ভোর ছয়টায় ম্যাকাওয়ে চীনা গণমুক্তি ফৌজের ইলাহা দা তাইপা শিবিরে সেনারা অনুশীলন করেন। তখন সেনাদের দৌড়ের শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ শোনা যায় না।
আগে শিবিরের কাছাকাছি অনেক বাসিন্দা বসবাস করতেন। তখন ভোরে বাহিনী অনুশীলন ও শরীরচর্চা করার সময় যথাসম্ভব কম শব্দ করার চেষ্টা করতো। ম্যাকাওয়ে চীনা গণমুক্তি ফৌজের পদাতিক কোম্পানির লুও থাও বলেন, "ম্যাকাওয়ের বাসিন্দারা রাতে খুবই দেরিতে ঘুমান, সকালেও খুবই দেরিতে ঘুম থেকে ওঠেন। আমরা বাসিন্দাদের বিরক্ত না-করার স্বার্থে ভোরে শান্তভাবে শরীরচর্চা করতাম। সকাল দশটার পর আমরা কন্ঠ উচ্চ করতাম।"
ম্যাকাও মাতৃভূমিতে ফিরে আসার পর ম্যাকাওয়ে চীনা সেনারা ভালভাবে 'মৌলিক আইন' ও 'গ্যারিসন আইন' শেখেন। ২০ বছরে চীনা বাহিনীর প্রায় এক লাখ গাড়ি ও ৩.৭ লাখ সেনা ম্যাকাওয়ে আসা-যাওয়া করেছে। কিন্তু তাদের দ্বারা কোনো নীতি ও নিয়ম এবং ম্যাকাও'র রীতিনীতি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেনি।
২০ বছরে ম্যাকাওয়ে চীনা সেনারা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে গাছ লাগিয়েছে, রক্ত দান করেছে, প্রবীণদের সাহায্য করেছে, যুবসমাজকে ভালোবেসেছে, এবং জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করেছে। এ ছাড়াও তাঁরা ক্যান্টোনিজ ভাষা শিখেছে এবং ম্যাকাওয়ের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জেনেছে।
২০১৭ সালের ২৩ অগাষ্ট ম্যাকাওয়ে সুপার টাইফুন 'থিয়ানগ্যে' আঘাত হানে। সেদিন সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে ম্যাকাওয়ে নির্দেশনা পাওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে এক হাজারেরও বেশি সেনা সবচেয়ে গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছায়। এলাকাটি হলো পুরাতন নগরের বাণিজ্যিক এলাকা। সড়ক সরু। সেনারা তিন দিন ও তিন রাত গরম আবহাওয়ায় বিভিন্ন কঠিন কাজ করে এবং প্রচুর আবর্জনা পরিস্কার করে। সিছুয়ানের সেনা লুও থাও ওয়েনছুয়ান ভয়াবহ ভূমিকম্প দেখেছেন। তখন ভূমিকম্পে উদ্ধারকাজে নিয়োজিত গণমুক্তি ফৌজের সেনারা তাঁর আদর্শ। এ কারণেই তিনি বাহিনীতে যোগ দেন। বর্তমান সেনা হিসেবে তিনি ম্যাকাওয়ের জনগণকে ভালভাবে সেবা করতে চান। তিনি বলেন, "টাইফুনের আঘাতের পর ম্যাকাওয়ের বিভিন্ন সড়কে আবর্জনায় ভরপুর হয়ে ওঠে। আমরা ম্যাকাওয়ের নাগরিকদের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ দিতে চাই। ওয়েনছুয়ান ভয়াবহ ভূমিকম্পে সেনাদের উদ্ধারকাজ আমাদের অনুপ্রাণিত করে। আমার মনে হয়, এটি হলো চীনা সেনাদের দায়িত্ব।"
এবারের টাইফুনের দুর্যোগের পর উদ্ধারকাজের জন্য বাহিনী ২৬০০ জনেরও বেশি সেনা পাঠায়। তাঁরা সফলভাবে ১১টি এলাকায় উদ্ধারকাজের দায়িত্ব পালন করে এবং ১০.৭৬ লাখ বর্গমিটার আয়তনের সড়ক পরিস্কার করে। এটি ছিল হংকং ও ম্যাকাওয়ে বাহিনীর প্রথম বেসামরিক অভিযান। তাদের প্রচেষ্টায় টাইফুনের দ্বিতীয় দিন ভোর পাঁচটার আগে পরিবেশ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়। এর জন্য 'ম্যাকাও ডেইলি' 'এ শহরে ভালবাসা আছে, আপনারা হলেন সবচেয়ে আরাধ্য ব্যক্তি' শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশ করে।
