কনটেইজন
  2020-02-13 14:05:39  cri

কনটেইজন (contagion) নামে ৮ বছর আগে তৈরি এই চলচ্চিত্র সম্প্রতি আবারও বেশ আলোচিত হয়ে উঠেছে। কারণ, চলচ্চিত্রটি সম্প্রতি চীনের উহান শহর থেকে উদ্ভূত নভেল করোনাভাইরাসের সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়।

আসলে হলিউডের অনেক তরকার অভিনীত এই চলচ্চিত্রটি ২০১১ সালে তেমন জনপ্রিয়তা পায় নি। এবার সারা পৃথিবীতে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর ব্রিটেনের (I Tunes) আই-টিউনসে চলচ্চিত্রটির বিক্রি বাড়তে শুরু করে এবং দ্রুত গতিতে ৮ম শীর্ষস্থানে চলে আসে।

নিউ সায়েনটিস্ট নামের পত্রিকাটি এই চলচ্চিত্র সম্পর্কে বলে, হলিউডের বাণিজ্যিক ফিল্মের মধ্যে এটি খুব বিরল। কারণ, বিজ্ঞানসম্মত বাস্তবতাকে এ চলচ্চিত্রে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

এ চলচ্চিত্রের জন্য পেশাদার উপদেষ্টা হিসেবে প্রযোজনা সংস্থা বিশেষভাবে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রমণ এবং ইমিউন বিভাগের অধ্যাপক (ian lipkin) ইয়েন লিপকিনকে আমন্ত্রণ জানায়। যাতে বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর যথার্থতা নিশ্চিত করা যায়।

এখন সারা চীনে নভেল করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে এই চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করা বেশ বাস্তবসম্মত।

নাম শুনে বোঝা যায়, কনটেইজন (contagion) নামে এ চলচ্চিত্রে বিশ্বজুড়ে সংক্রামক রোগ নিয়ে একটি ঘটনা তুলে ধরেছে।

চলচ্চিত্রে দেখানো রোগের কারণ হলো এমইভি-১ নামে নতুন ভাইরাস।

সবকিছু খুব দ্রুত ঘটে যায়। হংকং থেকে ফিরে আসার পর এক কোম্পানির একজন সিনিয়র কর্মীর জ্বর ও কাশি হয়। মাত্র ৪ দিন পর তিনি হঠাত্ করে মারা যান। একইদিন তার ছেলেরও শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তারপর হংকং ও টোকিওতে একই রকম মৃত্যু দেখা যায়। ভয়াবহ এই ভাইরাস সুবিধাজনক আধুনিক পরিবাহকের মাধ্যমে দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে বিশ্বের ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় ভাইরাসটি।

এ চলচ্চিত্রে অনেকের গল্প একসঙ্গে তুলে ধরার পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। এতে মহামারীসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়া রোগী, তাদের আত্মীয়স্বজন, চিকিত্সক ও নার্স, সরকারি কর্মকর্তা, গণমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষের অনুভূতি ও কার্যকলাপ তুলে ধরা হয়।

আরো অবিশ্বাস্য বিষয় হলো, চলচ্চিত্রে তুলে ধরা বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে এবারের নভেল করোনাভাইরাসের দারুণ মিল রয়েছে।

চলচ্চিত্রে দেখা যায়, প্রাণঘাতী এ ভাইরাস অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। ফুসফুসের রোগ হিসেবে এই ভাইরাস সর্দি-কাশি বা রোগাক্রান্ত মানুষের থুথু থেকে ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি, স্পর্শের মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই ভাইরাস বিভিন্ন জিনিসের গায়ে লেগে বেঁচে থাকতে পারে। যেমন, দরজার হ্যান্ডেল, বাস ও সাবওয়ের হ্যান্ডেল, কল ও লিফটের বোতাম প্রভৃতি।

বিভিন্ন সংস্পর্শের মাধ্যমে ভাইরাসটি মানুষের হাতের সঙ্গে লাগে। প্রতিদিন হাত দিয়ে মানুষের মুখ স্পর্শ করা গড় সংখ্যা প্রায় ২০০০ বা ৩০০০ হাজার টাইমস। এভাবে ভাইরাস আমাদের মুখ, নাক ও চোখসহ মিউকোসাল সাইটের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। আরো আতঙ্কের বিষয় হলো সুপার সংক্রমণের উত্স বা লক্ষণ না থাকা সংক্রমণ। তারা ভাইরাস বহন করে নিজের অজান্তেই আরো ব্যাপক স্থানে তা ছড়িয়ে দিতে থাকেন।

