'স্মরণীয় বরণীয় যাঁরা': ২০১৯ সালের বার্ষিক শিল্পপতি পো লিয়ান মিং : ভবিষ্যতের বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনী 'আলো'
  2019-11-29 14:08:55  cri

গত শুক্রবার বেইজিংয়ে দ্বাদশ শিল্পপতি বার্ষিক সম্মেলন আয়োজন করা হয়। এতে আলিবাবাসহ চীনের বিভিন্ন বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে হাই-টেক খাতের বিখ্যাত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা অংশ নিয়েছেন। তারা শিল্প খাতের আপগ্রেড নিয়ে সংলাপ করেন, এতে বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়।

সম্মেলনে বার্ষিক দশজন শিল্পপতি, বার্ষিক দশজন পুঁজি বিনিয়োগকারীসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারও দেওয়া হয়। এতে লেজার ডিস্পলে খাতের বিখ্যাত শিল্পপ্রতিষ্ঠান–এপোট্রোনিক্স-এর সিইও পো লিয়ান মিংকে '২০১৯ সালের বার্ষিক শিল্পপতির পুরস্কার' প্রদান করা হয়।

পো লিয়ান মিং-এর চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতা বেশ সমৃদ্ধ। তার চাকরি জীবন শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর তিনি বেসামরিক বিমান শিল্পে যোগ দেন। তিনি হলেন চীনের শেনচেন এয়ারলাইন্সের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এরপর তিনি চীনের টিসিএল গ্রুপে যোগ দিয়ে ১৮ বছর ধরে কাজ করেন। টিসিএল গ্রুপ চীনের ঘরোয়া বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি উত্পাদনের সঙ্গে যুক্ত বিখ্যাত শিল্প প্রতিষ্ঠান। ২০১৮ সালে পো লিয়ান মিং-এর নেতৃত্বে টিসিএল গ্রুপের বাণিজ্যের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ইউয়ান ছাড়িয়ে যায়। এমন সমৃদ্ধ সময়ে পো লিয়ান মিং খুব বড় একটি সিদ্ধান্ত নেন, যা সবাইকে অবাক করে দেয়। তিনি টিসিএল গ্রুপকে বিদায় জানিয়ে নতুন কোম্পানি-এপোট্রোনিক্সে যোগ দেন এবং সিইও হিসেবে কাজ শুরু করেন। নিজের চাকরি জীবনের কয়েকটি বড় সিদ্ধান্ত সম্পর্কে পো লিয়ান মিং বলেন,

আসলে আমি নিজেই চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করি। টিসিএল কোম্পানিতে আমি ১৮ বছর ধরে কাজ করেছি। টিসিএল-এর প্রধান হিসেবে দশ বছর ধরে কাজ করেছি। টিসিএল-এ আমি আমার চাকরি জীবনের বড় সাফল্যও অর্জন করেছি। যেমন, ২০০৬ সালে যখন টিসিএল বিরাট সংকটের সম্মুখীন হয়, তখন আমার নেতৃত্বে টিসিএল আবারও সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়ায়। যেমন, টিসিএল ভালোভাবে উন্নয়নের যুগে প্রবেশ করে। গত বছর আমি টিসিএলের প্রধান লি তুং শেংকে বললাম, আমার বয়স ৫৫ বছর হয়েছে, আমি আরো ৫ বছর কাজ করবো, ৬০ বছর বয়সে অবসর নিবো। এই ৫ বছরে আগের মতো এত উজ্জ্বল সাফল্য অর্জন করতে পারবো কি-না, তা বলা খুব মুশকিল। তবে যদি আমি বর্তমান পরিবেশ থেকে সরে গিয়ে নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি, তাহলে আমার চাকরি জীবনে নতুন সাফল্য সৃষ্টি হবে।

পো লিয়ান মিং-এর চাকরি জীবন এবং তাঁর বর্তমান শিল্প প্রতিষ্ঠানের 'উদ্ভাবন' শব্দের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। উদ্ভাবন সম্পর্কে পো লিয়ান মিং-এর নিজস্ব অনুভূতি এবং ব্যাখ্যা আছে। তিনি বলেন,