অনেক স্থানীয় বাসিন্দা খাওয়ার পানি, মুখোশ ও ওষুধ সেনাদেরকে সরবরাহ করেন। বাসিন্দা মাদাম লিউ স্যিয়ান বিন তখনকার কথা স্মরণ করে বলেন, "গণমুক্তি ফৌজের সেনারা হলেন আমাদের প্রিয়জন। তাঁরা আমাদের সুরক্ষা দেন, যত্ন নেন। আমরা আগে চলচ্চিত্র ও বইতে দেখেছি, গণমুক্তি ফৌজের সেনারা হলেন জনগণের সেনা। এবারের টাইফুনে উদ্ধারকাজের পর আমি তা বিশ্বাস করি।"
টাইফুনের পর ম্যাকাওয়ের ১.৫ লাখ বাসিন্দা চিঠিতে সাইন দিয়ে গণমুক্তি ফৌজকে ধন্যবাদ জানায়। চিঠিতে তারা লেখেন: ম্যাকাওয়ে গণমুক্তি ফৌজের সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। ম্যাকাওয়ের যুবকরা লেখেন, 'গণমুক্তি ফৌজের সেনাভাইরা, আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানাই।'
'সর্বদা প্রস্তুত' হলো ম্যাকাওয়ে গণমুক্তি ফৌজের বাহিনীর বিগত ২০ বছরের শ্লোগান। বাহিনীর নিশ্চয়তা বিভাগের প্রধান গাও চি জুন হলেন প্রথম দফায় ম্যাকাওয়ে আসা একজন সেনা। তিনি বলেন, টাইফুনের পর সময়মতো উদ্ধারকাজ চালাতে ও শেষ করতে পেরেছে বাহিনী। এর মূল কারণ, এই বাহিনী সবসময় প্রস্তুত থাকে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুবই ভাল। সেজন্য যখন দুর্যোগ ঘটে, তখন আমরা সময়মতো উদ্ধারকাজ শুরু করতে পারি। বিগত ২০ বছর ধরে আমরা সর্বদা প্রস্তুত আছি। আমাদের আছে সাফল্য অর্জন ও জয়ী হবার আত্মবিশ্বাস। যখন ম্যাকাওয়ের জনগণকে সুরক্ষা দিয়ে থাকি। আমরা ম্যাকওয়ের স্থায়ী সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার সমর্থক।"
বিগত ২০ বছরে ম্যাকাওয়ে গণমুক্তি ফৌজ ১৬ বার ব্যারাক খোলার অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। এ ছাড়াও মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১৮ বার সামরিক গ্রীষ্ম শিবির আয়োজন করেছে বাহিনী। গণমুক্তি ফৌজ ৬০টিরও বেশি বিদ্যালয়কে পতাকা উত্তোলনের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সেনা উ ই ছিয়াং বলেন, "আমরা গ্রীষ্মকালীন শিবির আয়োজনের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশপ্রেম ও ম্যাকাওপ্রেম বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা সেনাদের সঙ্গে গভীর মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তোলে।"
২০ বছর ধরে ম্যাকাওয়ে গণমুক্তি ফৌজের সদস্যরা নিজেদের দ্বিতীয় বাড়ি ম্যাকাও ও এর বাসিন্দাদের সুরক্ষা দিয়ে আসছে। মতামত জরিপে বলা হয়, ম্যাকাও'র বাসিন্দাদের মধ্যে ৯৯ শতাংশের বেশি ম্যাকাওতে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর কাজে সন্তুষ্ট। এ হার ১৯৯৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত একইরকম আছে।