দেশের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় স্থানে যৌবনের গল্প তৈরি করবো—গণকল্যাণমূলক কাজে অবদানকারী তরুণ-তরুণীদের স্বপ্ন
  2020-01-10 15:19:54  cri

সম্প্রতি বেইজিংয়ে চীনের প্রচার মন্ত্রণালয়, চীনের মানবসম্পদ ও সামাজিক নিশ্চয়তা মন্ত্রণালয় ২০১৯ সালে 'বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সুন্দর স্নাতক শিক্ষার্থীদের' পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান আয়োজন করে। তাদের প্রত্যেকের পেছনে মনোমুগ্ধকর গল্প আছে। তারা সবাই সাধারণ ছাত্রছাত্রী, কিন্তু তরুণ বয়সেই তারা নিজ জীবনের জন্য অসাধারণ লক্ষ্য নির্ধারণ করেন এবং বিশেষ করে গণকল্যাণমূলক কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা নিজেদের অসাধারণ আচরণের মাধ্যমে নিজের যৌবনকে আরও সুন্দরভাবে গড়ে তুলেছেন। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা কয়েকজন পুরস্কার অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের গল্প আপনাদের কাছে তুলে ধরবো।

১. সমুদ্রের ছোট দ্বীপে থাকা জনস্বাস্থ্য রক্ষাকারী

চীনের শানতুং প্রদেশের ছাংতাও জেলার সিয়াও ছিন দ্বীপটি তীর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূর সমুদ্রে অবস্থিত। এর আয়তন মাত্র ১.১৪ বর্গকিলোমিটার। ওয়াং হুই এই দ্বীপে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ১১টি বছর কাটিয়েছেন।

২০০৮ সালে ওয়াং হুই শানতুং প্রদেশের চীনের ঐতিহ্যবাহী ওষুধ ও চিকিত্সা উচ্চ বিদ্যালয়ের চীনের ঐতিহ্যবাহী চিকিত্সা বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ওয়াং হুই চীনের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি কেন্দ্রীয় চীন সরকারের 'তৃণমূল পর্যায়ে গিয়ে জনসাধারণকে সাহায্য করার' আহ্বানের সাড়া দিয়ে শানতুং প্রদেশে চলে যান।

তিনি সিয়াও ছিন দ্বীপের চিকিত্সাকেন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবক; এমনকি, পুরো চিকিত্সা কেন্দ্রের একমাত্র চিকিত্সক। তিনি দ্বীপের কঠিন জীবনকে হার মানিয়েছেন। ওয়াং হুই ওই দ্বীপের নয় শতাধিক মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য কাজ করেন।

রোগীর চাহিদা থাকলে ওয়াং হুই ২৪ ঘণ্টা সেবা দেন। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওয়াং হুই-এর কাজের মেয়াদ শেষ হয়। তবে স্থানীয় জনগণের চাহিদা মাথায় রেখে তিনি আরও তিন বছর কাজ করেন। ২০১৪ সালে ওয়াং হুই দ্বীপটির চিকিত্সাকেন্দ্রের কর্মী হন এবং এখন তিনি এই দ্বীপকে তার দ্বিতীয় মাতৃভূমি হিসেবে মনে করেন। তিনি অব্যাহতভাবে দ্বীপের মানুষগুলোকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

২. যৌবন ও অনুরাগ দিয়ে চীনের উত্তরাঞ্চলকে উষ্ণ করেছেন যে নারী

চীনের উত্তরাঞ্চলের হেই লোং চিয়াং প্রদেশের মো হ্য শহরের বেইজি থানা হলো চীনের সবচেয়ে উঁচু অক্ষাংশ এবং সবচেয়ে উত্তরে অবস্থিত ছোট একটি থানা। বছরে এখানকার গড় তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বলা যায়, থানাটি খুব রুক্ষ ও ঠান্ডা এক জায়গা। ওয়েন জু নামে একজন তরুণী সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির বেইজি থানার প্রচারকর্মী হিসেবে কাজ করতেন।

চীনে একটি খুব প্রচলিত কবিতা আছে: 'কেন আমার চোখে সবসময় অশ্রু থাকে? কারণ, আমি এই ভূমিকে গভীরভাবে ভালোবাসি'। ওয়েন জু এই কবিতা খুব পছন্দ করেন। ২০১৩ সালের অগাস্ট মাসে ওয়েন জু মুতান জিয়াং নর্মাল ইন্সটিটিউট থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি তখন চীনের বাণিজ্য মহলের শীর্ষ কোম্পানি আলিবাবার সঙ্গে কাজের সুযোগ পান। তবে নিজের জন্মস্থানকে আরও সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য তিনি সেই সুযোগ ছেড়ে দেন। তিনি মো হ্য শহরের বেইজি থানায় কাজ করতে চলে যান।

