধৈর্য ও তাদের জীবনভর উৎসর্গের দিকটি তুলে ধরা হয়েছে।

ডায়রির বাকেট লিস্টে সর্বশেষ আরও একটি ইচ্ছা আছে। এই ইচ্ছা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ অনেক কঠিন। সেই অসম্ভব চ্যালেঞ্জ কী? বন্ধুরা, চলচ্চিত্রটি দেখেই সে উত্তর খুঁজে নিন আপনারা।

অবশেষে শিংচি এবং মোচি মারা যান, তবে মারা যাওয়ার আগে তারা অসম্ভব সব চ্যালেঞ্জ সম্পন্ন করেন।

আরেকটি মজার বিষয় হলো মারা যাওয়ার আগে সেই ছোট মেয়েটির সঙ্গে অপ্রত্যাশিতভাবে শিংচির আবারও দেখা হয়। আসলে তাকে আইসিইউতে নিয়ে যাবার পর সে মারা যায়নি!

সবকিছু ছিল একটি সুন্দর ভুল বোঝাবুঝি। গোটা চলচ্চিত্র দেখার পর জীবনের প্রতি মানুষের চিন্তা বদলে যেতে পারে।

চলচ্চিত্রে মোচি একটি কথা বলেন, জীবনে অনেক অসুখ আছে। অনেক ধনসম্পদ দিয়েও তা পূরণ করা যায় না। তবে এসব অসুখ বা দুঃখের পাশাপাশি জীবনে অনেক সৌন্দর্যও আছে। আমাদের নিরলস সাধনার শক্তি দিয়ে তা উপলব্ধি করা যায়।

শিংচি ও তার স্বামীর ৫০তম বিয়ের বার্ষিকীতে স্ত্রীকে স্বামীর সেই মুগ্ধকর কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, চোখের সামনের প্রেমিকাকে মূল্য দেওয়া এবং মনোযোগ দিয়ে আশেপাশের আনন্দ রক্ষা করা উচিত। কোনো কিছুই স্থগিত রাখা বা ফেলে রাখা ঠিক না। জীবন ও মৃত্যুর এই প্রক্রিয়ায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের মন উন্মুক্ত রাখা উচিত হাজার রকমের কাজের মধ্যে এটাই আমাদের পক্ষে করা সম্ভব একমাত্র কাজ।

লিলি/তৌহিদ/শুয়ে

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040