নতুন করোনাভাইরাস ইস্যুতে কথা বলেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত
  2020-02-05 13:00:58  cri


বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি চি মিং ৩ ফেব্রুয়ারি আরটিভিতে 'চায়না ফোকাস' অনুষ্ঠানে একটি সাক্ষাত্কার দেন। সাক্ষাত্কারে তিনি চীনের নতুন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের বিষয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর দেন।

১. নতুন করোনাভাইরাসের সার্বিক অবস্থা কী?

---ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনে নতুন করোনাভাইরাস দেখা দেয়। এরপর, চীন সরকার সময়মতো কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে। অনেক শক্তিশালী ব্যবস্থা নেওয়ার পর, বলা যায়, বর্তমানে মহামারী নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এ ভাইরাস মোকাবেলার বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট আস্থা ও যোগ্যতা আছে। প্রতিদিন মহামারী-সংক্রান্ত খবর পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এ সংখ্যা প্রতিদিন বেড়ে যাচ্ছে। খুশির বিষয় হলো, আমরা গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট দেখতে পাচ্ছি। যারা সুস্থ হয়ে উঠছেন তাদের সংখ্যা প্রাণ হারানো মানুষের চেয়েও বেশি। বর্তমানে ৪ শতাধিক মানুষ মারা গেছে। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে উদ্ভূত এইচ১এন১ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ২ লাখ লোক মারা গেছে। সেই তুলনায় বর্তমান অবস্থা আমাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

২. বর্তমানে বাংলাদেশে চীনাদের মধ্যে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে কেমন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে?

--খুশির বিষয় হলো, এখনও বাংলাদেশে চীনা এবং চীনে বাংলাদেশিদের মধ্যে কেউই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হননি। এটি হলো দুঃখের মধ্যে একটি সুখবর। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের দূতাবাস বাংলাদেশে চীনাদের ভালোভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। নিজেকে ছাড়া, একই কমিউনিটিতে থাকা অন্য বাংলাদেশি বন্ধুদের নিরাপত্তা দেওয়াই এর উদ্দেশ্য। যেমন, মনে করুন বাইরে যাওয়ার সময় মাস্ক পরার কথা মনে করিয়ে দেওয়া এবং ঘন ঘন হাত ধোয়া। বাসা বা অফিসে দরজা জানালা খুলে রেখে আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি, বাংলাদেশে চীনা কোম্পানির কর্মীদের সাময়িক সময়ের জন্য যাতায়াত বন্ধ করার অনুরোধও জানিয়েছি। অর্থাত্, একদিকে বাংলাদেশে চীনের যেসব প্রকল্প আছে, তার কর্মীরা অল্প সময়ের জন্য চীন থেকে আসছেন না; অন্যদিকে বাংলাদেশে থাকা চীনারা দেশে ফিরে যাচ্ছেন না। এভাবে ক্রস সংক্রমণের হার কমে যাচ্ছে। আমাদের নেওয়া এসব ব্যবস্থা এখন কার্যকর হচ্ছে বলে আমরা মনে করি।

৩. মহামারী শুরুর পর চীন সরকার কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে?

