ক্লিনিকে ঢুকে দেখা যায় ২০ বর্গমিটারেরও ছোট চিকিত্সার কক্ষ খুব পরিষ্কার ও উজ্জ্বল। বিভিন্ন রকমের ওষুধ ফিটফাট করে রাখা আছে। অবাক করা বিষয় হলো, ডাক্তার সি এখনো খুব পুরানো একটি কাঠের অ্যাবাকাস ব্যবহার করেন, যা খুবই জরাজীর্ণ! তিনি বলেন, 'এই অ্যাবাকাসটি হলো ১৯৭৯ সালে আমাকে দেওয়া গ্রামের প্রবীণ চিকিত্সকের মূল্যবান জিনিস। ডাক্তার সি অ্যাবাকাসে হাত বুলিয়ে বলেন, 'এটি গ্রামের মানুষ ও প্রবীণ চিকিত্সকের পক্ষ থেকে আমাকে দেওয়া দায়িত্ব ও দাবি।'
প্রায় ৬০ বছর বয়সী ডাক্তার সি ছোটবেলায় পোলিও রোগে আক্রান্ত হন। এতে তার কাজ করতে অনেক অসুবিধা হতো। তিনি একটি ছড়ি, একটি ওষুধের বাক্স এবং একটি উষ্ণ হৃদয় নিয়ে গ্রামের মানুষদের ৪০ বছর ধরে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন!
শিক্ষক, আমি উপরে উঠতে সক্ষম হয়েছি
সাংবাদিক দেখেন, ডাক্তার সি'র টেবিল থেকে ওষুধ কক্ষ মাত্র কয়েক ধাপ দূরে। তবে এই কয়েকটি ধাপ পার হতে তার বেশ সময় লাগে! তিনি বলেন, 'ছোটবেলায় গ্রামের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। বাবা মা পিঠে করে আমাকে অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে চিকিত্সা করাতেন। বাবা মা'র এতে অনেক কষ্ট হতো। আমারও মনে খুব কষ্ট হতো'। ডাক্তার সি বলেন, তখন তিনি ভাবতেন, যদি গ্রামে চিকিত্সা সেবা পাওয়া যেতো, তাহলে কতই-না-ভালো হতো।
উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর শারীরিক অবস্থার কারণে ডাক্তার সি'র একটি উপযোগী চাকরি খুঁজে পেতে খুব মুশকিল হয়। ঠিক তখন কেউ একজন তার বাসায় আসেন। তখনকার কথা স্মরণ করে ডাক্তার সি বলেন,
'আমি সবসময় সেদিনের কথা মনে রেখেছি। তখন আমাদের গ্রামের কৃষি উত্পাদক দলের নেতা কৃষকদের দেওয়া টাকা নিয়ে আমার বাসায় আসেন এবং সব টাকা আমার হাতে দেন'। তিনি বলেন, কৃষকরা কেউ দুই ইউয়ান দান করেছে, কেউ তিন ইউয়ান দিয়েছে, যা তখন অনেক টাকা!
উত্পাদক দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, সি'কে চিকিত্সা শেখার স্কুলে পাঠানো হবে; যাতে চিকিত্সা শিখে গ্রামে ফিরে এসে গ্রামের মানুষকে চিকিত্সা সেবা দিতে পারে।
ডাক্তার সি বলেন, 'আমি জানি চিকিত্সা শেখা আমার জন্য খুব কঠিন ব্যাপার হবে, তবে আমি এক মুহূর্তের জন্যও দ্বিধা করি নি।
১৯৭৮ সালের শেষ নাগাদ, সি চি লি চিকিত্সা স্কুলে ভর্তি হন। গ্রামের কৃষকের দেওয়া টাকা দিয়ে তার থাকা-খাওয়ার সমস্যার সমাধান হয়। তবে, প্রতিদিন ক্লাসে যাওয়ার জন্য চার তলা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হতো, যা তার জন্য একটি বড় পাহাড়ে ওঠার মতো চ্যালেঞ্জ!
