বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম স্বপ্ন খুঁজে পায় বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্যে। কিন্তু সেই স্বপ্ন দেখার শুরু যদি হয় বই থেকে তা কেমন হয়! অনেকেই হয়তো বলবেন মোবাইলের মধ্যেই স্বপ্ন খুঁজে পাই না, তাহলে বইয়ের গল্প পড়ে আর কী হবে। তবে, বইয়ের গল্প পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশাল এক স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন বিশ্বের বৃহত্তম কোম্পানির মালিক লেই জুন। আসুন জেনে নেই তাঁর সেই গল্পটি।
তিনি হলেন লেই জুন। লেই জুন চীনের ইন্টারনেট শিল্পের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তি এবং বিশ্বের বার্ষিক ই-কমার্স উদ্ভাবন ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তিনি চীনের অর্থনীতির বার্ষিক ব্যক্তি এবং দশজন শ্রেষ্ঠ বাণিজ্যিক নেতা। তিনি চীনের ইন্টারনেটের বার্ষিক ব্যক্তির মর্যাদাপ্রাপ্ত মানুষ। এ ছাড়া তাঁকে 'ফোর্বস' ম্যাগাজিনের ২০১৪ সালের বার্ষিক বাণিজ্যিক ব্যক্তি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। লেই জুন ২০১২ সালে বেইজিং শহরের গণকংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন। তারপর ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি দেশের গণকংগ্রেসের প্রতিনিধির মর্যাদা পান।
লেই জুন ১৯৬৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর চীনের হুপেই প্রদেশের সিয়ানথাও শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯১ সালে উহান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বইয়ে মি. স্টিভ জবসের জীবনী পড়ে এতটাই অনুপ্রাণিত হন যে, জবসের মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।
১৯৯২ সালে পড়াশোনা শেষ করে প্রকৌশলী হিসেবে একটি চীনা সফটওয়ার প্রতিষ্ঠান কিংস্টফটে কাজ শুরু করেন। মাইক্রোসফ্টের কথা যারা জানে না, তাদের সবার জন্য কিংসফট এমন একটি প্রতিষ্ঠান যারা ওয়ার্ড প্রসেসিং (এমএস ওয়ার্ডের মতো), অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার, গেমিং এবং ই-কমার্সের কাজগুলো করে। নিজের প্রতিভা এবং দক্ষতা দিয়ে ১৯৯৯ সালেই কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন তিনি।
কিন্তু সারাক্ষণ স্বপ্ন যাকে তাড়া করে ফেরে, তিনি কি চাকরি করতে পারেন? ২০১০ সালের দিকে লেই জুন ব্যবসা শুরু করেন। তখনই মোবাইল ফোনের জগতে প্রবেশ করেন তিনি। ব্যবসা চলাকালীন তিনি আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হন। তবে হংকংয়ের বিলিয়নিয়ার চ্যান যা মর্নিং এর সহায়তায় তিনি মূলধনের ঘাটতি মেটাতে সক্ষম হন এবং ২০১০ সালের এপ্রিলে 'সিয়াওমি' কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।
পরবর্তী তিন মাস কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সিয়াওমি তাদের প্রথম অ্যান্ড্রয়েড সফটওয়ার ভিত্তিক ফার্মওয়ার চালু করে যার নাম দেয়া হয় 'এমআইএমইউ'। এটির স্যামসং ফোনের 'টাচউইজ' এর মতো ছিল।
প্রথম সংস্করণ অসাধারণ সাফল্য পায়। এরপর এমআই-২ বাজারে ছাড়েন তিনি। সেটিও বিস্তর পরিসরে বিক্রি হয়েছিল এবং ওয়্যারলেস ফোন বিক্রেতা মুবিসিটির সহায়তায় সিয়াওমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডসহ পশ্চিমা দেশের বাজার দখল করতে সক্ষম হয়। এ রকম উন্নয়নের কারণে বছরের শেষ দিকে সিয়াওমি চীনের পঞ্চম সর্বাধিক ব্যবহৃত স্মার্টফোন ব্র্যান্ডে পরিণত হয়।
