তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়া একজন সেনা। তিনি একইসঙ্গে দারিদ্র্যবিমোচন কাজে জড়িত একজন কর্মকর্তা। কাজ এবং জীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি ব্যস্ত থাকেন। তাঁর নাম থান ছাও থিং।
আরও একজন রয়েছেন; তিনি উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক; তাঁর রয়েছে ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগ! তাঁর শেষ মেয়াদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের জন্য তিন বছরে তিনি একটি ক্লাসও ছুটি নেন নি। তাঁর নাম তাই সিয়াও তুং।
জীবনের শেষ মুহূর্তে, কেউ জীবনের সুনাম বা স্বার্থ ছেড়ে দিতে চায় না, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অবদান রেখে যায়। থান ছাও থিং ও তাই সিয়াও তুং এক দম্পতি। তারা হাতে হাত রেখে যৌথভাবে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করেন, নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন এবং অসাধারণ উদাহরণ সৃষ্টি করেন।
হাতে হাত রেখে দম্পতির রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করা:
থান ছাও থিং, চীনের হুনান প্রদেশের লৌতি শহরের শুয়াং ফেং জেলার বাজার নির্মাণ ও পরিচালনা কার্যালয়ের কুয়াংহুই গ্রামের দারিদ্র্যবিমোচন কর্মদলের প্রধান। তাঁর স্ত্রী তাই সিয়াও তুং, ৪৫ বছর বয়সে মারা যান। তিনি শুয়াং ফেং জেলার প্রথম উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন।
২০১৫ সালের গ্রীষ্মকালের ছুটিতে, তাই সিয়াও তুং-এর কিছুটা অসুস্থ বোধ হয়। হাসপাতালে চিকিত্সার পর তাঁর ডিম্বকোষে রোগ সনাক্ত করা হয়। তারপর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাঁর ডিম্বকোষ কেটে বাদ দেয়া হয়। আবার ২০১৬ সালের সময় তাই-এর মলদ্বার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। তখন ক্যান্সার তাঁর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে।
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দম্পতি দু'জন কিছুই করতে পারেন না। তাঁরা জানেন যে কোনো মুহূর্তে জীবন চলে যাবে। তাহলে জীবনের শেষ সময় কি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে এবং অন্যের করুণা নিয়ে শেষ সময় কাটাতে হবে, নাকি, নিজের প্রিয় শিক্ষকতার কাজে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জড়িয়ে থাকবেন? স্ত্রী তাই বলেন, আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে, আমি মর্যাদাপূর্ণভাবে এবং সুন্দরভাবে চলে যাবো।
দম্পতি এই বিষয়ে একমত হয়েছে, আত্মীয়স্বজনকে উদ্বিগ্ন করবেন না, অপরিচিত মানুষের করুণা নেবেন না। নিজের মেয়েকে ছাড়া কাউকেই ক্যান্সারের কথা জানাবেন না, নিজের ভাই বোনকেও কিছুই বলেন নি তাঁরা।
তিন বছর ধরে স্ত্রী তাই সবসময় গায়ে নিকাশী ব্যাগ বা ড্রেনেজ ব্যাগ ঝুলিয়ে ক্লাস নিতেন। গ্রীষ্মকালে তিনি খুব বড় এবং লম্বা স্কার্ট পরতেন। আবহাওয়া ঠান্ডা হলে তিনি কোট পরেন। যাতে অন্যরা তাঁর নিকাশী ব্যাগ দেখতে না পারে। প্রতিবার ক্লাস নেওয়ার আগে তিনি ভালোভাবে নিজকে সাজাতেন, যাতে তাঁর ফ্যাকাশে মুখ বোঝা না যায়। তাঁর স্কুলের নেতা, তাঁর সহকর্মী, তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মনে তাঁর সবসময় খুব আনন্দ, সুস্বাস্থ্য ও হাসিখুশি চেহারা প্রভাব ধরে রাখতে চান তিনি। তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত, কেউই ধারণা করতে পারেন নি, তাই সিয়াও তুং একজন ক্যান্সারের রোগী ছিলেন।
ক্যান্সারের কারণে তাই সিয়াও তুংয়ের অন্ত্রের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, দুই কিডনিও নষ্ট হয়। তাই সিয়াও তুং তাঁর গায়ে নিকাশী ব্যাগ ঝুলিয়ে রাখতেন। স্বামী থান ছাও থিংয়ের যত্নে তাই সিয়াও তুং-এর শরীরে কখনই দুর্গন্ধ পাওয়া যেত না। ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য থান ছাও থিং স্ত্রীর শিরায় ইঞ্জেকশন দেওয়ার পদ্ধতি শিখে নিয়েছিলেন।
