তিন বছর আগে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গির হামলা মামলার রায় হয়েছে গত ২৭ নভেম্বর। মামলায় ৮ আসামীর মধ্যেই ৭ জনকেই মৃত্যুদণ্ড দেয় ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ আদালত। একজনকে বেকসুর খালাস দেয় আদালত। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্ব পায় এ রায়। আজকের সংবাদ পর্যালোচনায় আমরা নজর দেব হলি আর্টিজান হামলার পূর্বাপর বিষয়গুলোর দিকে।
২০১৬ সালের ১ জুলাই। রোজার ঈদের সপ্তাহ খানেক আগে শুক্রবারের রাত। বিদেশিদের কাছে প্রিয় গুলশানের হলিআর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। গোলাগুলির আওয়াজে ভেঙ্গে যায় শুনশান নিস্তব্ধতা। তরিৎ ছুটে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সন্ত্রাসীদের গুলিতে মারা যান দুই পুলিশ কর্মকর্তা। মুহূর্তে দেশিয় গণমাধ্যম ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে চলে আসে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ এ জঙ্গি হামলার খবরটি। জঙ্গি সংগঠন আইএসের মুখপত্র 'আমাক' হামলায় জড়িত রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল-এ পাঁচজনের ছবি প্রকাশ করে হামলায় সম্পৃক্ততার দাবি করে।
শুক্রবার রাত পৌনে ৯টা থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত ১১ ঘন্টা জঙ্গিরা জিম্মি করে রাখে দেশি-বিদেশি ৩৬ জনকে। রাতভর ঘিরে রাখার পর ভোরে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে যৌথবাহিনী। মাত্র ১০-১২ মিনিটের অভিযান 'অপারেশন থান্ডার বোল্টে' রেস্তোঁরার নিয়ন্ত্রণ নেয় যৌথবাহিনী। মারা পড়ে ৫ জঙ্গি। কিন্তু তারপরে বেরিয়ে আসে ভয়াবহ এক চিত্র। জিম্মি ৩৬ জনের মধ্যে তিন বাংলাদেশিসহ ২০ জনকেই নির্মমভাবে রাতেই হত্যা করে জঙ্গিরা। যাদের মধ্যে ভারত, জাপান ও ইতালির নাগরিক ছিলেন। ১৬ জনকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হয় যৌথবাহিনী।
হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার এ বিভীষিকা নাড়িয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশকে। সচকিত হয়েছিল গোটা বিশ্ব। এ ঘটনার পর জঙ্গি বিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জঙ্গি বিরোধী অভিযানে মারা পড়েন হলি আর্টিজান হামলার পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরীসহ বেশ কয়েক জন।
দ্রুততার সঙ্গে মামলার তদন্ত করে চার্জশিট দিয়ে তিন বছরের মাথায় মামলার রায় পাওয়াটা নিঃসন্দেহে একটা বড় সাফল্য। মামলার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। মামলার তদন্তকারী সংস্থা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একে বড় সাফল্য বলে দাবি করেন।
তবে এ সাফল্যে ছায়া ফেলেছে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত একাধিক আসামির আএএস চিহ্ন সম্বলিত টুপি পরে আদালত থেকে বের হওয়া। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ ও কারাকর্তৃপক্ষ পরস্পরকে দোষারোপ করছে। তবে, দোষারোপ করা বাদ দিয়ে ঘটনাটি কীভাবে ঘটলো তা অনুসন্ধান করে বের করাটাই মুখ্য।
আরো একটি বিষয় মনোযোগ দাবি করে, সেটি হলো হলি আর্টিজান হামলায় নিহত কয়েক জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এবং এদের অনেকেই দৃশ্যত স্বচ্ছ্বল পরিবারের সন্তান। এরা কীভাবে জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হলে এবং এদের মতো অন্য কেউ বিপথে পা দিচ্ছে কী না এ বিষয়টির দিকে সংশ্লিষ্ট সকলকে নজর দেয়া জরুরি। হলি আর্টিজানের পর জঙ্গি বিরোধী অভিযানে তাদের তৎপরতা দুর্বল হলেও এ বিষয়ে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে সব সময় নজরদারির পরামর্শ বিশ্লেষকদের।
এদিকে, হলি আর্টিজান হামলা মামলার রায়ের দুদিনের মাথায় একটা ভালো সংবাদ এসেছে। সংবাদটি হলো বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ দমন সূচকে আগের বছরের তুলনায় ৬ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্সটিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যন্ড পিস-আইইপি প্রাকশিত গ্লোবাল টেরোরিজম ইনডেক্স প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে। ১০ এর মধ্যে ৫ দশমিক ৮ স্কোর করে বাংলাদেশ ১৬৩টি দেশের মধ্যে ৩১তম অবস্থানে রয়েছে। এর মানে হচ্ছে দেশে সন্ত্রাসবাদের প্রভাব মাঝারি। আগের বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২৫ নম্বরে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জিরো টলারেন্স নীতি প্রশংসা করে প্রতিবেদন বলা হয়, হলি আর্টিজান হামলার তিন বছরে গৃহীত পদক্ষের কারণেই বাংলাদেশ কাঙ্খিত সাফল্য লাভ করেছে।
ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।