'বিং শু' নামে একজন চীনা ভ্লগার এবং সিরিয়া প্রসঙ্গে তার ধারাবাহিক ভিডিও অনুষ্ঠান
  2020-01-09 14:28:15  cri

বর্তমানে মিডিয়ার গতি দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে।

সাম্প্রতিক দিনগুলোতে 'উই-মিডিয়া' এই নতুন শব্দটি জনসাধারণের মধ্যে ক্রমশই পরিচিত হয়ে উঠছে।

'উই-মিডিয়া' মানে- জনসাধারণ ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন পদ্ধতিতে তাদের নিজেদের জীবনের ঘটনা ও খবরাখবর প্রচার করা। বৈশ্বিক জ্ঞান ব্যবস্থার সঙ্গে ডিজিটাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংযুক্ত করার পর জনসাধারণ অন্যদের সঙ্গে তাদের ঘটনা ও সংবাদ বা খবর প্রচার করে থাকে 'উই-মিডিয়ার' মাধ্যমে। বর্তমান যুগে সবাই 'উই-মিডিয়ার' সুযোগ নিতে পারেন ও মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন।

আজকের আলোছায়া অনুষ্ঠানে আমরা 'উই-মিডিয়ার' প্রতিনিধিত্বকারী, চীনের ইন্টারনেটে জনপ্রিয় এক ভিডিও ভ্লগার এবং তার 'পর্যটন অনুসন্ধান'সংক্রান্ত এক অনুষ্ঠানের সঙ্গে শ্রোতাদের পরিচয় করিয়ে দেবো।

তার নাম চাং চুন।

নেটব্যবহারকারী যারা চাং চুন এবং তার অনুষ্ঠান পছন্দ করেন, তারা তাকে 'বিং শু' বলে ডাকেন। চীনা ভাষায় 'বিং' মানে গোলাকার ফ্ল্যাট কেক, শু মানে চাচা। ভ্লগার হিসেবে কাজ করার আগে তিনি একজন সাংবাদিক ছিলেন। রাশিয়ায় চীনের কেন্দ্রীয় টেলিভিশন কেন্দ্র বা সিসিটিভির চিফ রিপোর্টার ছিলেন তিনি।

সাংবাদিকতার জীবন শেষ করে তিনি চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার হওয়ার চেষ্টা করেন।

'বিং শুর' অনুষ্ঠান প্রধানত সুস্বাদু খাবার নিয়ে তৈরি করা হয়। তার ভিডিওতে দেশি-বিদেশি বৈচিত্র্যময় সুস্বাদু খাবারের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে।

বেশিরভাগ মানুষ মনে করে, 'সুস্বাদু খাবারের' সঙ্গে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান তৈরির একমাত্র উদ্দেশ্য বা মানদণ্ড হলো সৌন্দর্য প্রদর্শন। সাধারণত সাজানো-গোছানো স্টুডিওতে বা রান্নাঘরে, সুন্দর আলোতে সুস্বাদু খাবার তৈরির শুটিং করা হয়। আকর্ষণীয় কোনো উপস্থাপক বসে বসে সুন্দরভাবে সে খাবার খান। এমনটাই হয়, তাইনা? তবে 'বিং শুর' অনুষ্ঠান কিন্তু একেবারেই অন্য রকম! তার ভিডিওতে আমরা দেখতে পাই যে, খাবার খাওয়ার পর তার স্বাদ ভালো হোক বা না-হোক, তার ভ্রু কুঁচকে যায়, চোখে মুখে তার প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এটি কোনো কৃত্রিমতা নয়, বরং একেবারেই স্বাভাবিক অনুভূতি তুলে ধরেন তিনি।

'বিং শু'র' ভিডিওতে খাবার থেকে শুরু করে বৈচিত্র্যময় ও বৈশিষ্ট্যময় স্থানীয় সংস্কৃতিতে বিস্তৃত। তিনি একজন পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের অপরিচিত দেশ ও খাবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আজকের অনুষ্ঠানে 'বিং শুর' ভিডিওয়ের মাধ্যমে শ্রোতাবন্ধুদের পৃথিবীর ইতিহাসের প্রাচীন ভূখণ্ড সিরিয়ায় নিয়ে যাবো আমরা।