সি চি লি শিক্ষককে বলেন : 'শিক্ষক, দয়া করে আমাকে নিজে চেষ্টা করার সুযোগ দিন'। সি চি লি এক হাতে সিঁড়ির রেলিং ধরে, এক হাত ছড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে একটি একটি করে সিঁড়িতে উঠতে থাকেন।
শেষ পর্যন্ত, তিনি নিজেই চার তলার সব সিঁড়ি জয় করেন।
শিক্ষক বলতেন, 'তোমার এমন অধ্যবসায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, কিন্তু প্লিজ আমাদের সাহায্য গ্রহণ করো।'
সি চি লি জবাবে বলতেন, 'শিক্ষক, আমি পারি, আমি নিজেই ক্লাসে যেতে পারি।'
এভাবেই সি চি লি রীতিমতো 'আরোহণ' করে চিকিত্সা স্কুলের ক্লাস শেষ করেন।
সবসময় মনে কৃতজ্ঞতা পোষণ করা
'আপনি এসেছেন, আপনার সর্দির ওষুধ শেষ নাকি?'। এক তরুণ কৃষক সি'র চিকিত্সা কক্ষে প্রবেশের পর পরই ডাক্তার সি তার খোঁজ-খবর নেন।
তরুণ কৃষক বলে: 'ওষুধ শেষ হয়েছে ডাক্তার, আমাকে দয়া করে আরও কিছু ওষুধ দিন।' তিনি টাকা দিয়ে ওষুধ নিয়ে বাসায় ফিরে যান।
ডাক্তার সি বলেন, 'তার নাম ছুই ফেং, তার পরিবারের তিনটি প্রজন্মকে আমি চিকিত্সা সেবা দিয়েছি'। ডাক্তার সি শুধু পুরো গ্রামের প্রত্যেকের নাম জানেন-তাই নয়, বরং প্রত্যেকের শারীরিক অবস্থাও ভালোভাবে জানেন। কাছাকাছি গ্রামের কৃষকরা ডাক্তার সি'র সুনাম শুনে ছুটে আসে।
বহু বছর ধরে ডাক্তার সি'র একটি অভ্যাস কখনই পরিবর্তন হয়নি। সেটি হলো, তার ওষুধের বাক্স সবসময় তার সঙ্গেই থাকে।
১৯৯২ সালে গভীর শীতকালের এক তুষার-ঝরা রাতে, ঘুম থেকে জেগে ওঠেন ডাক্তার সি। এক কৃষকের শিশু জ্বরের কারণে খুব বিপদে পড়েছে! দিনে সাধারণ মাত্র ১০ মিনিটের পথ। কিন্তু সে রাতে প্রচুর তুষারের কারণে ডাক্তার সি লাঠি হাতে নিয়ে ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় নিয়ে সেখানে পৌঁছান। কৃষকের বাসায় যেতে যেতে ঘামে তাঁর কাপড় ভিজে যায়।
'শিশুকে ওষুধ দিয়েছি, তার সঙ্গে এক রাত ধরে থেকেছি। জ্বর আস্তে আস্তে কমে গেছে, শিশুর অবস্থা কিছুটা ভালো হওয়ার পর ডাক্তার সি নিজের বাসায় ফিরে যান, তখন ভোরের আলো ফুটে উঠেছে আকাশে।
সি চি লি বলেন, গ্রামের কৃষকরা আমাকে লেখাপড়া ও জীবনযাপনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, আমি সবসময় কৃতজ্ঞ বোধ করি।
কৃষকদের আরও ৪০ বছর সেবা দিয়ে যাবো
প্রায় মুনাফাহীনভাবে ওষুধ বিক্রি করেন, বছরে কখনও ছুটি নেন না, কেউ ডাকলে সাড়া দেন ডাক্তার সি। শুধু তাই না, ডাক্তার সি কৃষকদের জন্য স্বাস্থ্য সম্পর্কিত আলোচনা সভার আয়োজন করেন, কৃষকের জন্য স্বাস্থ্যের নথি তৈরি করেন, স্বাস্থ্য সেবার হট লাইন চালু করেন, কৃষকের স্বাস্থ্যের জন্য অনুকূল সব কাজই তিনি করেন।
'এটা এক ধরনের দায়িত্ববোধের ব্যাপার'। ডাক্তার সি বলেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডাক্তার সি'র বাইরে গিয়ে চিকিত্সা সেবা দেওয়ার সুযোগ কমেছে। এদিকে, কৃষকদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বেড়েছে। কিছুটা অসুস্থ হলে তারা ডাক্তারের কাছে যান। অন্যদিকে, কৃষকদের জীবনযাপনের মান আগের চেয়ে আরও ভালো হচ্ছে, গুরুতর অসুস্থ হলে তারা নিজের গাড়ি চালিয়ে বড় হাসপাতালগুলোতে যান।
চিকিত্সা সম্পর্কিত নতুন জ্ঞান অর্জন করা ডাক্তার সি'র সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা। তার বই রাখার আলমারিতে বিভিন্ন ধরনের বই আছে। তিনি বলেন, কমিউনিস্ট পার্টির একজন সাধারণ সদস্য হিসেবে, তাঁর সরল আশা হলো, নিজের জ্ঞান দিয়ে কৃষকদের সেবা দেওয়া, কৃষকদের স্বাস্থ্য রক্ষা করা।