২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময় ভারতে বিক্রির প্রথম ২৪ সেকেন্ডে তারা মোট ৪০,০০০ স্মার্টফোন বিক্রি করেন এবং শেষ পর্যন্ত ই-কমার্স কোম্পানি অ্যামাজন এবং স্ন্যাপডিলের সাথেও অংশীদারিত্বে যেতে হয়েছিল।
বর্তমানে এই সংস্থাটি উঁচু অবস্থানে পৌঁছে গেছে। বিশ্বব্যাপী তাদের ৪০ মিলিয়নেরও বেশি ব্যবহারকারী রয়েছে।
স্মার্টফোন বিক্রির ক্ষেত্রে সিয়াওমি একটি কৌশল ব্যবহার করে যা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান করে না। তাদের ফোনের উৎপাদন মূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ডিভাইসের দাম নির্ধারণ করা হয়। পণ্যের গুণগত মান অক্ষুণ্ণ রাখা এবং ভালো পারফরম্যান্সের ক্ষেত্রে কখনও আপোস করা হয় না। তাই কম দাম আর ভালো পারফরম্যান্সের জন্য ফোনটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
মাত্র ৫ বছরের মধ্যেই সিয়াওমি বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম স্মার্টফোন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্মার্টফোন বাজারে স্থান করে নিয়েছে।
বর্তমানে লেই জুন ৬০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করছেন এবং তিনি চীনের 'স্টিভ জবস' নামে খ্যাত।
লেই জুনের কিছু বক্তব্য
ব্রত শুরু করা মানে অন্যরা যে কাজ করে নি, সে কাজ করা। অথবা, যে কাজ অন্যরা করেছে তা ব্যর্থ হয়েছে, আপনি তা আবারও করবেন। একজন শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী নিশ্চয়ই যে কোনো কিছুকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস রাখে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র এবং এমন চরিত্রকে উত্সাহ দিতে হয়। তাই আমি তরুণ তরুণীদের প্রবীণদেরকে চ্যালেঞ্জ করা ও বর্তমান নিয়মকে পরিবর্তন করার উত্সাহ দেই। এটাই হলো সফল হওয়ার সূত্র।
এই বিশ্বে যে কোনো কাজ শুরু করলে তাতে গতি থাকতেই হবে। ইন্টারনেটের প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রধান বিষয় হলো 'দ্রুত গতি'।
আপনার সংগ্রামের শুরুতে, বিপুল পরিমাণের বিজ্ঞাপন করলে হয়তো ক্ষণিক সমৃদ্ধি সৃষ্টি হতে পারে; তবে, শুধুমাত্র ভালো পণ্য তৈরি করাই হলো সিদ্ধান্ত সফল করার একমাত্র উপায়। কারণ, ভালো পণ্য নিজেই কথা বলে।
প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করা এবং হত্যা করা নয়। প্রতিদ্বন্দ্বিতার উদ্দেশ্য হলো, আমাদের ক্রেতাদেরকে আরো ভালো পণ্য দেওয়া। ক্রেতা হলো শিল্প প্রতিষ্ঠানের বেঁচে থাকার উত্স। আমরা মন দিয়ে ভালো পণ্য তৈরি করি। আমরা পণ্য এবং ক্রেতার ওপর নজর রাখি।
আপনার ভবিষ্যত্ যখন একদম অন্ধকার, তখন আপনার বুঝতে হবে, আপনি নিজেই ঝলমল করছেন!
যদি অবসরের কথা বলি, আসলে ২০০৭ সালেই আমি কিংসফ্ট থেকে অবসর নিয়েছি। তারপর আমি যে সিয়াওমি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছি, তা আমার কাছে অবসরের পর আনন্দের জীবন! কেউ মনে করে অবসর জীবন মজার, কেউ মনে করে অবসর জীবন অনেক বিরক্তিকর। তবে আমি সিয়াওমি প্রতিষ্ঠা করেছি এবং এর উন্নয়নকে নিজের শখ হিসেবে দেখছি। তাই এখন আমার কাজ খুব আনন্দের। যে কাজ আমি করি, তা আমার কাছে খুব মজার।
সামনে যাওয়ার পথে চেষ্টা চালাতে হবে, অগ্রগতি অর্জন করতে হবে, যদি ১ শতাংশ অগ্রগতিও অর্জন করা যায়, আমি সেজন্য ১০০ শতাংশ চেষ্টা চালাতে রাজি!
