লাল কুল ও চীনের বৃহত্তম জেলা
  2019-12-27 10:02:26  cri

 

 

কুল তোলার সময় ছাং ইয়া পিংয়ের সবচেয়ে প্রিয়। ৬৭ বছর বয়সী এ প্রবীণ একসময় স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে তাকলিমাকান মরুভূমির সীমান্তে এক এক করে অনেক কুল গাছ রোপণ করেন। পরে মরুভূমির সীমান্তের এ জেলা চীনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

২০০০ সাল থেকে, সিন চিয়াং রুও ছিয়াং জেলা, চীনের বৃহত্তম এ জেলা, মরুভূমিতে বেঁচে রাখার উপায় খুজে পায়। ২০ বছর পর, কুল গাছ রোপণের মাধ্যমে এখানে কৃষক ও পশুপালকদের মাথাপিছু নিট আয় দশ-বারো গুণ বেড়েছে। রুও ছিয়াংয়ের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ সিনচিয়াংয়ের অনেক জেলা কুলসংশ্লিষ্ট শিল্প উন্নয়ন করে।

রুও ছিয়াং জেলা তাকলিমাকান ও কুমলাং মরুভূমির মধ্যে অবস্থিত। মরুভূমিতে এ দরিদ্র জেলায় ২০ বছর আগে, কুল শিল্প উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। জেলার পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১৮ সালে জেলার মাথাপিছু নিট আয় ৩২ হাজার ইউয়ানের বেশি ছিল, যা ২০০০ সালের তুলনায় ১৫ গুণ বেশি। এর মধ্যে কুল শিল্পের অবদান ৭৮ শতাংশ।

চীনে বৃহত্তম জেলা রুও ছিয়াং বিশ্বের সবচেয়ে অনাবৃষ্টিপ্রবণ এলাকাগুলোর অন্যতম। এখানে জীবনের উত্স তালিমু নদীর প্রবাহ থেমে যাওয়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশের অবনতি ঘটে। এতে এখানে বসন্তকালে যেমন শীত পড়তে শুরু করে, তেমনি বালিঝড় কৃষির জন্য উপযুক্ত নয়। দীর্ঘসময় ধরে এ জেলা সিনচিয়াংয়ে সবচেয়ে দরিদ্র এলাকাগুলোর অন্যতম ছিল। ২০০০ সালের এপ্রিল মাসে ছাং ইয়া পিং রুও ছিয়াং জেলার সিপিসির কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক হন এবং তিনি কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক উত্থাপিত 'পশ্চিম চীন উন্নয়ন পরিকল্পনা'-র সুযোগ কাজে লাগিয়ে রুও ছিয়াং জেলার অবস্থা পরিবর্তন করেন।

কয়েকবার পরিদর্শন, আলোচনা ও গবেষণার পর, ছাং ইয়া পিং লাল কুল তার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি বলেন, কুল গাছ স্থানীয় মানুষের মতো দুঃখকষ্ট কাটিয়ে উঠতে পারে। কুল গাছ প্রতিবছরের মে মাস পর্যন্ত ফুল ফোটে বলে বসন্তকালের বালিঝড়ের পর ফল হয় এবং এর পরিবহন ও সংরক্ষণের ঝামেলাও কম। রুও ছিয়াং জেলা দূরবর্তী এক জেলা এবং এখানকার পরিবহন অবকাঠামো দুর্বল। এমন অবস্থায় কুল চাষ উপযুক্ত।

২০০১ সালের বসন্ত উত্সবে প্রকাশিত হয় রুও ছিয়াং লাল কুল উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং প্রতিষ্ঠিত হয় লাল কুল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সেবা কেন্দ্র। ২০০১ সালের এপ্রিল মাসে, সাধারণ বসন্তকালের তুলনায় বেশ ঠান্ডা, তাপমাত্রা মাইনাস দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্য গাছের ফুল শীতে নষ্ট হয়, কেবল কুল গাছের ফুল বেঁচে থাকে।

এর পর, ছাং ইয়া পিংয়ের লাল কুল চাষের ধারণা আরও অটল হয়। তিনি হ্য নান প্রদেশ থেকে ১০ লাখের বেশি চারাগাছ ক্রয় করেন। তবে অন্য একটি সমস্যা এসময় দেখা দেয়। একটি কুল গাছ রোপণ থেকে ফল হওয়া পর্যন্ত ৫ বছর সময় লাগে। তার মানে ৫ বছর অপেক্ষা করতে হয় কৃষকদেরকে। ছাং ইয়াং পিং তাদেরকে বললেন, যারা কুল গাছ চাষ করতে চান, তারা সরাসরি চারাগাছ নিতে পারেন। প্রতিবছর তারা ভাতা পাবেন। তবে কৃষকরা নিজের ক্ষেতে কুল চাষ করলে অন্য ফসল চাষ করতে পারবেন না। তার মানে প্রথম ৫ বছর তাদের আয় কম হবে। কৃষক সং লি-এর মতো কয়েকজন কৃষক প্রথমদিকে কুল চাষ শুরু করেন। তিনি দুর্ভিক্ষের কারণে নিং সিয়া থেকে চলে আসেন রুও ছিয়াং জেলায়। ৩০ বছরের পরিশ্রমে তিনি ২০ মু জমি চাষ করেন। হঠাত্ করে জমিতে কুল চাষ করা তার জন্য সহজ একটি ব্যাপার নয়। তখনকার গ্রামে শুধু একটি ল্যান্ডন টেলিফোন ছিল। তিনি তার ছেলেকে ফোন করেন। ছেলে তখন উরুমুছিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিল। তার ছেলে ফোনে বলল, "বাবা, কেউ না-করলেও আমরা কুল চাষ করব।"

ছেলের কথা শুনে সং লি কুল চাষ শুরু করেন। প্রতিবেশীরা দেখে বিদ্রূপ করতে থাকে। তারা বলতে লাগল, "আমরা দোকান খুললাম, চালক হলাম, ছাগল পালন করলাম, সব ব্যর্থ হলো। এখন কুল চাষ করে ধনী হবার স্বপ্ন দেখা? অসম্ভব!"