সর্বপ্রথমে চিকিত্সক ও বিশেষজ্ঞরা সবাইকে মাস্ক পড়ার পরামর্শ দেন। তারপর তারা আবিষ্কার করেন, খুব কাছাকাছি বা রোগীদের সংস্পর্শে থাকা লোকজনও আক্রান্ত হচ্ছে। তারপর রোগীদের মলেও ভাইরাস সনাক্ত করা হয়। তাই ঘন ঘন হাত ধোয়া ও বাইরে না যেতে পরামর্শ দেওয়া হয়।

চলচ্চিত্রে দেখানো হয়, মহামারী ঠিক তখন ছড়িয়ে পড়ে, যখন পশ্চিমা জগতের থ্যাংক্স-গিভিং-ডে (Thanksgiving)। শপিং মল ও পরিবহন কেন্দ্রে মানুষের ব্যাপক ভিড়। পরিবারের সবার মিলন ও একসঙ্গে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের সময়। অর্থাত, মানুষের সঙ্গে মানুষের স্পর্শের পরিমাণ খুব দ্রুত ও ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে এবং সংক্রমণের হারও বাড়তে থাকে।

এবারের নভেল করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রথম সময় চীনাদের বসন্ত উত্সবের মতো বৃহত্তম উত্সব শুরু হয়। বসন্ত উত্সব উপলক্ষ্যে ব্যস্ত পরিবহনের ফলে ভাইরাস সংক্রমণের হার বাড়তে থাকে। সৌভাগ্যের বিষয় হলো, সময়মতো উহান শহর ব্লক করার ব্যবস্থা নেওয়ায় ভাইরাসের ব্যাপক ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সক্ষম হয় চীন।

বন্ধুরা এবার চলচ্চিত্রের বিভিন্ন অভিনেতার কথা বলব।

জুড ল একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী সাংবাদিক। তার সাংবাদিক চরিত্র আমার মনে তীব্র দাগ কাটে। চলচ্চিত্রে তিনি নিজের ব্লগ প্লাটফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি মহামারীর বিভিন্ন তথ্যের খোঁজ-খবর নেন। সরকার প্রথমে 'স্থিতিশীলতা বজায় রাখার' কথা বিবেচনা করে জনগণের কাছে প্রকৃত অবস্থা গোপন করে। ফলে সরকারের প্রতি আস্থা হারানোর পর জনগণ জুড ল'র কথা বিশ্বাস করে। কারণ তারা মনে করে, তার সত্য কথা বলার সাহস আছে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল একেবারে ভিন্ন।

তবে, এই সাংবাদিক ঔষধ কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশে অর্থ রোজগার করেন। তিনি মিথ্যা করে বলেন যে, তিনি রোগাক্রান্ত হয়েছেন। তারপর তিনি নিজের ব্লগে এক ধরনের ঔষধ খাওয়ার ভিডিও সরাসরি প্রচার করেন। কয়েকদিনের পর তিনি একদম সুস্থ হয়ে ওঠেন; যা ছিল একটি অভিনয়।

ইন্টারনেটে তার এই ভিডিও প্রচারের পর জনগণ এই ঔষধ কেনার জন্য দোকানের সামনে ভিড় করে। তারা বলপ্রয়োগে ঔষধ লুটপাট করতে থাকে। আরো গুরুতর ব্যাপার হলো, আগে সুস্থ থাকা লোকজন ওষুধ কিনতে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। চলচ্চিত্রে সেই সাংবাদিক ৪৫ লাখ মার্কিন ডলার আয় করে নীরবে অদৃশ্য হয়ে যায়।

এবার চীনের এই ভাইরাসের ওপর নজর দেবো।

চীনে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্রের মতো নানা গুজবও ছড়াতে থাকে। যেমন, কোন কোন ঔষধ ভাইরাস প্রতিরোধ করতে পারে বা সুপারমার্কেটে খাদ্যশস্যের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে ইত্যাদি। এসব গুজব আমাদের সতর্কভাবে মোকাবিলা করা উচিত্। গুজবে কান দেবো না, গুজব প্রচার করবো না এবং বিশ্বাস করবো না- এমন দৃঢ়তা থাকা উচিত।

এখন আমরা চলচ্চিত্রে জনপ্রিয় অভিনেত্রী কেট উইন্সলেটের চিকিত্সকের চরিত্র নিয়ে কথা বলব। তিনি প্রথম ফ্রন্টে ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। অনেক রাত তিনি ভালোভাবে ঘুমান নি এবং পেট ভরে এক বেলা খাবার খান নি। অবশেষ তিনি ভাইরাসে আক্রান্ত হন। কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফোনালাপে তিনি নিজের অমীমাংসিত কাজের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। মৃত্যুর প্রহর গোণার সময় তিনি নিজ শরীরের কাপড়, পাশে থাকা ঠান্ডায় কম্পমান অন্য রোগীর শরীরে তুলে দিতে ভুলে যান না।