---মহামারী শুরুর পর চীন সরকারের ব্যবস্থা কয়েকটি শব্দ দিয়ে বলা যায়। তা হলো দ্রুত, সময়মতো, প্রকাশ্য, স্বচ্ছ, দৃঢ় ও শক্তিশালী পদক্ষেপ। মহামারী শুরুর পর চীনের বিজ্ঞানীরা সময়মতো ভাইরাসকে বিচ্ছিন্ন করার কাজ করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু'র সঙ্গে প্রকাশ্যে সহযোগিতা করেছেন এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে তথ্য ভাগাভাগি করেছেন। হু'র অভিজ্ঞতা অনুযায়ী আমাদের দেশের কাজ খুব দ্রুত ও বিস্ময়কর। মহামারীর পর সব গবেষণার ফলাফল সর্বপ্রথম ইন্টারনেট ও বিশ্বের প্রথম শ্রেণীর একাডেমিক জার্নালের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত প্রকাশিত হয়। যা অনেক সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থার সমর্থন পায় এবং খুব ভালো ফলাফলও অর্জন করে। চীনের উহান শহর হলো ভাইরাস-জনিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং দেড় কোটি লোক আছে। ভাইরাস ঠেকাতে 'শহর অবরোধ করা' বা উহান থেকে বের হওয়ার সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। জনবহুল এত বড় একটি শহরে এই ব্যবস্থা নেওয়া মানবজাতির ইতিহাসে আগে কখনও হয়নি। দেখা যায়,আমাদের ব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে, চীনের ব্যবস্থা সবচেয়ে সার্বিক ও কঠোর এবং যা আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ও মহামারী প্রতিরোধের নিয়মাবলীর নিয়ম ছাড়িয়ে যায়। মহামারী প্রতিরোধে চীনের ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক সমাজে নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে। তাই আমি বাংলাদেশের বন্ধুদের চিন্তামুক্ত থাকতে বলব। এ ব্যাপারে চীন খুব দায়িত্বশীল। বসন্ত উত্সবের পর প্রথম দিন সিপিসি'র পলিট ব্যুরোর স্থায়ী কমিটির সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। এই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী লি খ্য ছিয়াংকে মহামারী প্রতিরোধবিষয়ক জাতীয় গ্রুপের নেতা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তিনি নিজ উদ্যোগে মহামারী প্রতিরোধের ফ্রন্টে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে প্রাদেশিক পর্যায় পর্যন্ত সম্পূর্ণ ও বহুমুখী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। বর্তমানে এ ব্যবস্থা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে।

৪. ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য তৈরি বিশেষ  হাসপাতাল নির্মাণের অবস্থা একটু বলুন।

--হুওশেনশান হাসপাতালের নির্মাণকাজ ২৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় এবং ২ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে হাসপাতালটি ব্যবহার শুরু হয়। চীন থেকে হাসপাতাল নির্মাণ প্রক্রিয়া সরাসরি ইন্টারনেটে দেখানো হয়। অনেক মানুষ ইন্টারনেটের মাধ্যমে তা দেখেছেন। আমরাও অনেক বিস্মিত। এত অল্পসময়ের মধ্যে উঁচু ভবন নির্মাণের পাশাপাশি,ভেতরে নানা সাজসরঞ্জাম ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জামসহ বিভিন্ন সামগ্রীও রয়েছে। এটি খুব আশ্চর্যজনক ও গৌরবের বিষয়। এটা দেখে আমাদের ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আত্মবিশ্বাস আরও জোরালো হয়েছে।

৫. আকস্মিক মহামারী মোকাবিলায় অনেক চিকিত্সক ও নার্সের প্রয়োজন, তারা কোথা থেকে এসেছেন?

--এটি হলো চীনের নিজস্ব ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সুবিধা। বর্তমানে উহানের অনেক হাসপাতালের চিকিৎসক হুপেই প্রদেশের বাইরে থেকে এসেছেন। তারা বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবক চিকিৎসক ও নার্স। দেশের প্রয়োজন হলে বিভিন্ন প্রদেশের চিকিৎসক ও নার্স পৃথকভাবে কাজের জন্য নাম লেখান। আপাতত ৭৫০০ চিকিৎসক ও নার্স উহানে আছেন। তাদের মধ্যে ৬ হাজার বেসামরিক হাসপাতাল এবং অন্য ১৫০০জন বাহিনীর হাসপাতাল থেকে এসেছেন। বলা যায়, বর্তমানে উহানে চিকিৎসক ও নার্স যথেষ্ট রয়েছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হলো চীনের একটি বড় সুবিধা। চীনের সব শক্তি একযোগে কাজ করতে পারে। এবারের মহামারী মোকাবেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাধান্য হলো ২০০৩ সালে সার্সের অভিজ্ঞতা গ্রহণ। তৃতীয় বৃহত্তম সুবিধা হলো গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৭০ বছরের মধ্যে তুলনামূলক সমৃদ্ধ উপাদানের ভিত্তি ও উত্পাদন ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের ৪০ বছরে সম্পদ ও সামগ্রী জড়ো করার দক্ষতা আগের চেয়ে বেড়েছে। তাই ভাইরাসের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার যথেষ্ট ক্ষমতা আছে।

