বন্ধুরা, চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত কালাখুনলুন সড়ক শুধু যে বিশ্বের বিশ্বের সর্বোচ্চ উচ্চতার আন্তঃদেশীয় হাইওয়ে তা নয়, বরং সবচেয়ে কঠিন নির্মিত সড়ক। চীন ও পাকিস্তান যৌথভাবে সড়কটি নির্মাণ শুরু করে। ১৯৭৯ সালে সড়কটি চালু হয়। সড়কটি মোট ১২২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ। সড়কটি নির্মাণের প্রক্রিয়ায় প্রায় ৭০০জন মানুষ জীবন হারান। সড়কটি চীন-পাক মৈত্রী সড়ক বলে পরিচিত। সড়কটি চীন ও পাকিস্তানের যোগাযোগ এবং আর্থ-বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের বিরাট সুবিধা সরবরাহ করে। বর্তমানে সড়কটি চীন-পাক অর্থনৈতিক করিডরের শুরু হিসেবে দু'দেশের সম্পর্ক অব্যাহতভাবে উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ বছর হলো কালাখুনলুন সড়ক চালু হওয়ার ৪০তম বার্ষিকী। এ উপলক্ষে
আমি এ বিষয় নিয়ে আপনাদেরকে কিছু কথা বলবো। বন্ধুরা, কালাখুনলুন সড়ক নির্মাণের আগে চীনের সঙ্গে সীমান্ত অঞ্চল পাকিস্তানের গিলগিট বালতিস্তান ছিল প্রায় বিশ্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন একটি অঞ্চল। অঞ্চলটি হলো পাকিস্তানের সড়ক ব্যুরোর সাবেক পরিচালক আব্দুল্লাহ জানের জন্মস্থান। তিনি বলেন,'কালাখুনলুন সড়ক নির্মাণের আগে গিলগিট বালতিস্তান অঞ্চল ও চীনের মধ্যে কোনো সড়ক ছিল না। স্থানীয় বাসিন্দারা শুধুমাত্র ঘোড়া এবং গাধার মাধ্যমে ব্যবসা করতেন। তারা প্রতি বছর এক বারের মত নিজের পশুসম্পত্তি দিয়ে স্থানীয় বৈশিষ্ট্যময় পণ্য বাইরে পাঠাতেন।' গত শতাব্দীর ষষ্ঠ দশকে পাকিস্তান চীনকে দু'দেশের মধ্যে সড়ক নির্মাণের অনুরোধ জানায়। চীন সরকার ইতিবাচকভাবে পাক সরকারকে সমর্থন করে। ১৯৬৬ সালে দু'দেশের স্বাক্ষরিত 'কালাখুনলুন সড়ক নির্মাণ চুক্তি' অনুযায়ী দু'দেশ প্রথমে স্বদেশে সড়ক নির্মাণ শুরু করে। কিন্তু পাকিস্তান নিজস্বভাবে সড়ক নির্মাণ করতে পারতো না। সেজন্য চীন পাকিস্তানকে সড়ক নির্মাণে সাহায্য করে। চীনের সড়ক ও সেতু কোম্পানির (সিআরবিসি) সাধারণ সহকারী ও কোম্পানিটির কার্যালয়ের সাধারণ ব্যবস্থাপক লি চি চুন কালাখুনলুন সড়ক নির্মাণের বিষয় নিয়ে বলেন, 'সে বছর চীন সরকার ১১ বছর দিয়ে পাকিস্তানকে ৬১৬ কিলোমিটারের সড়ক নির্মাণে সহায়তা করে।
১৯৬৮ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত চীন মোট ২২০০০জন মানুষ পাঠায়। এ পরিকল্পনা হলো অর্থনৈতিক সহায়ক পরিকল্পনা। চীনা পরিবহনবিষয়ক বৈদেশিক সহায়তা কার্যালয় প্রযুক্তি ও নকশা করেছে।' পাকিস্তানে কালাখুনলুন সড়ক হিমালয়, কালাখুনলুন ও হিন্দুকুশ পাহাড় এবং পামির মালভূমির মধ্য দিয়ে নির্মাণ করা হয়। এ ধরনের ভূখণ্ডে হালকা অক্সিজেন, তুষার ধ্বস, ভূমি ধ্বস, পাথর, জমে থাকা তুষার, বরফ জমা, ধ্বংসাবশেষ প্রবাহ ও ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন দুর্যোগ ঘনিষ্ঠভাবে সংঘটিত হয়। পাকিস্তানে সড়ক নির্মাণের সহায়ক বিভাগের অনুবাদক জিয়াং চেন স্যিয়াও তখন খারাপ অবস্থা নিয়ে বলেন,'চীনের সীমান্তের বাইরে পাকিস্তানের ভৌগলিক পরিবেশ খুবই খারাপ। যখন তীব্র বাতাস আসে বা জলবায়ু পরিবর্তন হয়, তখন সেখানে পাহাড় থেকে পাথর পড়ে। দুর্যোগ ঘনিষ্ঠভাবে সংঘটিত হয়।' পাহাড়ি অঞ্চলে সড়ক নির্মাণ আরো কঠিন। যন্ত্রপাতি পাঠানো ছিল একটি প্রশ্ন। কিন্তু চীনা সড়ক শ্রমিকরা এতে ভয় পায় নি। এ সম্পর্কে জিয়াং চেন স্যিয়াও বলেন,'তখন ৪০০ কিলোমিটারেরও বেশি সড়ক নির্মাণের সময় গাড়িতে যাওয়া যায় না। আমাদের শ্রমিকরা যন্ত্রপাতি বহন করেছিলেন।