সিয়াও মি কোম্পানি
সিয়াওমি ইনকর্পোরেশন' বা সংক্ষেপে 'মি' হলো একটি চীনা ইলেক্ট্রনিক্স এবং সফটওয়্যার কোম্পানি। চীনের বেইজিংয়ে সিয়াওমির হেডকোয়ার্টার অবস্থিত। স্মার্টফোনের পাশাপাশি সিয়াওমি মোবাইল অ্যাপ, ল্যাপটপসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ইলেকট্রনিক্স পণ্য ডিজাইন, ডেভেলপ ও বিক্রি করে থাকে।
২০১১ সালের অগাস্ট মাসে চীনে সিয়াওমি তার প্রথম স্মার্টফোন বাজারজাত করে। তারপর থেকে সিয়াওমিকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সময়ের সাথে সাথে দ্রুত চীনের মার্কেট শেয়ার বাড়তে থাকে সিয়াওমি কোম্পানির। যার ফলে, ২০১৪ সালে অন্য সব কোম্পানিকে পেছনে ফেলে চীনের বৃহত্তম মোবাইল ফোন কোম্পানিতে পরিণত হয় সিয়াওমি। চীন, ভারত, মালয়েশিয়া এবং সিংগাপুরেই সিয়াওমির প্রায় ১৫,০০০ কর্মী নিযুক্ত রয়েছেন। পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতেও সিয়াওমি দ্রুত তাদের বাজার প্রসারিত করছে। সিয়াওমির প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও লেই জুন; তাঁর বর্তমান মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৬.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৭ সাল অনুযায়ী, লেই জুন চীনের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় ২৪তম স্থান দখল করে নেন।
সিয়াওমি বর্তমানে স্মার্টফোন বা হার্ডওয়্যার নির্মাতা কোম্পানি হিসেবে বেশি পরিচিত হলেও এর যাত্রা শুরু হয়েছিলো মূলত একটি সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে। কিংসফট-এ সিইও হিসেবে থাকাকালীন মূলত একজন সফটওয়্যার নির্মাতা হিসেবেই লেই জুন ও তার দল গুগলের এন্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের উপর ভিত্তি করে একটি কাস্টম রম নির্মাণ করেন, যার নাম রাখেন 'মিইউআই' বা 'মিউয়ি' (MIUI)। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ব্যবহারকারীদের সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন ইন্টারফেস প্রদান করা। পাশাপাশি ব্যবহারকারীদের এমন সব সুবিধা, কার্যকারিতা এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দেওয়া যা গুগলের এন্ড্রয়েডে নেই বা তখনও আসেনি।
২০১১ সালে সিয়াওমি তাদের প্রথম স্মার্টফোন 'মি ওয়ান' বের করে। সফটওয়্যারের পাশাপাশি সিয়াওমি তখন থেকে নিজেরাই হার্ডওয়্যার নির্মাণের দিকেও মনোযোগ দিতে শুরু করে। মি ওয়ান ছিল আকর্ষণীয় দাম স্পেসিফিকেশনের দিক থেকে পরিপূর্ণ একটি ফোন। এই ফোন থেকেই মূলত কোম্পানির নবযাত্রা শুরু। সিয়াওমির মূল দর্শন হলো, সাশ্রয়ী মূল্যে ক্রেতাদের নিকট মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহ করা। মি ওয়ানের পর থেকে সিয়াওমি দ্রুত মানুষের নজরে আসতে শুরু করে। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা সিয়াওমিকে 'দ্য অ্যাপল অফ চায়না' বলেও ডাকা হতো সে সময়। তবে সিয়াওমি আর অ্যাপলের মধ্যে মিল বলতে ছিল তারা উভয়েই হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার কোম্পানি। তাদের অপারেটিং সিস্টেমে দৃশ্যত কিছু মিল ছিল। পাশাপাশি উভয়েরই নিজেদের পণ্যের সাপ্লাই চেইনের উপর ছিল শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ। সবশেষে দুই কোম্পানিরই ছিল বিশাল ফ্যানপেজ। এ ছাড়া তাদের মধ্যে যে অমিল রয়েছে তা হলো অ্যাপল তাদের পণ্যের আকাশচুম্বী দাম রাখতে পছন্দ করে এবং ব্যবহারকারীদের মতামতের কোনো তোয়াক্কা করে না। সেখানে সিয়াওমি ঠিক অ্যাপলের উল্টো কাজটাই করে।
২০১৫ সালের এপ্রিলে সিয়াওমি ভারতে তাদের স্মার্টফোন সরবরাহ করার ঘোষণা দেয় এবং ২৩ এপ্রিল অন্য যেকোনো দেশের আগে ভারতেই তারা সিয়াওমি 'M i4i' নামে এক স্মার্টফোন বাজারজাত করে। একই বছর তারা ব্রাজিলেও নিজেদের বাজার সম্প্রসারণ করার ঘোষণা দেয়। ২০১৬ সালের আগস্টে 'সোলার ইলেক্ট্রো বাংলাদেশ লিমিটেড' কোম্পানির মাধ্যমে সিয়াওমি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। গ্রামীনফোনের সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে একটি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশে মি ম্যাক্স, মি ৫ এবং রেডমি ৩ নামের তিনটি স্মার্টফোন বাজারে আনে। ২০১৭ সালে সিয়াওমি পাকিস্তানে অফিসিয়ালি প্রবেশ করে। এ বছরের ১৯ এপ্রিল তারা মি ৬ নামে একটি ফ্লাগশিপ স্মার্টফোন বের করে। সিয়াওমির ভারতে পদার্পণের পর এর জনপ্রিয়তা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, সিয়াওমি শুধু ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই ১০ মিলিয়ন ফোন বিক্রি করেছে। ১ বিলিয়ন ডলার মুনাফা শুধু ভারত থেকেই এসেছে। পাশাপাশি ভারতেই এখন তাদের ফোনের চাহিদা শতকরা ৪০০ ভাগ বেড়ে গেছে!