চীনা ডাক্তার উ মিন সিয়ান ও তাঁর ১১ বছরের আফ্রিকান জীবন
  2019-12-25 14:21:55  cri

প্রত্যেক মানুষের জীবনে এমন একটি সময় থাকে, যা তার মনে সবচেয়ে বেশি ছাপ ফেলে। সে-সময়ের কথা তিনি ভুলতে পারেন না। চীনের হ্য নান প্রদেশের শান মেন সিয়া কেন্দ্রীয় হাসপাতালের শল্যচিকিত্সক উ মিন সিয়ানের কাছে সে-সময়টা হচ্ছে আফ্রিকায় তাঁর ১১ বছর।

২০০০ সাল থেকে উ মিন সিয়ান হ্য নান বিদেশে সহায়তা চিকিত্সাদলে যোগ দেন এবং পর্যায়ক্রমে ইরিত্রিয়া, জাম্বিয়া এবং ইথিওপিয়ায় মোট ১১ বছর কাজ করেন। এই ১১ বছরে তিনি কয়েক বার এইডসের ঝুঁকিতে পড়েন এবং অনেক বার ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। কিন্তু তাঁর পেশাদারিত্ব তাকে সেসব ঝুঁকি ও কষ্ট মোকাবিলায় সাহায্য করে।

আফ্রিকার ১১ বছরের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে উ মিন সিয়ান বলেন, "আমি মনে করি, আফ্রিকার মানুষের আমার সাহায্য প্রয়োজন। ওখানে একজন চিকিত্সক হিসেবে আমি নিজের মূল্য অনুভব করতে পারি। রোগীকে চিকিত্সা দেওয়া এবং তাদের প্রাণ রক্ষা করা একজন চিকিত্সকের দায়িত্ব। আমার ক্ষেত্রেও সেটার ব্যতিক্রম ছিল না।"

ছোটবেলায় উ মিন সিয়ান চলচ্চিত্র দেখতে পছন্দ করতেন। একবার তিনি বিদেশে চীনা সহায়তাদলের চিকিত্সকদের ওপর একটি তথ্যচিত্র দেখেন। সেই তথ্যচিত্রে চীনা ডাক্তারদের আফ্রিকান মানুষদেরকে চিকিৎসা দেওয়ার দৃশ্য তাঁর মনে গভীর ছাপ ফেলে। তখন রেডিওতে একটি গানও তার মনে প্রভাব ফেলে। গানের নাম 'চিকিত্সকদল তাঞ্জানিয়ায় এসেছে'। এখনও তিনি এ গানটি গাইতে পছন্দ করেন।

গত শতাব্দীর আশির দশকে, উ মিন সিয়ান সি আন শহরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিত্সাবিদ্যা নিয়ে লেখাপড়া করেন। ওই সময় খুব কম চীনা মানুষ বিদেশে যেতে পারতেন। ইংরেজি ক্লাসে তার একজন শিক্ষক সুদানে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। ওই শিক্ষক সুদানে চীনা সহায়তা চিকিত্সাদলের সঙ্গে পরিচিত হন এবং তিনি তাদের গল্প শিক্ষার্থীদের বলেন। ওই সময় থেকেই উ মিন সিয়ান আফ্রিকায় যাবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।

২০০০ সালে, হ্য নান বিদেশে সহায়তা চিকিত্সাদল প্রথমবারের মতো শান মেন সিয়া শহরে চিকিত্সক নির্বাচন করে। উ মিন সিয়ান নিজের নাম তালিকাভুক্ত করেন। পরে কঠোর পরীক্ষা পাস করে তিনি চিকিত্সাদলের একজন সদস্য হন।

আফ্রিকায় ওষুধ ও চিকিত্সকের অভাব। সাধারণ একটি সার্জারি গ্রহণের জন্য রোগীদের অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়। অনেক গুরুতর রোগী অপেক্ষায় থেকে বিনাচিকিত্সায় মারা যান। আবার চিকিত্সক যারা আছেন, তারা প্রতিদিন অতিরিক্ত কাজ করেন। উ মিন সিয়ানও প্রতিদিন অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতেন। আফ্রিকায় ডাক্তারদের জন্য আরেকটি ঝুঁকি হচ্ছে: এইডস।