৬. উহান 'শহর ব্লক করা ' প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য।

---উহান অবরোধ করা মানে উহান থেকে যাতায়াতকারী পাবলিক যানবাহন, যেমন: বিমান, রেলগাড়ি ও বাস সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে। তবে প্রয়োজন হলে বহিঃর্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব। আমরা শুধু উহানবাসীকে উহান ত্যাগ না করার আহ্বান জানিয়েছি। তাদের দৈনন্দিন জীবন নিশ্চিত করা হয়েছে। আমি উহান থেকে খুব দূরের ইউননান প্রদেশ থেকে এসেছি। আমার এক বন্ধু বেগুন চাষ করেন। তিনি সম্প্রতি নিজের চাষ করা বেগুন উহানে সরবরাহ করেছেন। আমি অন্য একটি খবর পড়েছি। হাইনান প্রদেশে মটরশুঁটি চাষ করা একজন কৃষক ১৫ টন মটরশুঁটি উহানে পাঠিয়েছেন। তিনি বলেন, সবচেয়ে ভালো মটরশুঁটি পাঠিয়ে উহানের লোকদের সান্ত্বনা দিতে চান তিনি। উহানবাসী প্রতিদিন ইন্টারনেট ব্যবহার করছে ও টিভি দেখছে। তাদের বাইরে না যেতে উত্সাহ দেওয়া হয়েছে। এই শহর ত্যাগ না করায় আরও অনেকের স্বাস্থ্য নিশ্চিত হয়েছে।

৭. বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আপনি চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের জন্য অনেক কাজ করেছেন। এ মহামারী আপনার কাছে একটি চ্যালেঞ্জ। আপনি বাংলাদেশের মানুষকে এ বিষয়ে কী বলতে চান?

---এই সুযোগে আমি বাংলাদেশের বন্ধুদের বলতে চাই যে,বিশ্বাস করুন, এবারের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে চীন সরকার ও জনগণের সম্পূর্ণ আস্থা,দক্ষতা ও সম্পদ আছে। কারণ, চীনের বিশেষ রাজনৈতিক প্রাধান্য আছে, মূল্যবান অভিজ্ঞতা আছে, আছে যথেষ্ট সামগ্রী। সঙ্গে সঙ্গে আমি বাংলাদেশের জনগণকে কিছু অনুরোধও জানাতে চাই।

আমি আশা করি,বাংলাদেশের বিভিন্ন মহল ভুল খবরে কান দেবে না ও নেতিবাচক বিষয় নিয়ে অপ্রয়োজনীয় আতঙ্ক ছড়াবে না। গুজব বিশ্বাস ও প্রচার না করে, অপ্রয়োজনীয় নীতি ও ব্যবস্থা জারি না করে,একযোগে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ মহামারী প্রতিরোধ করা যাবে বলে আমি আশা করি।

৮. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে রাষ্ট্রদূত বলেন :

---আমি এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব তেদ্রোস আধানোমের ভাষণের উদ্ধৃতি দিয়েছি। তিনি বলেছেন,চীন সরকারের প্রচেষ্টা না থাকলে এখন চীনে আরো বেশি সংক্রমণ তথা মৃত্যু দেখা যেত। বস্তুত ভাইরাস মোকাবিলার ক্ষেত্রে অনেক দিকে চীন নতুন আদর্শ স্থাপন করেছে। চীনে যে ঘটনা ঘটছে তার কারণে এই বিবৃতি নয়; বরং অন্য দেশে যেসব ঘটনা ঘটছে সে কারণে এই বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। এই বিবৃতিটি চীনের প্রতি অবিশ্বাস নয়; বরং চীনের মহামারী নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরবচ্ছিন্ন আস্থার বহিঃপ্রকাশ।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040