ফারহান উল্লাহ পাকিস্তানের গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চলের রাজধানী গিলগিট শহরের বৃহত্তম বাজারে ৩৫ বছরের পুরাতন একটি টেক্সটাইল স্টোর পরিচালনা করেন। তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকে দোকানটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। দোকানে চীনের চেচিয়াং, চিয়াংসু ও ফুচিয়ান প্রদেশ থেকে আমদানিকৃত কম্বল ও জ্যাকেটসহ টেক্সটাইল পণ্য বিক্রয় হয়। তাঁর ছোট ভাই চীন থেকে পণ্য আমদানি করে। তাঁদের পণ্য কালাখুনলুন সড়ক দিয়ে গিলগিটে পরিবহন করা হয়। ফারহান উল্লাহ পাকিস্তানে পণ্য গ্রহণ ও বিক্রি করেন। এ সম্পর্কে ফারহান বলেন, "এ জায়গা চীনের কাছাকাছি। চীনা পণ্য গিলগিটে পরিবহন করা সহজ। চীনা পণ্যের মানও ভাল। আমরা তিন জন ব্যবসায়ী একসঙ্গে পণ্য আমদানি করি। পরে কালাখুনলুন সড়ক দিয়ে পাকিস্তানে পাঠাই। কালাখুনলুন সড়ক এখানকার প্রত্যেক ব্যবসায়ীর উপকার করেছে।"
ফারহান উল্লাহর দোকানের চীনা পণ্যের মান উচ্চ কিন্তু দাম কম। এ ছাড়া, তিনি করাচি, লাহোর ও পেশোয়ার থেকে চীনা পণ্যে অর্ডার পেয়ে থাকেন। তাঁর দোকান একটি ছোট-খাটো টেক্সটাইল পাইকারী কেন্দ্রের মতো।
এ ধরণের চীনা পণ্য বিক্রয়কারী দোকানদার গিলগিট বালতিস্তানে আরো অনেক আছে। কালাখুনলুন সড়ক নির্মিত হওয়ার পর বিগত ৪০ বছর ধরে চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্য চীন-পাকিস্তান মৈত্রী সড়ক দিয়ে গিলগিট বালতিস্তানে আসছে। তারপর এসব পণ্য পাকিস্তানের হাজার হাজার পরিবারে পৌঁছে যাচ্ছে।
কালাখুনলুন সড়ক পাকিস্তানের দক্ষিণ ও উত্তরকে সংযুক্তকারী প্রধান সড়কও। প্রতিদিন অনেক মালবাহী গাড়ি এই সড়ক ব্যবহার করে।
কালাখুনলুন সড়কের পাশে, হুনজা এলাকায় অবস্থিত কয়েক শতাধিক টন আলু সংরক্ষণে সক্ষম একটি গুদাম। গুদামের মালিক নাদিম হুসেন বলেন, তাঁরা হুনজা ও নাগারের স্থায়ী বাসিন্দাদের কাছ থেকে আলু কেনেন; তার পর ট্রাক দিয়ে পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে পাঠান। তাদের আলুর মান ভালো, তাই চাহিদা বেশি। এ সম্পর্কে নাদিম বলেন, "আমাদের প্রতিটি ট্রাকে ৪ থেকে ৫ লাখ রুপির আলু পরিবহন করা যায়। প্রতিদিন আমরা ৫০ লাখ রুপির আলু পরিবহন করি। প্রতি বছরের মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আমরা আলুর ব্যবসায় করি।"
নাদিম হুসেন বলেন, কালাখুনলুন সড়ক নির্মাণের কারণে তাঁর আলুর ব্যবসায় উন্নতি ঘটেছে। ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত চীনের সড়ক ও সেতু গ্রুপ (সিআরবিসি) সড়কটি পুনঃনির্মাণ করে। আগের ১০ মিটার চওড়া সড়ক এখন ৩০ মিটার চওড়া হয়েছে। "সড়কটি পুনর্নিমাণের পাঁচ থেকে ছয় দিন লাগতো বড় শহরে মাল পরিবহন করতে। কিন্তু এখন মাত্র তিন দিন লাগে। আমাদের পণ্য লাহোর ও ফয়সালাবাদ যায়। আমরা অনেক খুশি। বর্তমান সড়ক খুবই সুবিধাজনক ও আরামদায়ক।"