উদ্ভাবন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য এক ধরনের চালিকাশক্তি। এখন সারা দেশ উদ্ভাবন এবং প্রবৃদ্ধির পদ্ধতি উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। গোটা সমাজ এখন উদ্ভাবনের জন্য চেষ্টা করছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো যদি উদ্ভাবন না করে, তাহলে মরে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। একই পথে আপনি দীর্ঘসময় ধরে যেতে পারেন না, যথেষ্ট সৌভাগ্যবান হলেও এ পথে চিরদিন হেঁটে যেতে পারবেন না। এই প্রক্রিয়ায় আপনি বেশ কয়েকবার শিল্পের উন্নয়ন এবং রূপান্তরের সম্মুখীন হবেন। এই রূপান্তর প্রক্রিয়া মানেই উদ্ভাবন। শিল্প প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় যদি উদ্ভাবন না থাকে, তাহলে সেই শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরাজিত হয়।

এদিনের সম্মেলনে পো লিয়ান মিং তার ভাষণে বলেন, ডিস্পলে শিল্পে, এপোট্রোনিক্স প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে নিজের উন্নয়নের বৈশিষ্ট্যময় পথ খুঁজে পেয়েছে, এখন এপোট্রোনিক্স চীনের বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনী শিল্প প্রতিষ্ঠানের একটি দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে।

এপোট্রোনিক্সের কথা বললে অনেকেই হয়তো জানে না যে এই প্রতিষ্ঠান আসলে কী কাজ করে। একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি, অর্থাত্ চীনের ঐতিহ্যবাহী লন্ঠন উত্সবের সময় চীনের রাজপ্রাসাদ জাদুঘর একটি লাইট শো'র আয়োজন করে। অনেকেই এই লাইট শোর খুব উচ্চ মূল্যায়ন করেছেন। চীনের নিষিদ্ধ নগরের প্রাচীন স্থাপত্যকে প্রথমবারের মতো আলো দিয়ে সাজানো হয়। এতে নিষিদ্ধ নগরের থাইহ্যমেনে ৩ হাজার বর্গমিটার একটি বিরাট প্রজেকশন স্থাপন করা হয়। এতে এপোট্রোনিক্সের লেজার ডিস্পলে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। আর রাজপ্রাসাদের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো চীনাদের নিজস্ব লেজার প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। তাদের এই নতুন ধরনের ডিস্পলে প্রযুক্তিকে বলা হয় এএলপিডি লেজার প্রযুক্তি। এর বৈশিষ্ট্য: অনেক উজ্জ্বল ও দীর্ঘ আলো দেখা যায়।

পো লিয়ান মিং জানান, এএলপিডি লেজার ডিস্পলে প্রযুক্তির উদ্ভাবন দীর্ঘসময় ধরে লেজার ডিস্পলে খাতের অনেক সমস্যা সমাধান করেছে। একে পরবর্তী প্রজন্মের লেজার প্রযুক্তি উন্নয়নের দিক হিসেবে মনে করা হয়। আর এই প্রযুক্তি ধাপে ধাপে বিশ্বের লেজার ডিস্পলে খাতের প্রধান প্রযুক্তিতে পরিণত হচ্ছে। এ খাতে চীন নেতৃত্ব দিচ্ছে। পো লিয়ান মিং বলেন,

আসলে ডিস্পলে প্রযুক্তির অনেক ধরন আছে। তবে এর অধিকাংশই বিদেশের উদ্ভাবিত। চীন এক্ষেত্রে অনুসরণকারীর ভূমিকা পালন করে। শুধু লেজার ডিস্পলে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীন বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আর, চীনের মধ্যে এপোট্রোনিক্স সবার সামনে এগিয়ে আছে।

গত ২২ জুলাই, এপোট্রোনিক্স সাফল্যের সঙ্গে স্টারমার্কেটে যোগ দেয়। স্টারমার্কেট হলো ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর চীনের শাংহাইয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক আমদানি মেলায় চীনের প্রেসিডেন্টের ঘোষিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এটি চীনের পুঁজিবাজারের থেকে আলাদাভাবে পরিচালিত হয়। এটি চালুর উদ্দেশ্য হলো বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনমূলক শিল্প প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য বাড়ানো এবং বাজার জোরদার করা। প্রথম দফায় স্টারমার্কেটে ২৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান সাফল্যের সঙ্গে নিবন্ধিত হয়, আর এর মধ্যে এপোট্রোনিক্স অন্যতম। এটি চীনের কুয়াংতুং প্রদেশের স্টারমার্কেটে নিবন্ধিত প্রথম শিল্পপ্রতিষ্ঠান। পো লিয়ান মিং বলেন, এখন উদ্ভাবনের যুগ শুরু হয়েছে। স্টারমার্কেটের প্রথম ২৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান সবই বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনশীল শিল্পপ্রতিষ্ঠান।