সংলির মন নড়বড়ে হয়নি। তিনি প্রযুক্তিবিদের কাছ থেকে কুল চাষের কৌশল শিখে নিলেন। হ্য নান থেকে আসা বিশেষজ্ঞ এক এক গ্রামে গিয়ে কৃষকদের শেখাতে লাগলেন। তখন প্রতি দশ দিনে একবার প্রযুক্তিবিদ গ্রামে আসতেন। ধাপে ধাপে, সবাই কুল চাষের কৌশল শিখে ফেলে। ২০০৫ সাল ফসল তোলার সময়। সং লি'র ৭ মু জমির কুল ৩০ হাজার ইউয়ানে বিক্রি হয়। সং লি বলেন, ওই ৩০ হাজার টাকা তিনি এক মাস পকেটে রাখেন। কাজশেষে বিশ্রামের সময় বের করে একবার টাকাগুলো দেখেন। তিনি কখনও এতবেশি টাকা দেখেননি। ২৮ বছর পর ২০১১ সালে, সং লি তার স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে তার জন্মস্থানে ফিরে আসেন। তার স্বজনরা তাকে জিজ্ঞেস করেন, "তুমি জমিতে কী চাষ কর? এক বছরে কত লাখ ইউয়ান অর্জন করতে পার?" তারা অবশেষে নিজেরা সিনচিয়াংয়ে এসে দেখেন তার কুল চাষ এবং বিশ্বাস করেন যে, কুল চাষ করে সত্যিই এতো বেশি টাকা অর্জন করা যায়।

সং লি বলেন, একজন অবস্থাপন্ন কৃষকের জন্য তা যথেষ্ট নয়। তিনি গ্রামের কয়েকটি বড় কুল চাষী পরিবার নিয়ে গঠন করেন একটি সেবা দল। এই দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে কুল চাষের পদ্ধতি শেখাতে থাকে।

২০১৫ সালে কুল শিল্প একটি সংকটে পড়ে যায়। কুলের দাম অনেক হ্রাস পায়। একসময় এক কেজি ২০০ ইউয়ানের কুল ২০১৬ সালে মাত্র ২৮ ইউয়ান হয়। এ সংকটের মূল কারণ হল প্রতিবেশী জেলাগুলোতে একযোগে কুল চাষ শুরু হওয়া। এতে চাহিদার তুলনায় উত্পাদন বেশি হয়। রুও ছিয়াং উত্পাদনের পদ্ধতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। ২০১৭ সালে, রুও ছিং জেলায় কুল চাষের পদ্ধতিতে পরিবর্তন ঘটে। নতুন পদ্ধতিতে প্রতিটি গাছের মধ্যে দূরত্ব বাড়ানো হয় এবং গোটা পদ্ধতিকে যান্ত্রিকায়ন করা হয়। সারা জেলার কুল চাষ ২৪০ হাজার মু জমিতে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। বাকি অঞ্চলে পশুপালন করা হয়।

শুরুতে অনেকে বুঝতে পারেনি কম কুল চাষের কারণ। জেলার কর্মকর্তা এক একটি পরিবারে গিয়ে কারণ ব্যাখ্যা করেন। কম চাষ তবে গুণগত মান ভাল, বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্ষমতা বেশি।

সং লি একই গ্রামের বাসিন্দা ছেন সিয়াও মিং একজন যুবক। তিনি ২০১৫ সালে ই-কমার্স প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং অনলাইন দোকান খুলতে শিখেন। ছবি তোলা, কুলের পরিচয় লেখা, অনুষ্ঠান আয়োজন করা--তিনি এক এক ধাপে অনলাইন বিক্রির উপায় খুঁজে পান। তার ছেলে এমনকি ছোট মডেল হয়, ছেলে ও কুলের ছবি তুলে অনলাইন প্রচারণা করেন তিনি। এখন তিনি নতুন একটি চেষ্টা করেন। লাভ অনুষ্ঠান! নোটবুক, ক্যামেরা, ট্রাইপড সবকিছু নিয়ে তিনি ক্ষেতে দশর্কদেরকে সরাসরি পরিচয় করিয়ে দেন কুল বড় হবার প্রক্রিয়ার সঙ্গে।

কিছুদিন আগে, চে চিয়াং হং চৌতে অনুষ্ঠিত হয় ত্রয়োদশ লাল কুল উত্সব। এটাও রুও ছিয়াং নিজের কুল প্রচারণার একটি পদক্ষেপ। সীমান্তে বড় এ জেলা এখন সচ্ছল জীবনের উদ্দেশ্যে স্থিতিশীলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।(শিশির/আলিম/রুবি)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040