একবার উ মিন সিয়ান সার্জারি করার সময় নার্স তাকে জানায় যে, রোগীর এইডস আছে। তিনি প্রথমবারের মতো এইডসে আক্রান্ত হবার আশঙ্কার মধ্যে পড়েন। ভাগ্যক্রমে তিনি এইডসে আক্রান্ত হননি। তবে তখন তাকে এক মাস প্রতিষেধক ওষুধ খেতে হয়েছে। সেই ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ছিল বমিভাব এবং মাথা ঘোরা। তখন তার কাজেও ব্যাঘাত ঘটছিল।

নিয়ম অনুযায়ী, চিকিত্সাদলের প্রত্যেক সদস্য বছরে এক মাসের ছুটি পান। তবে ১১ বছরে উ মিন সিয়ান মাত্র ৬ মাসের ছুটি নিয়েছেন। তার লক্ষ্য ছিল যত কম সম্ভব ছুটি নেওয়া এবং বেশি করে রোগীদের চিকিত্সা করা।

প্রথমবার আফ্রিকায় দায়িত্ব পালনশেষে দেশে ফেরার পর উ মিন সিয়ান আবার আফ্রিকায় যাবার সিদ্ধান্ত নেন। ২০০৫ সালে তিনি আবার সহায়তা চিকিত্সাদলে যোগ দেন এবং সেবার তিনি যান জাম্বিয়ায়।

জাম্বিয়ার চিকিত্সা-ব্যবস্থাও ছিল খারাপ। চীনে যেটি সাধারণ একটি অসুখ, জাম্বিয়ায় সেটিই জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিবার সার্জারি করার আগে উ মিন সিয়ানকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করতে হতো এবং তাকে পূর্বপ্রস্তুতি নিতে হতো। একবার তিনি একজন রোগীর পেট থেকে বড় একটি টিউমার সফলভাবে অপসারণ করেন এবং স্থানীয় পত্রিকায় তার এ সফলতা 'মাইলফলক' হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

অন্যদিকে, ইথিওপিয়ায় উ মিন সিয়ান ও তার সহকর্মীরা প্রথমবারের মতো সেখানকার একটি জেলার অপারেটিং রুম ব্যবহার করেন। ওখানে চীনের সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে উ মিন সিয়ান অনেক জটিল ও কঠিন সার্জারি সম্পন্ন করেন এবং স্থানীয় চিকিত্সার শূন্যতা পূরণ করেন।

আফ্রিকায় ১১ বছর থাকার পর উ মিন সিয়ানের কাছে ওই মহাদেশটি হয়ে গেছে তার দ্বিতীয় বাড়ি বা সেকেন্ড হোম। তিনি বলেন, "একজন সহায়তা চিকিত্সাদলের সদস্য হিসেবে আমি আমার দেশের পক্ষ থেকে ওখানে যাই এবং বহন করি বড় দায়িত্ব। সুযোগ পেলে আমি আবার আফ্রিকায় যেতে চাই।"

আফ্রিকা মানে দারিদ্র্য ও ক্ষুধা, যুদ্ধ ও সংক্রামক রোগ। আফ্রিকায় উ মিন সিয়ান অনেক সমস্যা ও ঝুঁকির সম্মুখীন হন। জাম্বিয়ায় থাকাকালে তিনি ১২ বার ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন; সার্জারি করতে গিয়ে ৮ বার আহত হন। তিনি ৫ জন এইডস রোগীর সার্জারি করতে গিয়ে নিজে এইডসের হুমকির মধ্যে পড়েন।

তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল: যদি এইডসে আক্রান্ত হন, তবে কী করবেন? এ প্রশ্নের উত্তরে উ মিন সিয়ান বলেছিলেন: 'তাহলে আমি চিরকাল আফ্রিকায় কাটিয়ে দেবো।"

সম্প্রতি আফ্রিকায় নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি দু'টি বই রচনা করেন। একটার নাম '১৩ মাস: ইথিওপিয়ায় চীনা সহায়তা চিকিত্সক' এবং আরেকটার নাম 'আফ্রিকায় আমার ১০ বছর'। উ মিন সিয়ান বলেন: "আফ্রিকা যাবার আগে থেকেই আমি এ মহাদেশকে ভালবাসি। ওখানে যাবার পর আমি এখন আর কোনোদিন সেই ভূমিকে ভুলে যাব না। যদিও এখন আমি চীনে ফিরে এসেছি, কিন্তু রাতে কখনও কখনও স্বপ্নে আমি আফ্রিকা দেখি। আমার মন ওখানে পড়ে থাকে।" (শিশির/আলিম/রুবি)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040