তিব্বত, গড় উচ্চতা ৪ হাজার মিটারের বেশি এবং চীনে একমাত্র প্রদেশ পর্যায়ের বিশেষ দরিদ্র এলাকা। এ অঞ্চলের উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভারসাম্যহীনতা লক্ষ্য করা যায়।
চীন বর্তমানে দারিদ্র্যবিমোচন কাজের শেষ দিকে প্রবেশ করেছে। আর এসময় তিব্বতের ১২০০ হাজার বর্গমিটার ভূমিতে এখন চলছি দারিদ্র্যবিমোচনের বিস্ময়কর ঘটনা।
তিব্বতে দরিদ্র লোকের সংখ্যা ২০১৩ সালের ৮ লাখ থেকে দেড় লাখে কমে এসেছে এবং দরিদ্র জেলার সংখ্যা ৭৪ থেকে ১৯টিতে নেমে এসেছে। অন্যভাবে, তিব্বতের দারিদ্র্যসীমার নিচে বাসকারীর সংখ্যা ৩০ থেকে ৫.৬ শতাংশে নেমে এসেছে। তিব্বতকে চলতি বছর সার্বিকভাবে দারিদ্র্যমুক্ত করতে এখন কাজ চলছে।
শান নান অঞ্চলের চা ছা জেলার কং খাং গ্রাম একটি দারিদ্র্যবিমোচন স্থানান্তর গ্রাম। এর আয়তন ৪৭.২ হেক্টর এবং মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ২১ কোটি ইউয়ান। ৩৬৯টি পরিবারের ১২৬৯ জন মানুষকে বিভিন্ন জায়গা থেকে এখানে স্থানান্তর করে আনা হয়েছে।
গ্রামে রয়েছে কিন্ডারগার্টেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, আবর্জনা স্থানান্তর স্টেশন, পশুসম্পদ শেডসহ অবকাঠামো। এখানকার গ্রামকমিটি ২৮টি দু'তলা দোকান ভাড়া দিয়েছে। প্রতিবছর ভাড়া থেকে আয় ৬ লাখ ইউয়ানের বেশি। গ্রামের বাসিন্দা ছু চেন সেপ্টেম্বর মাসে ফসল কাটা শেষ করে বাইরে কাজ করতে যান। তিনি জানিয়েছেন, আগে তারা পাহাড়ে বাস করতেন এবং চাষের জমি খুব কম ছিল। এখন তারা নতুন বাড়িঘরে স্থানান্তিত হয়েছেন এবং আগের চেয়ে বেশি চাষের জমি পেয়েছেন। চাষবাস থেকে আয় দ্বিগুণ হয়েছে।
গ্রামে নতুন চাষের জমি ১১২ হেক্টর এবং নানা ধরনের সবজি, ফল চাষ পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে। গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান। গ্রামের যুবক-যুবতীরা বিভিন্ন পেশায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বিভিন্ন কর্মগ্রুপে যোগ দিয়েছেন। গ্রামের সবার এখন কাজ আছে, আয় আছে।
উত্তর তিব্বতের না ছু শহরের রো মা উপজেলার গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫ হাজার মিটার এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ খুব খারাপ। গেল জুন মাসে এখানকার প্রথম দলটি হাজার কিলোমটার দূরে লাসা শহরে স্থানান্তরিত হয়। ত্রয়োদশ পাঁচসালা পরিকল্পনা অনুযায়ী, তিব্বতের ২ লাখ ৬৬ হাজার দরিদ্র মানুষকে স্থানান্তর করা হবে। এ পর্যন্ত তিব্বতের ৯৭৫টি পুনর্বাসনকেন্দ্রের মধ্যে ৯১০টির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে এবং ২ লাখ ৪৮ হাজার মানুষকে স্থানান্তর করা হয়েছে। পরিকল্পনার ৯৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে ইতোমধ্যেই।
তিব্বতের নানা শহরে দেখা যায় চীনের অন্য প্রদেশের নামের রাস্তা ও পার্ক। যেমন, লাসা শহরের বেইজিং রোড, শিকাজে শহরের শানতুং রোড, লিন চি শহরের ফুচিয়ান পার্ক ইত্যাদি। এ রোড ও পার্কের নাম অন্য প্রদেশের সঙ্গে তিব্বতের মৈত্রীর প্রতীক।
১৯৯৪ সালে, সিপিসির কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় তিব্বত সহায়তা ওয়ার্ক সিম্পোজিয়ামে তিব্বতকে সহায়তা দেয়ার পদ্ধতি ও নীতি নির্ধারণ করা হয়। তখন থেকে চীনের বিভিন্ন প্রদেশের সঙ্গে নির্দিষ্ট তিব্বতি শহরের সহায়তার সম্পর্ক তৈরি হয়।
২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত তিব্বতে চীনের ১৭টি প্রদেশ ও ১৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বাস্তবায়িত হয় ১৫৮৯টি দারিদ্রবিমোচন প্রকল্প। এক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ ৯৩০ কোটি ইউয়ান।
