গত বছর ১১ নভেম্বর আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার মামলাটি দায়ের করে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। বাংলাদেশ, কানাডা ও জার্মানি এতে সমর্থন দেয়। গত ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর এই মামলায় প্রাথমিক শুনানি হয়। গাম্বিয়ার পক্ষে সে দেশের আইনমন্ত্রী আবু বকর মারি তামবাদু শুনানি করেন। আর মিয়ানমারের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন খোদ দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি। গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী আদেশ প্রার্থনা করেন। আর অং সান সুচি আইসিজে'র বিচারের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে মামলাটি খারিজের আবেদন জানান। ২৩ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী আদেশের জন্য দিন ধার্য করে আইসিজে।
তারই ধারাবাহিকতায় আইসিজে গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্বর্তী আদেশ দেয়। আদালতের বিচারক কোয়াই আহমেদ ইউসুফ আদালতের অন্তর্বর্তী আদেশ পড়ে শোনান। মামলা খারিজের জন্য মিয়ানমারের আবেদন আদালত নাকচ করে দেয়- অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ শুনানি হবে গণহত্যা মামলাটির ওপর। এছাড়া মিয়ানমারের জন্য পালনীয় চারটি সুনির্দিষ্ট আদেশ দেয় আদালত।
এক. জাতিসংঘ কনভেনশন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দিতে হবে।
দুই. গণহত্যার প্রমাণ ধ্বংস করা যাবে না।
তিন. সশস্ত্রবাহিনী আর কোনো গণহত্যা চালাতে পারবে না।
চার. ৪ মাস পর মিয়ানমারকে আদালতের আদেশ প্রতিপালনের বিষয়ে রিপোর্ট দিতে হবে। এর পর মামলার চূড়[ন্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত প্রতি ৬ মাস পরপর এ রিপোর্ট দিতে হবে।
আইসিজে জানায়, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব পুরোপুরি মিয়ানমারের। রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা নিশ্চিতে মিয়ানমারের অনীহা রয়েছে বলেও জানায় আদালত। এখন পর্যন্ত পাওয়া আলামতে রোহিঙ্গারা হত্যা, ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে বলে আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এতে গাম্বিয়ার মামলার যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়েছে। এ জন্য মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও তাদের নির্দেশ দাতাদের দায়ী করেছে আদালত।
আদালতের এ অন্তর্বর্তী আদেশকে একটি শুভ সূচনা হিসেবে অভিহিত করেন গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী আবু বকর মারি তামাদু। রায়ের পর এক প্রতিক্রিয়ায় সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ইন্টার ন্যাশনাল কমিশন ফর জুরিস্টের মহাসচিব স্যাম জারিফি বলেন, গণহত্যা সনদের আওতায় এ রায় মেনে চলা মিয়ানমারের জন্য বাধ্যতামূলক। নিউইয়র্কভিত্তিক গ্লোবাল জাস্টিস সেন্টারের সভাপতি অখিলা রাধাকৃঞ্চাণ বলেছেন, তুচ্ছ অজুহাত যে গ্রহণযোগ্য নয়, সে বিষয়ে মিয়ানমারকে একটি জোরালো সংকেত দিয়েছে আইসিজে। রোহিঙ্গারা যে এখনো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সি বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করতেও ভোলেনি আদালত।
বাংলাদেশ সরকারও এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, রোহিঙ্গা গণহত্যার দায় মিয়ানমারকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। আর রায়কে স্বাগত জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, এটি মানবতার জয়, বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারকর্মীদের জন্য একটি মাইলফলক।
এদিকে, এরই মধ্যে আইসিজের আদেশ প্রত্যাখ্যান করেছে মিয়ানমার। দেশটি বলেছে আদালতে অনেকগুলো আদেশের বিষয়ে তারা আগেই ব্যবস্থা নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসীন মনে করেন, মিয়ানমার যতই প্রত্যাখ্যানের চেষ্টা করুক এ ইস্যুতে সহসাই পার পাবে না তারা। আইসিজের এ আদেশকে সামনে রেখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ সকল সংকট সমাধানে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক তৎপরতা আরো জোরদারে করতে পরামর্শ কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের।
ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।