চীনের এবারের মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের চিকিত্সক ও নার্সরা প্রকৃত মানবপ্রেমের উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তারা প্রতিরোধমূলক কাপড় ও মাস্ক সাশ্রয় করার জন্য সারাদিন পানি ও খাবার না খেয়ে কাজ করেছেন ও করছেন। তাদের এমন আচরণ সত্যিই শ্রদ্ধার যোগ্য।

এখন আবার আমরা চলচ্চিত্রে ফিরে যাই। মহামারী মোকাবিলার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট টিকা নিয়ে গবেষণার কাজও জরুরি ভিত্তিতে শুরু হয়। চলচ্চিত্রে রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের গবেষকরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টিকার কার্যকারিতা খতিয়ে দেখতে নিজের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। সৌভাগ্যের বিষয় হলো টিকা সফল হয়। তবে, সেই সঙ্গে আরেকটি সমস্যাও দেখা দেয়। যারা রোগে আক্রান্ত নয়, তারাও টিকা পেতে চায়। তবে টিকার উত্পাদনের পরিমাণ খুব কম। কোম্পানি কমপক্ষে ৯০ দিন সময় দিয়ে প্রথম দফার টিকা তৈরি করতে পারে।

তাহলে কে প্রথমে টিকা পাবে?

চলচ্চিত্রে সরকার লটারির ব্যবস্থা করে। তারা এক একটি বলে নানা তারিখ লিখে দেন। কোন বল লটারির মতো বেছে নেওয়া হয়, এতে লেখা সেই তারিখে জন্মগ্রহণ করা মানুষটিই শুধু টিকা পাবে।

এ যেন জীবন-মৃত্যু নিয়ে দারুণ এক জুয়া খেলা।

কেউ কেউ এ নিয়ম মানতে চান না। তাই বলপ্রয়োগ লুটপাট ও অপহরণের ঘটনা ঘটতে থাকে। তারা ফেস মাস্ক পরে অস্ত্র হাতে সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত বাসায় অনুপ্রবেশ করে ও টিকা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। সামাজিক বিশৃঙ্খলা হলো চলচ্চিত্রে সেই ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সবচেয়ে বড় সমস্যা।

চলচ্চিত্র শেষে দেখা যায়, টিকা ব্যাপকভাবে উত্পাদিত হয়েছে। মানবজাতি যেন ভবিষ্যতের আশা দেখতে পায়। তবে সে মুহূর্তে দৃশ্য হঠাত্ করে বদলে যায়। ভাইরাসের উত্সের দিকে দৃষ্টি ঘুরে যায়। মানুষ গাছপালা কাটে এবং বাদুরের বাসস্থান নষ্ট করে ফেলে। বাদুর আশেপাশের শূকর খামারে বাস করতে বাধ্য হয়। তাদের খাওয়া ফল শূকর খামারের মাটিতে পড়ে যায়। শূকর সেসব ফল খায়। তারপর সেসব শূকর বাজারে আসে ও মানুষের সংস্পর্শে আসে। মানুষ সেসব শূকরের মাংস খায়। ভাইরাস সংক্রমিত এক টুকরা মাংস রেস্তোরাঁয় আসে। চলচ্চিত্রের শুরুতে দেখানো সেই কোম্পানির সিনিয়র কর্মী রেস্তোরাঁর প্রধান পাচকের সঙ্গে হাত নাড়াচাড়া করার সময় সেই ভাইরাসে আক্রান্ত হন। তারপর সেই ভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

চলচ্চিত্রে এমইভি-১ ভাইরাসের প্রোটোটাইপ হলো ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে মালয়েশিয়ায় দেখা দেওয়া নিপাহ ভাইরাস। ২৫৬জন লোক সে ভাইরাসে আক্রান্ত হন এবং ১০৫জন মারা যান।

চলচ্চিত্রে দেখানো মহামারী মোট ১৩৫ দিন স্থায়ী হয়। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি গুরুতরভাবে প্রভাবিত হয় এবং গোটা দেশ শাটডাউন অবস্থায় পড়ে যায়। বর্তমানে চীন সরকারের প্রচেষ্টায় মহামারী আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। আমরা দেশ পরিচালনার ক্ষমতায় বিশ্বাস করি। তবে আমাদের সতর্ক থাকা উচিত্। প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না-যাওয়া, পার্টিতে অংশ না-নেওয়া, মাস্ক পরা, ঘন ঘন হাত ধোয়া, বাসা বা অফিসে দরজা জানালা খুলে আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

নিজেকে রোগ সংক্রমণ মুক্ত রাখা হলো এখন আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ।

(লিলি/তৌহিদ/শুয়ে)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040