শিল্প উন্নয়ন দারিদ্র্যবিমোচনের মূলনীতি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিব্বতে উন্নয়ন হয় বার্লি, ইয়াক, পর্যটন, জাতিগত হস্তশিল্পসহ নানা শিল্প এবং অনেক কৃষক ও পশুপালক এ শিল্পগুলোর মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্ত হন।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে, না ছু শহরের লুও মা জেলার ৬৬০টি দরিদ্র পরিবার একবার কারর্ড পশুপালন শিল্প দৃষ্টান্ত বেস থেকে ৫ লাখ ইউয়ানের বেশি লভ্যাংশ পায়। এ দৃষ্টান্ত বেসের আয়তন ৬৬৬ হেক্টর এবং এতে রয়েছে পশুপালন, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ঘাস রোপণ এলাকা। এ কোম্পানি লাসায় ৫টি বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করে এবং দৈনন্দিন বিক্রয়ের পরিমাণ ১৫ হাজার ইউয়ান। গরমকালে তারা প্রতিদিন পশুপালকদের কাছ থেকে ২২৫০ কেজি দুধ সংগ্রহ করে এবং ৫২ জন দরিদ্র পরিবারের মানুষ এখানে দুধ সংগ্রহ, মান পরিদর্শন এবং বিক্রয়সহ নানা কাজ করেন।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিব্বতে চালু হয়েছে ২৫৬৭টি দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্প এবং এর মধ্যে ১৭০১টির কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের অগাস্ট মাস পর্যন্ত ২ লাখ ২২ হাজার মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হয়।
৩৭ বছর বয়সী ওয়াংমু উষ্ণ এবং প্রফুল্ল একজন মানুষ। তিনি লিন চি শহরের একটি দর্শনীয় স্থানে কাজ করেন। তার কাজ হল পর্যটকের জন্য ঘোড়া ধরা। প্রতিদিন তার আয় ২০০ ইউয়ান।
ওয়াং মুর গ্রামের ৬৬টি পরিবারের ৩২৭ জন সদস্য আছে। এর মধ্যে ১৮০ জন পারিবারিক হোটেলসংশ্লিষ্ট কাজ করেন। কেউ কেউ গত বছর অশ্বচালনা, রেস্টুরেন্ট, স্যুভেনিরসহ পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসা করেন। গত বছর এ গ্রামের আয় ১ কোটি ১৬ লাখ ১০ হাজার ইউয়ান এবং মাথাপিছু নিট আয় ২০ হাজার ইউয়ান ছাড়িয়ে যায়।
বর্তমানে তিব্বতে গ্রামীণ পর্যটনের স্থান ২০০টির বেশি এবং বার্ষিক আয় ১২০ কোটি ইউয়ান। ৭০ হাজার মানুষ এখন পর্যটনসংশ্লিষ্ট কাজ করেন এবং ৩২ হাজার মানুষ এর মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্ত হন।
শিকাজে শহরের লালু গ্রামের বাসিন্দা ছি চেন পাথুরি-রোগের কারণে ৪ ঘন্টার একটি সার্জারি গ্রহণ করেন। সুস্থ হলেও তার চিন্তা আছে। রোগের কারণে কিছু কাজ করতে পারেন না এবং চিকিত্সার খরচও বেশি। তার চিকিত্সাখরচ ২০ হাজার ইউয়ান । ৯০ শতাংশ সরকার কভার করে এবং তার নিজের খরচ মাত্র ২ হাজার ইউয়ান। বর্তমানে তিব্বতের দরিদ্র লোক সব তিন পর্যায়ের চিকিত্সা বিমার আওতায় আছেন। রোগের কারণে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২০১৬ সালের ৬৩.৪ হাজার থেকে কমে ১১.৮ হাজারে নেমে আসে। পাশাপাশি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ বিনামূল্যে চিকিত্সা গ্রহণ করেছেন।
২৩ বছর বয়সী চা সি পিং চুও একটি দরিদ্র পরিবারের ছেলে। তার মা মারা গেছেন এবং বাবা প্রতিবন্ধী। তার ছোট দু'ভাই ও এক বোন আছে। সারা পরিবার চাচার আয়ের উপর নির্ভর করে। সরকারি নীতি অনুযায়ী, প্রাথমিক স্কুল থেকে হাই স্কুল পর্যন্ত অধিকাংশ খরচ কভার করা হয়। ২০১৬ সালে তিনি তিব্বত ভোকেশনাল এবং টেকনিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। স্কুল তার সব শিক্ষা ফি মওকুফ করে এবং প্রতিবছর তাকে ৩০০০ ইউয়ান ভাতা দেয়। পাশাপাশি তাকে কাজের সুযোগও দেয়। তিনি বলেন, "এমন ভাল নীতি না-থাকলে আমি হয়ত স্কুল ছেড়ে চাচার সঙ্গে বাইরে কাজ করতে যেতাম।"
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে, তিব্বতের দরিদ্র বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদেরকে ৪ কোটি ৯০ লাখ ইউয়ানের ভাতা বরাদ্দ করা হয়েছে এবং ১১ হাজার শিক্ষার্থী এতে উপকৃত হয়। বাধ্যতামূলক শিক্ষা তালিকাভুক্তির হার ৯৯.৫ শতাংশ।
চীনের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাকৃতিক বেষ্টনী হিসেবে তিব্বতের ভূখণ্ডের তিন ভাগের এক ভাগ প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকা। সিপিসির অষ্টাদশ কংগ্রেসের পর পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ দারিদ্র্যবিমোচনের একটি পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে, তিব্বতে ৬ লাখ মানুষ মানবরক্ষক হিসেবে কাজ করেন এবং পশুপালকরা বন, তৃণভূমি, পানি সংরক্ষণসহ নানা কাজে অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের আয় অনেক বেড়েছে।
তিব্বত এখনও বিশ্বের সবচেয়ে ভালো প্রাকৃতিক পরিবেশের এলাকা এবং পশুপালকদের জীবনমান প্রতি বছর উন্নত হচ্ছে। এখানে দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রম স্থানীয় মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে এবং সীমান্ত অঞ্চলে দারিদ্র্যবিমোচনের একটি বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। (শিশির/আলিম)