সবাই জানেন, মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশে যুদ্ধ চলছে। কর্তৃপক্ষের সহায়তা ছাড়া 'উই-মিডিয়া' নিজের ইচ্ছামতো সেসব অঞ্চলে যাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। সৌভাগ্যের বিষয় হলো 'বিং শু' সুষ্ঠুভাবে সিরিয়ার ভিসা পেয়ে যান। তিনিই হলেন সিরিয়ার কর্তৃপক্ষের ভিসা পাওয়া চীনের প্রথম 'উই-মিডিয়া' ব্যক্তি।

সিরিয়ার ভিসা পাওয়া অনেক কঠিন। 'বিং শু' ও তার গ্রুপ ভালো গুণগত মানসম্পন্ন ভিডিও তৈরির চেষ্টা চালান। শুটিং থেকে শুরু করে সম্পাদনা পর্যন্ত ভিডিওগুলো দারুণ সুন্দর হয়। তবে ভিডিওয়ের প্রধান চরিত্র 'বিং শু' অপরিবর্তিত থেকে যান। তিনি নিজের প্রকৃত চরিত্র বজায় রাখেন।

ভিডিওতে 'বিং শু' খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি, নিজ উদ্যোগে খাবার তৈরির প্রক্রিয়ায় অংশ নেন। তিনি নিজের অংশগ্রহণকে 'গভীর অভিজ্ঞতা' বলে মনে করেন।

ছাগলের দুধ হলো স্থানীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান। স্থানীয় লোকজন ছাগল পালনের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে থাকে।

তাই 'বিং শুর' 'গভীর অভিজ্ঞতা' ছাগলের দুধ দোহন থেকে শুরু হয়। কিন্তু ছাগল 'বিং শু'কে সহযোগিতা করতে চায় না। বারবার চেষ্টার পরও খুব কম দুধ তিনি সংগ্রহ করতে পারেন।

তারপর 'বিং শু' রাস্তায় 'তারতার রস' বিক্রি করেন। এই বিস্ময়কর পানীয় বিক্রির জন্য সিরিয়ায় পেশাদার লোকজন রয়েছে। তাদের বিশেষ আকারের তামার পাত্র ছাড়াও, ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে বিক্রেতারা নাচগান করেন। তবে 'বিং শু' কিছুই করতে পারেন না। তার এই সহজ-সরল বিক্রির চেষ্টায় খুব বেশি বিক্রি হয় নি!

নানা কাজ করার পর অবশেষে 'বিং শু' বুঝতে পারেন যে, হাত দিয়ে কাজ করার তুলনায় খাওয়া-দাওয়া করাই তার জন্য মানানসই।

'বিং শু'র গোলাপের সস, প্যানকেকস, চকলেটসহ নানা সুস্বাদু খাবার খাওয়ার দৃশ্য ভিডিওতে দেখে দর্শকরা অনেক মজা পান।

তার ভিডিওতে অনেক সুস্বাদু খাবারের পাশাপাশি আমরা আরও দেখতে পাই সিরিয়ার ভূমিতে মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে।

ভিডিওতে 'বিং শু' একদিন স্থানীয় অনাথাশ্রমের শিশুদের জন্য রান্না করেন।

মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ঘন ঘন যুদ্ধের ফলে লোকজন প্রায়শই গৃহহারা হয়ে যান।

হয়তো কেউ কিছু শাকসবজি কিনতে বাইরে গেলেন, হয়তো হঠাত্ একটি বোমা আকাশ থেকে পড়ল! বোমার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত আহত ও পঙ্গু হয়ে গেলেন তিনি। হয়তো মৃত্যু অথবা বেঁচে থাকলে, বাকি জীবন পঙ্গু হয়ে কাটাতে বাধ্য!