গণমাধ্যমের জরিপ থেকে জানা যায়, এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার গড়পড়তা সময় ১১.৬ বছর। প্রতিষ্ঠাতার গড়পড়তা বয়স ৫২ বছর। মানে বিশেষ খাতে তারা দীর্ঘসময় ধরে মনোযোগ দিয়েছেন এবং বরাদ্দ দিয়েছেন।

বো লিয়ান মিং বলেন, গত বছর চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি চালু হওয়ার ৪০ বছর পূর্তি। অনেক বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিত এপোট্রোনিক্সে পরিদর্শন করেছেন। এর মধ্যে চীনের সামাজিক বিজ্ঞান একাডেমির কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মূল্যায়ন তাকে খুব মুগ্ধ করেছে। তিনি বলেন,

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যদি শেনচেন শহরের বিগত ৪০ বছরের ইতিহাস জানতে চান, তাহলে শেনচেন শহরের পুঁজি বিনিয়োগ ব্যুরোকে দেখেন। যদি শেনচেনের গত ৩০ বছরের ইতিহাস জানতে চান, তাহলে হুয়াওয়েই কোম্পানির উন্নয়ন বোঝার চেষ্টা করুন। যদি গত ২০ বছরে শেনচেনের উন্নয়ন জানতে চান, তাহলে টেনসেন্ট কোম্পানির উন্নয়ন সম্পর্কে জানুন; আর যদি গত ১০ বছরে শেনচেন শহরের উন্নয়ন জানতে চান, তাহলে এপোট্রোনিক্স এই ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

এপোট্রোনিক্স ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ দীর্ঘ সময়ে এপোট্রোনিক্স দ্রুত মুনাফা অর্জন করার চেষ্টা করেনি, বরং নিজস্ব মেধাস্বত্বের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করার কাজে মনোযোগ দিয়েছে। এপোট্রোনিক্স হলো ছোট থেকে ধীরে ধীরে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার একটি দৃষ্টান্ত। অন্যদিকে, এপোট্রোনিক্স একটি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের দৃষ্টান্তও বটে। এটি বর্তমান চীনের উদ্ভাবনের মাধ্যমে উন্নত হওয়ার কৌশলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এপোট্রোনিক্স উন্নয়নের পদ্ধতি বর্তমানে চীনের ব্যাপক মাঝারি ও ক্ষুদ্র আকারের শিল্প প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনমূলক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে খুব সহায়ক হতে পারে।

বর্তমানে এপোট্রোনিক্স তাদের নিজস্ব মেধাস্বত্বের এএলপিডি লেজার ডিস্পলে প্রযুক্তিকে বিদেশের বাজারে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছে। পো লিয়ান মিং জানান,

বর্তমানে আমাদের বিদেশে উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন, বিভিন্ন দেশে আমাদের লেজার চলচ্চিত্র ডিস্পলে প্রযুক্তি জনপ্রিয় করা, লেজার টেলিভিশন তৈরি করা ইত্যাদি। কারণ এপোট্রোনিক্স চলচ্চিত্রের ডিস্পলেকে লেজার যুগে নিয়ে এসেছে। গত বছর আমরা বিশ্বের চলচ্চিত্র ডিস্পলে খাতের শীর্ষ শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বেলজিয়ামের বার্কো কোম্পানির সঙ্গে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নিবন্ধের পুঁজি ১০ কোটি মার্কিন ডলার। এই চুক্তি স্বাক্ষরের সময় ঠিক চীনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্য ছিয়াং বেলজিয়াম সফর করেন। দু'দেশের প্রধানমন্ত্রী এই সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। বর্তমানে আমরা এই কোম্পানির মাধ্যমে বিদেশের বাজার উন্নয়ন করছি।

যুগের উন্নয়নের সাথে সাথে, চীনের বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের গতিও দ্রুততর হচ্ছে। চীনের শিল্প প্রতিষ্ঠান আগের প্রযুক্তির অনুসরণকারী থেকে বর্তমানের উদ্ভাবনকারীতে পরিণত হচ্ছে। পো লিয়ান মিং বিশ্বাস করেন, ভবিষ্যতে আরও বেশি চীনা উদ্ভাবনী শিল্পপ্রতিষ্ঠান 'ভবিষ্যতের আলোকে' উজ্জ্বল করবে।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040