তাই সিয়াও তুংয়ের ক্যান্সারে মৃত্যুর খবর শুনে শুয়াং ফেং জেলার বাজার নির্মাণ ও পরিচালনা কার্যালয়ের কর্মীরা খুব দুঃখ পান। শিক্ষক তাই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন, আমরা তা জানতাম না। তাঁকে দেখে মনে হতো তিনি খুব ভালো অবস্থায় আছেন। বোঝা যেতো না যে তিনি মরণঘাতী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। তাঁর স্বামী থান ছাও থিংও সবসময় সৈন্যের মতো দৃঢ় চরিত্র ধরে রেখেছিলেন। যদি আমরা আগে তা জানতাম, তাহলে আমরা থান ছাও থিংকে দূর পাহাড়ে দারিদ্র্যমোচনের কাজে নিয়োগ দিতাম না। তাদেরকে সবসময় একসঙ্গে রাখার ব্যবস্থা করতাম।
গত মে মাসে, শুয়াং ফেং জেলার বাজার নির্মাণ ও পরিচালনা কার্যক্রম জেলার কুয়াং হুই গ্রামে দারিদ্র্য বিমোচনের কাজ শুরু হয়। এই কাজের জন্য খুব দক্ষ একজন কর্মী সেই গ্রামে নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কার্যালয়ের নেতা থান ছাও থিংকে সে কথা জানান। আসলে এমন খবর পেয়ে থান ছাও থিং-এর মনে খুব দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। স্ত্রীর ক্যান্সার হয়েছে, তাই সবসময় জেলার বাইরে গিয়ে অস্ত্রোপচার এবং চিকিত্সা করতে হয়। তাহলে চিকিত্সা করা এবং দারিদ্র্যবিমোচন করার প্রয়োজনীয় সময় নিয়ে কিছুটা টানাপড়েন তৈরি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবে তিনি স্ত্রীর শরীরের অবস্থা কার্যালয়ের কাছে জানাতে চান নি। তার নিজের জন্য অন্যদের বেশি কষ্ট দিতে চান নি।
স্ত্রী তাই সিয়াও তুং এ অবস্থা জেনে স্বামী থান ছাও থিংকে বলেন, এটি খুব তাত্পর্যপূর্ণ এক কাজ। তুমি যাও, আমি তোমার কাজে ঝামেলা তৈরি করতে চাই না। স্ত্রীর সমর্থন পেয়ে থান ছাও থিং দারিদ্র্যবিমোচন কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সে মাসের শেষ দিকে থান ছাও থিং গ্রামে গিয়ে দারিদ্র্যবিমোচনের কাজ শুরু করেন। তিনি দরিদ্র কৃষকদের বাসায় গিয়ে খোঁজ-খবর নেন, গরীব মানুষের জন্য বাড়িঘর পুনর্নির্মাণের আবেদন জানান, গ্রামবাসীর জন্য পানি বিশুদ্ধকরণ ব্যবস্থা স্থাপন করেন, গ্রামের সড়কে আলোর ব্যবস্থা করেন।
থান ছাও থিং কুয়াং হুই গ্রামের সেবা কেন্দ্রের দু'তলার একটি ছোট কক্ষে থাকেন। দারিদ্র্যমোচনের পাশাপাশি ভালোভাবে স্ত্রীর যত্ন নেওয়ার জন্য থান ছাও থিং স্ত্রী তাই সিয়াও তুংকে গ্রামটি বেছে নিয়েছিলেন। কুয়াং হুই গ্রামের প্রধান ওয়াং ওয়েই লিন বলেন, আমি এখন বুঝতে পেরেছি, থান ছাও থিং দারিদ্র্যমোচনের কাজও থামতে চান না, আবার তাঁর স্ত্রীরও যত্ন নিতে হয়। তাই তিনি স্ত্রীকে গ্রামে নিয়ে এসেছেন। তবে আমি কখনই বুঝতে পারিনি যে, তাঁর স্ত্রী একজন ক্যান্সারের রোগী; তিনি প্রতিদিন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন! থান ছাও থিংকে জিজ্ঞেস করলে, তিনি সবসময় বলতেন, স্ত্রীর ঠান্ডা লেগেছে, এটা তেমন কিছু না।
শরীরে রোগ নিয়েও তাই সিয়াও তুং কখনই নিজের কাজ ছেড়ে দেন নি। ২০১৬ সালে তাঁর শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হলেও, তিনি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি স্বামীকে বলেন, এরা আমার শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী; আশা করি তুমি আমাকে সাহায্য করবে।