হয়তো কোনো এক মা যখন স্কুলের দরজার সামনে নিজের সন্তানের জন্য অপেক্ষা করছেন; তখন আরেকটি আকস্মিক বোমার আঘাতে সেই মা মারা যান! চোখের সামনে মা'র মৃত্যু দেখে স্বাভাবিক মানসিক অবস্থা হারিয়ে ফেলে সেই সন্তান। এমন ঘটনা প্রায়শই ঘটে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে।

যখন 'বিং শু' অনাথাশ্রমে শুটিং করছিলেন, তখন একটি ছোট মেয়ে তাকে জিজ্ঞাস করেন, আপনি কি আমাকে গ্রহণ করতে পারেন?

যুদ্ধের মধ্যে জীবনযাপন করা এসব শিশু হরহামেশা হুমকি ও ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। তাদের একমাত্র ইচ্ছা নিশ্চিন্তে প্রতিদিন তিন বেলা খাবার খাওয়া!

'বিং শুর' ভিডিও দেখার পর আমাদের কী করা উচিত তা ভেবে পাই না! সর্বগ্রাসী যুদ্ধের বিরুদ্ধে পাল্টা জবাব কী হতে পারে! প্রত্যাশা একটাই, যুদ্ধ বন্ধ হোক, ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ হোক এবং মানুষ শান্তিতে জীবন কাটাক।

ধারাবাহিক যুদ্ধ ও মৃত্যুর কারণে মধ্যপ্রাচ্যে লোকসংখ্যা বিপুলভাবে কমে যাচ্ছে।

ভিডিওতে আমরা দেখতে পাই, এক বৃদ্ধের ৮ হেক্টর আয়তনের জমিতে গোলাপ ফুলের চাষ করা হয়। সেখানে খাঁটি দামেস্ক গোলাপ রোপণ করছেন তিনি।

লোকবলের অভাব বলে গোলাপ বাগানে ফুল চাষ অনেকটা হ্রাস পায়। তার পরও সেই বৃদ্ধ হাল ছেড়ে দেন নি। তিনি প্রাচীন পদ্ধতিতে গোলাপ চাষে লেগে থাকেন। তিনি আশা করেন, সিরিয়ায় যুদ্ধ শেষ হলে আরও অনেক তরুণ-তরুণী সেখানে কাজ করবেন এবং সিরিয়ার অর্থনীতি পুনরায় উজ্জীবিত করবেন।

'বিং শুর' ভিডিওতে আমরা সিরিয়ার যে যে বিষয়গুলো দেখেছি সেগুলো প্রধান গণমাধ্যমগুলোতে খুব কমই দেখা যায়।

শুধু হামলা ও যুদ্ধে ভরপুর সিরিয়া নয়, আমরা সিরিয়ার বাজারে বিক্রেতাদের পণ্য বিক্রির কণ্ঠ শুনেছি, তাদের নাচগান উপভোগ করেছি এবং গোলাপ বাগান ও ছাগলের দুধ দোহন দেখেছি। আমরা দেখেছি সিরীয় জনগণের প্রকৃত সরল জীবন।

আমাদের কাছে শান্তিতে বাস করার গল্প শুধু প্রবীণ মানুষের মুখে শোনা গল্প। যুদ্ধ হলো আমাদের পাঠ্যবইয়ে উল্লেখ করা ঘটনা, আমাদের বাস্তব জীবন।

প্রকৃত বাস্তবতা হলো, এই বিশ্বে পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ কোনো সময় নেই। তবে, কিছু শান্তিপূর্ণ দেশ আছে।

যখন আমরা বিছানায় টিভি দেখছি, তখন অনেকে যুদ্ধের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যাচ্ছেন অজানা গন্তব্যে।

'বিং শুর' ভিডিওয়ের শেষে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের দ্য টেমপেস্ট নাটকের একটি কথা উল্লেখ করা হয়, তা হলো: What's past is prologue, অতীত হলো তামাশা! আশা করি, মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ যেসব যন্ত্রণা ভোগ করেছে বা করছে, তা ভবিষ্যতে মিথ্যা হয়ে যাবে।

শান্তিতে বসবাসের জন্য আমরা কী করতে পারি?

শান্তিপূর্ণ দেশে বসবাস করলেও কখনও যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা ভুলে যাবো না। (লিলি/তৌহিদ)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040