ওয়েন জুর মনে অনেক দৃঢ়তা আছে। তিনি বলেন, যত কঠিনই হোক না কেন, তিনি সেখানে ভালোভাবে কাজ করবেন ও অবদান রাখবেন। তাঁর কাজের ক্ষেত্র বেইজিং থানার লুও কু হ্য গ্রাম হেই লুং নদীর উৎসস্থলে অবস্থিত। সেখানকার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল, কোনো বাস যাতায়াত করে না। শীতকালে সেখানে প্রচুর তুষার পড়ে এবং এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। আর তুষারপাতের পর পুরো গ্রামের সঙ্গে বাইরের জগতের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমন কঠিন পরিবেশ যেখানে, সেখানে ওয়েন জু' 'যৌবনের স্বপ্ন' গাঁথা শুরু করেন।

স্থানীয় মানুষের জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য ওয়েন জু স্থানীয় লোকদের নিয়ে শিল্পীদল গঠন করেন। স্থানীয় বাহিনী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে বিনিময় ও যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ করার জন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজন করতেন তিনি। এ ছাড়া ওয়েন জু স্থানীয় পারিবারিক হোটেল ও পর্যটন সংস্থার জন্য অনলাইনে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও সহায়তা করেন। ওয়েন জু'র চেষ্টায় লুও কু হ্য গ্রামটি আগের নিভৃত এক পল্লী থেকে প্রাদেশিক পর্যায়ের সভ্য গ্রাম ও দৃষ্টান্তমূলক গ্রামে পরিণত হয়।

৩. জাতীয় ঐক্য জোরদারে ভূমিকা রাখা তাই তুং ইউয়ান

তাই তুং ইউয়ান চীনের সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের আ খ্য সু এলাকার খু চে জেলার আলাহাক্য থানার কমিউনিস্ট পার্টি শাখার উপ-সম্পাদক।

তাই তুং ইউয়ান চীনের সেন্ট্রাল সাউথ ইউনিভার্সিটির খনি ও প্রকৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ২০১২ সালে চীনের তৃণমূল পর্যায়ের সরকারি কর্মী পরীক্ষায় তিনি শ্রেষ্ঠ ফলাফল নিয়ে সিনচিয়াং-এর খু চে জেলায় কর্মী হিসেবে কাজ করা শুরু করেন।

আলাহাক্য থানা খু চে জেলা থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। থানায় ২৫টি জেলা আছে, জনসংখ্যা ৪৫.৬ হাজার। কাজ শুরুর পর প্রথম মাসে তাই তুং ইউয়ান পুরো থানার সবগুলো অর্থাৎ ২৫টি গ্রাম পরিদর্শন করেন। তিনি নিয়মিত গ্রামে গিয়ে খোঁজখবর নেন ও অল্প সময়ের মধ্যে পুরো থানার মৌলিক অবস্থা জানতে পারেন।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, সিনচিয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের কর্মী নির্বাচন পরীক্ষায় অংশ নেন তাই তুং ইউয়ান, তিনি শ্রেষ্ঠ ফলাফল নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল সরকারে কাজ করার সুযোগ পান। তবে, চার মাস পর তিনি সবাইকে অবাক করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেন। তিনি আবারও দূরবর্তী আলাহাক্য থানায় ফিরে যেতে চান, যেখানে তিনি ৫ বছর ধরে পরিশ্রম করেছেন। তিনি অব্যাহতভাবে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষকে সেবা দেবেন। তিনি অব্যাহতভাবে জাতীয় ঐক্য জোরদারের জন্য চেষ্টা করছেন এবং অবদান রাখছেন, তিনি বিভিন্ন জাতির মানুষের ভালোবাসা ও স্বীকৃতি লাভ করেছেন।

৪. তৃণমূল পর্যায়ের বন খামারে ফুটেছে যৌবনের পরিশ্রমের ফুল

ভীষণ গরমের সময় হোক, হাড় কাঁপানো শীতকাল হোক, প্রতিদিন সকাল সাতটায় লিউ থিয়ান জিয়াও নিশ্চয়ই বন খামার পরিদর্শন করবেন, অগ্নি ঝুঁকি পরীক্ষা করবেন এবং সবাইকে বন অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধের বিষয়ে জ্ঞান দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাসের পর লিউ থিয়ান জিয়াও বড় বড় শহরের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের স্থিতিশীল ও ভালো বেতনের চাকরির সুযোগ ছেড়ে নিজের জন্মস্থানের বন খামার স্টেশনে কাজ করা শুরু করেন এবং গহীন পাহাড়ের বনরক্ষীর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন।

'তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করবো' এমন চিন্তাধারা নিয়ে ২০১০ সালের জুলাই মাসে লিউ থিয়ান জিয়াও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাসের পর কুয়াংতুং প্রদেশে ২০১০ সালে স্নাতক ছাত্রছাত্রীদের জন্য আয়োজিত 'তৃণমূল পর্যায়ের সরকারি কর্মীর পরীক্ষায়' অংশ নেন এবং ভালো ফলাফল লাভ করেন। এরপর তিনি জন্মস্থানের বন খামার স্টেশনে চলে যান।

খাড়া ও বিপজ্জনক পাহাড়ি পথে হাটতে হাটতে এক বছরে লিউ থিয়ান জিয়াও-এর ছয়টি জুতা ভেঙে যায়। তাঁর দায়িত্ব হুং সিং বন খামারের সিয়া পা এলাকার ১৩.৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বন এবং পিং শান বন খামারের ৮.৯৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বন। যার প্রতিটি অংশে লিউ থিয়ান জিয়াওয়ের পায়ের ছাপ পড়েছে।

২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে, লিউ থিয়ান জিয়াও আরও কঠিন পরিবেশ ও আরও পাণ্ডববর্জিত হ্য ইউয়ান শহরের পিং শান বন খামারে কাজ করার আবেদন জানান। তিনি যৌবন ও ঘাম দিয়ে বনে জলসেচের ব্যবস্থা করেন। অবশেষে তাঁর যৌবনের পরিশ্রমের ফুল তৃণমূল পর্যায়ের বন খামারে ফোটে। তিনি চীনের কমিউনিস্ট যুবলিগের কুয়াংতুং প্রদেশ শাখার 'শ্রেষ্ঠ যুবক'সহ বিভিন্ন পুরস্কার ও মর্যাদা অর্জন করেন।

৫. দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার পর স্থানীয় লোকজনের সাহায্যকারী।

চীনের ইনারমঙ্গলিয়ার কুখ্যইউছিয়ান জেলা হলো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের দরিদ্র জেলা। এর সঙ্গে জেলাটি একটি সীমান্ত জেলা, সংখ্যালঘু জাতি অধ্যুষিত জেলা এবং বিপ্লবের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এক জেলা। ছি সিয়াও জিং এখানে স্থানীয় গরীব মানুষগুলোকে দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করেন এবং তাদের দারিদ্র্যমুক্ত পথের ভালো অংশীদার হন।

২০০৮ সালে ছি সিয়াও জিং শ্রেষ্ঠ ফলাফল নিয়ে চীনের ইনারমঙ্গলিয়ার বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। স্নাতক পাসের পর তিনি খ্যআরছিন থানায় চাকরিজীবন শুরু করেন। চার বছর তিনি থানার জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে চেষ্টা চালিয়ে যান।

তিনি স্থানীয় কৃষকদের আয় বাড়ানোর জন্য নতুন পদ্ধতি খুঁজে বের করেন। তিনি পারিবারিক কৃষি খামার স্থাপন করেন। যেখান থেকে পর্যটকরা নিজেরাই ফসল বা ফল তুলতে পারেন, নিজেরা জমি ভাড়া করে শাকসবজি চাষ করতে পারেন। পর্যটকরা স্থানীয় কৃষি জীবন উপভোগ করার পাশাপাশি স্থানীয় কৃষকের বাড়িতে তাজা খাবারও উপভোগ করতে পারেন। এ ছাড়া তিনি অনলাইনে স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য বিক্রি করার ব্যবস্থা করেন। তাঁর সাহায্যে ৪০জনেরও বেশি কৃষকের ভালো কর্মসংস্থান হয়। শতাধিক কৃষক পরিবার প্রতি বছর আরও ২০ হাজার ইউয়ান বাড়তি আয় করতে সক্ষম হয়।

২০১৯ সালে চি সিয়াও জিং ১৩৬টি গরীব পরিবারকে সাহায্য করেন, তাদের আয় বৃদ্ধিতে সাহায্য করা এবং গরীব মানুষের জীবনকে সুন্দর করার ক্ষেত্রে আস্থা বাড়ানো ছি সিয়াও জিং-এর মূল লক্ষ্য। তিনি বলেন, গ্রামের কৃষকরা আমাকে বিশ্বাস করে এটি আমার কাছে খুব তৃপ্তির ব্যাপার। যদি আমাকে আরেকবার কাজ বাছাই করার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে আমি নিশ্চয়ই আবারও এখানে ফিরে আসবো।

(শুয়েই/তৌহিদ)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040