তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, এ বছর হলো গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৭০তম বার্ষিকী। আপনার চীন সফরের স্মৃতি থেকে কিছু বলুন। আপনি অবশ্যই ৭০ বছরে চীনের অনেক পরিবর্তন দেখেছেন; সেক্ষেত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের উন্নয়নের সাফল্য কী কী?
গোহ চোক টোং বলেন, ১৯৭১ সালে আমি প্রথম চীন পরিদর্শন করেছিলাম। সে সময়ের স্মৃতি এখনও আমার মনে আছে। তখন আমি ছিলাম সিঙ্গাপুরের সরকারি নৌ পরিবহন কোম্পানির প্রতিনিধি। আমি তিন দিনে সিঙ্গাপুর থেকে বেইজিংয়ে পৌঁছেছিলাম। কারণ আমি প্রথমে সিঙ্গাপুর থেকে হংকংয়ে যাই। হংকংয়ে অবস্থিত ব্যাংক অব চায়নার শাখায় চীনের ভিসার জন্য আবেদন করি। তারপর ট্রেনে কুয়াংতোংয়ে গিয়েছিলাম। পরের দিন বেইজিংয়ে পৌঁছেছিলাম। প্রথমবার আমি বেইজিং ছাড়াও হাংচৌ ও সুচৌতে গিয়েছিলাম।
তখন চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়। সড়ক বাইসাইকেলে ভরপুর। শহরের উপকণ্ঠের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান অনুন্নত।
গত ৭০ বছরে চীন অসাধারণ প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সাফল্য লাভ করেছে। বর্তমান চীন হলো একটি বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও নব্যতাপ্রবর্তনমূলক আধুনিক অর্থনৈতিক সত্তা। চীন শিক্ষা উন্নয়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ৪০ বছর আগে চীনের জিডিপি ছিল বিশ্বের মোট পরিমাণের ২ শতাংশ। কিন্তু এখন চীনের জিডিপি বিশ্বের প্রায় ১৬ শতাংশ। ২০০১ সালে চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দেওয়ার সময় পণ্য বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল বিশ্বের ৪ শতাংশ। কিন্তু, বর্তমানে চীনের পণ্য বাণিজ্যের পরিমাণ ২০০১ সালের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। বর্তমানে চীনের মাথাপিছু আয় ৯৭৭০ মার্কিন ডলার। এর অর্থ, চীন দারিদ্র্যতা থেকে মুক্তি পেয়েছে।
সবাই বলেন, সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিতে অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আমার মনে হয়, চীন সফলভাবে মাত্র এক প্রজন্ম সময়ে ৮৫০ মিলিয়নেরও বেশি চীনা মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিয়েছে।
আজকের চীন হলো বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। চীনের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি শুধু চীনের বিভিন্ন স্থানের উন্নয়নই জোরদার করেনি, বরং সিঙ্গাপুরসহ আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাণিজ্যিক সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে চীন আরও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। চীন বিশ্বের উন্নয়নে সমর্থন দিয়েছে এবং বহুপক্ষীয় ও নীতিগত আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা রক্ষা করে আসছে। চীন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা, যেমন: এশিয়ান অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) ও 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগ উন্নয়নের চেষ্টা করছে। এ ছাড়া, শান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে চীন অনেক অবদান রেখেছে। চীন জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। বর্তমানে চীন অনেক দেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদারে পরিণত হয়েছে।
আমি বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতে চীন অব্যাহতভাবে বিশ্বের স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে অবদান রাখবে।
তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয় : আপনি হলেন চীনা জনগণের পুরানো বন্ধু এবং চীনের কয়েক প্রজন্মের নেতাদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিল। আপনার দৃষ্টিতে দু'দেশের উন্নয়নের প্রবণতা কেমন? অথবা ভবিষ্যতে দু'দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের প্রত্যাশা কী?