যখন সিআরআইএর সাংবাদিকরা পাকিস্তানের সোয়েস্তান পৌঁছান, তখন দশটি পাকিস্তানি ট্রাক কাস্টমসের বাইরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রতিবছরের পয়লা এপ্রিল থেকে ৩১ নভেম্বর পর্যন্ত সোয়েস্তান বন্দর খোলা থাকে। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বন্দরটি সবচেয়ে ব্যস্ত সময় অতিক্রম করে। ব্যবসায়ীরা কাস্টমস বন্ধ হওয়ার আগে যত বেশি সম্ভব পণ্য পরিবহন করার চেষ্টা করেন।
সোয়েস্তান বন্দরের শুল্ক উপ-প্রশাসক খালদুন উল হক বলেন, প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ চীনা পণ্য কালাখুনলুন সড়কের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সোয়েস্তান বন্দরে আসে। তিনি আরও বলেন, "প্রতি ঋতুতে চীন থেকে ১৬০০ থেকে ১৭০০ ট্রাক পণ্য আমদানি হয়। আমরা এর মধ্য দিয়ে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি রুপি শুল্ক পাই। এর মধ্যে অধিকাংশ হলো চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্য। এসব পণ্যের মধ্যে আছে পোষাক, টেক্সটাইল, গাড়ির যন্ত্রাংশ, টায়ার ও শুকনো ফলসহ বিভিন্ন পণ্য। এ ছাড়া, নির্মাণকাজে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও আমদানি করা হয়।"
খালদুন বলেন, সোয়েস্তান বন্দর দিয়ে বহনকৃত পণ্যের মধ্যে চীনা পণ্যের হার ৮০ শতাংশ। আসলে পাকিস্তানে উচ্চ মানের সামুদ্রিক পণ্য, শুকনো ফুল ও চেরি আছে। আশা করা যায়, আগামী বছর চীনে ৫ থেকে ৬ ট্রাক পণ্য রফতানি করা সম্ভব হবে।
সোয়েস্তান বন্দরের পণ্য পরিবহন বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বাশারত খান বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ও পাকিস্তান সরকার যৌথভাবে কালাখুনলুন সড়কের উন্নয়নে কাজ করেছে। এ সড়ক দু'দেশের মধ্যে স্থলপথে আর্থ-বাণিজ্যিক যোগাযোগ জোরদার করেছে। কালাখুনলুন সড়কের দ্বিতীয় পর্যায়ের পরিকল্পনা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় স্থানে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এদিকে সোয়েস্তান বন্দরে বাণিজ্যিক ট্রানজিট স্টেশন নির্মিত হবে। তখন চীনা পণ্য শুধু যে কালাখুনলুন সড়কের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের নানান স্থানে যাবে, তা নয়; বরং পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে অন্যান্য দেশেও পরিবহন করা যাবে। এ সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, "সোয়েস্তান শুধু যে পাকিস্তানের বাণিজ্যে ভূমিকা রাখবে, তা নয়; আফগানিস্তান ও ইরানেও চীনা পণ্য পরিবহনে ভূমিকা রাখবে। পাকিস্তানের পণ্য গোয়াদার বন্দরের মধ্য দিয়ে অন্যান্য দেশে রফতানি করা যায়। এ বছর সোয়েস্তান বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহনের পরিমাণ আগের চেয়ে বেশি ছিল। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে সোয়েস্তান বন্দর আরো বেশিসংখ্যক দেশের কাছে উন্মুক্ত হবে।"
১৮ নভেম্বর কালাখুনলুন সড়কের দ্বিতীয় পর্বের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। সোয়েস্তান বন্দরের শুল্ক উপ-প্রশাসক খালদুন উল হক মনে করেন, কালাখুনলুন পাকিস্তানের পরিবহন-ধমনীতে পরিণত হয়েছে। এ সড়কের কল্যাণে পাকিস্তান-চীন বাণিজ্য আরো বাড়বে।