শিক্ষাদানের কাজে অনেক ব্যস্ত থাকলেও তাই সিয়াও তুং কখনওই অভিযোগ করতেন না। তিনি শিক্ষাদানের পদ্ধতি উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন, সবসময় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার অবস্থা এবং মানসিক অবস্থাকে গুরুত্ব দিতেন। কেউ ক্লাসে ভালোভাবে বুঝতে না পারলে তিনি ছাত্রছাত্রীদের বাসায় নিয়ে শিক্ষা দিতেন। উচ্চ বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের সময় তাই সিয়াও তুং-কে দুই সপ্তাহ পর পর এক বার থেরাপি দিতে হতো। তিনি শুধু সাপ্তাহিক ছুটির দিনে হাসপাতালে যেতেন, থেরাপি দেওয়া অনেক কষ্টকর একটি ব্যাপার, এতে শরীরে অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিত, বিশ্রামের প্রয়োজন হতো। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি একটি ক্লাস থেকেও ছুটি নেন নি।
ধীরে ধীরে তাঁর শারীরিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন না তিনি। শিক্ষক তাই সিয়াও তুং চেয়ারে বসে ক্লাস নিতেন। তিন বছরে তিনি একটি ক্লাস থেকেও ছুটি নেন নি। চলতি বছরের উচ্চ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষায় তাঁর ক্লাসের ৬৫জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ৬০জনই দেশের প্রথম শ্রেণীর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে সক্ষম হয়।
চূড়ান্ত বিদায়
সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে তাই সিয়াও তুং-এর শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে ওঠে। ১২ সেপ্টেম্বর স্কুলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। এরপর তিনি আর ক্লাসে যেতে পারেন না। এসময় তাকে হাসপাতালেই থাকতে হয়। দিনে তাঁর বড় বোন তাঁর যত্ন নেন, রাতের বেলা স্বামী থান ছাও থিং গ্রাম থেকে ফিরে এসে তাঁর যত্ন নেন। স্বামীর কাজে যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য ১৫ নভেম্বর তাই সিয়াও তুং হাসপাতাল ছেড়ে দেন। থান ছাও থিং স্ত্রীকে আরও ভালোভাবে যত্ন নেওয়ার জন্য তাঁকে দারিদ্র্যবিমোচনের গ্রামে নিয়ে যান।
১৯ নভেম্বর, শুয়াং ফেং জেলার বাজার নির্মাণ ও পরিচালনা কার্যালয় দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য এক বড় ধরনের কার্যক্রম আয়োজন করেছে। এই কার্যক্রমের জন্য থান চাও থিং অনেক দিন ধরে প্রস্তুতি নিয়েছেন। তখন তাই সিয়াও তুং-এর শরীর খুব খারাপ অবস্থায় পৌঁছায়। ১৮ তারিখে থান ছাও থিং বাসায় ফিরে স্ত্রীকে বলেন, আগামীকাল আমি এই কার্যক্রমে অংশ নিবো না, ছুটি নিবো, বাসায় তোমার সঙ্গে থাকবো। তাঁর মনে হচ্ছিল, স্ত্রীর সময় বেশি নেই, তিনি স্ত্রীর সঙ্গে থাকতে চান!
তবে, তাই সিয়াও তুং এতে রাজি হন না। তিনি বলেন, তুমি না গেলে এই কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে হবে না। তোমার কোনো চিন্তা করার দরকার নেই। আমি ভালোই আছি। থান ছাও থিং চোখের পানি ফেলে চলে যান; আর এটিই ছিল এই দম্পতির শেষ দেখা।
তাই সিয়াও তুং-এর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে শিক্ষার্থী, সহকর্মী, কৃষকরা এই দম্পতির জীবনের অবিশ্বাস্য মুহূর্তগুলো স্মরণ করেন। তারা কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন নি।
কেউ বলেন, শিক্ষক তাই সিয়াও তুং জানেন যে, আমার শারীরিক অবস্থা ভালো না, তাই প্রতিদিন আমার জন্য ডিম সিদ্ধ করতেন এবং আমার অফিসে রাখতেন।
কেউ বলে, আমার দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য থান ছাও থিং আমাকে অনলাইনে ব্যবসা করার পদ্ধতি শিখিয়েছেন, এখন আমি মোবাইল ফোনে আমার বাসার মুরগি, হাঁস এবং ডিম বিক্রি করতে পারি, আমার আয় অনেক বেড়েছে।
কেউ বলে, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষার জন্য আমি শিক্ষক তাই সিয়াও তুংকে ফোন করে সাহায্য চেয়েছিলাম। ফোনে এক ঘন্টা ধরে কথা বলেছি তাঁর সঙ্গে। পরে আমি জানতে পেরেছি যে, তখন শিক্ষক তাই সিয়াও তুং মাত্র অস্ত্রোপচার করেছেন, তাঁর শরীর ছিল খুব দুর্বল।
স্ত্রী তাই সিয়াও তুং-এর মৃত্যুর পর তাঁর স্বামী থান ছাও থিং অসীম দুঃখে পতিত হন। তবে তাঁর দারিদ্র্যবিমোচনের কাজ শেষ হয়নি। কারণ, এটিই হলো তিনি ও স্ত্রীর সিদ্ধান্ত।