গোহ চোক টোং বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে সিঙ্গাপুর চীনের সঙ্গে গভীর মৈত্রী ও ঘনিষ্ঠ অংশীদারির সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ১৯৭৬ সালে সিঙ্গাপুর রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা লি কুয়ান ইউয়ে প্রথম চীন সফর করেছিলেন। তখন চীনের শীর্ষনেতা তেং সিয়াও পিং ১৯৭৮ সালের নভেম্বরে সিঙ্গাপুর সফর করেন। তেং সিয়াও পিং ও লি কুয়ান ইউয়ের সাক্ষাত্কালে আমিও ছিলাম। তেং সিয়াও পিং চীনের ইতিহাস পর্যালোচনা করেছিলেন এবং চীনের উন্নয়নের কৌশল ব্যাখ্যা করেছিলেন। তা ছিলো আধুনিক উন্নয়নের মাধ্যমে চীনা জনগণকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করার পথ। এক মাস পর তেং সিয়াও পিং চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ কার্যকরের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন। তখন দু'দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের স্থিতিশীল ভিত্তি স্থাপিত হয়।
চীনের সঙ্গে সিঙ্গাপুরের সুষ্ঠু ও বাস্তব দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রয়েছে। আমরা নিয়মিত উচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ ও ব্যাপক সহযোগিতার পরিকল্পনা বজায় রাখি। আমরা পরস্পরের উন্নয়নের গুরুত্ব অনুযায়ী সহযোগিতার পরিকল্পনা প্রবর্তন করি। যেমন, সুচৌ শিল্প ক্ষেত্র, থিয়ানচিন প্রাকৃতিক নগর ও ছংছিং কৌশলগত সংযুক্তি ও যোগাযোগ প্রকল্প।
সিঙ্গাপুর ও চীন ২০১৫ সালে 'সময়ের সাথে অগ্রসর হওয়া সর্বাত্মক অংশীদারিত্ব সম্পর্ক' গড়ে তুলেছে, যাতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা নতুন পর্যায়ে উঠে যায়। আগামী বছর আমরা দু'দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৩০তম বার্ষিকী উদযাপন করবো। আমি বিশ্বাস করি, চীনের বর্তমান ও ভবিষ্যতে নেতারা অবশ্যই সিঙ্গাপুরের সঙ্গে মৈত্রীর ওপর গুরুত্ব দেবেন। দু'দেশের সম্পর্ক আও ঘনিষ্ঠ ও দৃঢ় হবে।
এরপর তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, ২০১৩ সালে 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগ কার্যকর হওয়ার পর সিঙ্গাপুর ইতিবাচকভাবে অংশ নিয়েছে। আপনার দৃষ্টিতে এ উদ্যোগটি কেমন? সিঙ্গাপুর কেন ইতিবাচকভাবে 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগের সমর্থন করে এবং অংশ নেয়? ভবিষ্যতে সিঙ্গাপুর উদ্যোগটির কোন কোন ক্ষেত্রে অংশ নেবে?
জবাবে গোহ চোক টোং বলেন, আমাদের মনে হয়, 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগ এশিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলে ক্রমান্বয়ে প্রবৃদ্ধি ও অবকাঠামোর চাহিদা পূরণ করতে পারবে এবং আঞ্চলিক যোগাযোগ ও সংযুক্তি জোরদার করতে পারবে। 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগ বাস্তব অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী অবশ্যই এশিয়ার সহযোগিতা ও প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে।
'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগের আওতায় বর্তমানে সিঙ্গাপুর চীনের সঙ্গে চার পক্ষের সহযোগিতা জোরদার করছে। এতে অবকাঠামোর নির্মাণ ও সংযুক্তি, ব্যাংকিংয়ের সংযুক্তি, ত্রিপক্ষীয় বাজার খাতে সহযোগিতা এবং আইন ও পেশাদার পরিষেবা বাস্তবায়ন করবে। ব্যাংকিং খাতে সিঙ্গাপুর একটি ব্যাংকিং কেন্দ্র হিসেবে এশিয়ার সংশ্লিষ্ট চাহিদা পূরণকে সমর্থন করে। সিঙ্গাপুর 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগে যৌথ অর্থ সংগ্রহ ও ঝুঁকি পরিচালনার সেবা সরবরাহ করে। চীনের সরকারি পরিসংখ্যানে বলা হয়, 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগসংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে চীনে বিনিয়োগকৃত অর্থের ৮৩ শতাংশই হলো সিঙ্গাপুরের। সংশ্লিষ্ট দেশগুলো চীনে বিনিয়োগের চার ভাগের এক ভাগ সিঙ্গাপুরের মাধ্যমে করেছে।
পাশাপাশি চীন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মতভেদ দূর করার চেষ্টা করছে। সিঙ্গাপুর ও চীনের বহুপক্ষীয় আইন বিনিয়োগকারীদের নিশ্চয়তা ও আস্থা দেয়।
বস্তুত, 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগ হলো একটি বহুমুখী ও সুপ্তশক্তিতে ভরপুর একটি উদ্যোগ। এটি অবশ্যই এশিয়ার প্রবৃদ্ধি জোরদার করবে।