নির্মাণের প্রক্রিয়া খুবই কঠিন'। জিয়াং চেন স্যিয়াও স্মৃতিচারণ করে বলেন, চীনা শ্রমিকদের দুটি উপায় ছিল। একটি হলো নির্মিত সড়কের পাশে একটি অস্থায়ী সড়ক নির্মাণ করা। অস্থায়ী সড়কে প্রধান সড়ক নির্মাণ করা। কিন্তু যদি অস্থায়ী সড়ক করা না যায়, তাহলে চীনা শ্রমিকরা বৃহত্তর ঝুঁকিতে পড়বেন। এ সম্পর্কে জিয়াং চেন স্যিয়াও বলেন,'চীনা শ্রমিকরা পাহাড়ে উঠে কাজ করতেন। তারা তখন বড় পাথর ও গাছে দড়ি বেধে কাজ করছিলেন। এ ধরনের কাজ খুবই কঠিন ও বিপজ্জনক। তারা তখন টানা কয়েক ঘন্টা পানি বা খাবার না খেয়ে কাজ করতেন।' স্থানীয় পাহাড়ের ভাঙা শিলা কাঠামোর কারণে বিস্ফোরণের সময় সবসময় ভূমিধ্বস সংঘটিত হয়। এতে অনেকে হতাহত হন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কালাখুনলুন সড়ক নির্মাণে প্রায় ৭০০জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে চীনা মানুষ ১৩০জন। জিয়াং চেন স্যিয়াও বলে, ১৯৭৬ সালের ১০ অক্টোবর একবার গুরুতর ভূমিধ্বসে তিনি ছিলেন। তখন অর্ধেক পাহাড় ধ্বসে যায়। এবারের পাহাড় ধ্বসে ২৫জন শ্রমিক নিহত হন। শহীদদের গিলগিটের কাছে কবর দেওয়া হয়। চীনা ও পাক শ্রমিকরা জীবন ও ঘাম দিয়ে কালাখুনলুন সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে দু'দেশের জনগণের গভীর মৈত্রী গড়ে তুলেছেন। রাজা হুনজা ও রাজা নাগারের বংশধর রাজা হাসাম মনে করেন, চীনা শ্রমিক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে তখন ব্যাপক মৈত্রী গড়ে উঠে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন,'আমি অনেক চীনা শ্রমিক ও প্রকৌশলীকে চিনি। তারা অনেক ভালো। চীনা ও পাক শ্রমিকরা একসঙ্গে কাজ করেছেন। তারা খুবই আনন্দে কাজ করেছেন। আমরা ফ্রেশ ফুল দিয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানাতাম। রাতে আমরা তাদের সঙ্গে চীনা চলচ্চিত্র দেখতাম। চীনা শ্রমিকরা হলেন আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।' সড়কটি নির্মাণের সময় নির্মাণস্থলে হাসপাতাল নির্মাণ করে চীন। ১৯৭৫ সালের অক্টোবর মাসের শেষ দিকে, সড়ক পরিচালনা বিভাগের দক্ষিণ লাইনের স্থান বাত্তানে সাত মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়।
চীনা হাসপাতাল কয়েক হাজার মানুষকে উদ্ধার করে। তখন জিয়াং চেন স্যিয়াও ও হাসপাতালের চিকিত্সকরা স্থানীয় মানুষকে উদ্ধার করেন। জিয়াং চেন স্যিয়াও বলেন,'আমি তখন তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাত্ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। প্রচুর পাথর পাহাড় থেকে পড়ে যায়। নদীতে পানি ঘোলা ছিল। কোনো কোনো বাড়িঘর ধ্বসে পড়ে। আমরা তিনদিনের মত কয়েক হাজার স্থানীয় মানুষকে উদ্ধার ও চিকিত্সা প্রদান করি। তৃতীয় দিন পাক প্রধানমন্ত্রী আমাদের সাথে সাক্ষাত্ করেন।' ১৯৭৯ সালে চীনের সহায়তায় নির্মিত কালাখুনলুন সড়ক চালু হয়। এর মাধ্যমে বিশ্বের সঙ্গে পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগের সড়ক চালু হয় এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন পরিবর্তন হয়। পাকিস্তানের সড়ক ব্যুরোর সাবেক পরিচালক আব্দুল্লাহ জান এ সম্পর্কে বলেন,'কালাখুনলুন সড়ক চালু হওয়ার পর স্থানীয় সমাজ ও অর্থনীতির মান কয়েক গুণ বেড়েছে। আগে এখানে জীবন যাত্রার মান ছিল খুবই নিম্ন।
আমি কোনো শব্দ দিয়ে তা বলতে পারি না। আগে স্থানীয় বাসিন্দারা এমন কি ফল ও সবজি সম্পর্কে জানতেন না। কিন্তু বর্তমানে তারা চীন থেকে আমদানিকৃত ফল খেতে পারেন। চীনা মানুষও গিলগিট বালতিস্তান থেকে আমদানিকৃত আম ও সবজি খেতে পারেন।' ৪০ বছর পর কালাখুনলুন সড়ক নির্মাণের প্রত্যক্ষদর্শীরা বয়স্ক হয়েছেন। কিন্তু তাদের নির্মিত চীন-পাক মৈত্রী সড়ক দু'দেশের জনগণের জীবনে কল্যাণ বয়ে নিয়ে এসেছে। তাদের গল্প অবশ্যই দু'দেশে প্রচারিত হচ্ছে ও হবে।