লিউ তাও ইয়ু: চীনের শিক্ষা ব্রতের কিংবদন্তি
  2019-11-01 19:14:03  cri

তিনি দেশের উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেন, তিনি শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যতের ওপর নজর রাখেন। তিনি দেশের প্রতি নিজের ভালোবাসা দিয়ে চীনের শিক্ষা ব্রত উন্নয়ন জোরদার করেছেন। তিনি হলেন চীনের অন্যতম শিক্ষাবিদ লিউ তাও ইয়ু।

'আমার মনে হয়, আপনারা হয়তো আমার সাক্ষাত্কার নেওয়া সর্বশেষ দফার সাংবাদিক। এরপর হয়তো আমি আর সাক্ষাত্কার দিতে পারবো না। কারণ, আমি একজন বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষ'।

গত অগাস্ট মাসে, চীনের হুপেই প্রদেশের উহান শহরের উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভবনে ৮৬ বছর বয়সী লিউ তাও ইয়ু এক সাক্ষাত্কার দেওয়া শেষে সাংবাদিকদের এমন কথাই বলেছিলেন।

চীনের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং উল্লেখযোগ্য শিক্ষা ব্রতের সংস্কারকারী, উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রধান হিসেবে, লিউ তাও ইয়ু ৬৬ বছর বয়স থেকে এই ভবনে আছেন; এখানে তিনি চীনের বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁকে দেখতে আসা শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও অতিথিদের সময় দেন।

১ নভেম্বর, চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন দফা শিক্ষার্থীরা ভর্তি হবে। চীনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষা চালুর পর ৪০ বছরেরও বেশি সময় পার হয়েছে; তবে এখন খুব কম ছাত্রছাত্রীই জানে যে, চীনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষা শুরুর সময়টা কেমন ছিল? এর পিছনে কী কী ঘটনা আছে।

১৯৭৭ সালের অগাস্ট মাসে, চীনের সাবেক নেতা তেং সিয়াও পিং দেশের শিক্ষা ও বিজ্ঞানবিষয়ক আলোচনা সভার সভাপতিত্ব করেছিলেন। উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের উপ-অধ্যাপক চা ছুয়ান সিং এই সভার একজন প্রতিনিধি। তবে সভার প্রথম দু'দিনে তিনি ভাষণ দেন নি। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন রাতে, তিনি তখনকার চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চশিক্ষা বিভাগের প্রধান লিউ তাও ইয়ুর কাছ থেকে মতামত ও প্রস্তাব জানতে চান। আলোচনা সভার মহাসচিব হিসেবে লিউ তাও ইয়ু চা ছুয়ান সিংকে চীনের 'সংস্কৃতি বিপ্লবের' ভুল শিক্ষা নীতি বাতিল করা এবং আনুষ্ঠানিকভাবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষা পুনরায় চালু করার প্রস্তাব দেন। লিউ তাও ইয়ুর কথা শুনে পরের দিন প্রতিনিধি চা ছুয়ান সিং আলোচনা সভায় সেই প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। চীনের সাবেক নেতা তেং সিয়াও পিং এ কথা শুনে আলোচনা সভায় সিদ্ধান্ত নেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষা পুনরায় শুরু করতে হবে। যে সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি তা দেরি করা ঠিক হবে না। তাই এই শীতকাল থেকে 'চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের' কারণে দশ বছর ধরে থেমে থাকা দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষা আনুষ্ঠানিকভাবে পুনরায় চালু হয়।

শিক্ষা ব্রতের সূচনা

১৯৮১ সালে ৪৮ বছর বয়সী লিউ তাও ইয়ু উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। তার কিছুটা উদ্বেগ ছিল। কারণ, তার আগের মেয়াদের প্রধানরা সবাই ছিলেন শিক্ষা ক্ষেত্রের পণ্ডিত অথবা বিখ্যাত রাজনীতিক। বর্তমান শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই তার চেয়েও প্রবীণ। এমন প্রবীণ এবং শক্তিশালী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে, তাঁর সত্যিই কিছুটা উদ্বেগ হয়। তিনি ভাবেন, আমি কী ভালোভাবে এই দায়িত্ব পালন করতে পারব!

গত শতাব্দীর ৮০ দশকে, চীনের উচ্চশিক্ষা খাতে সংস্কার সার্বিকভাবে শুরু হয়। লিউ তাও ইয়ু জানান, ৮০ দশকে, শিক্ষা মহলে একটি বিষয় খুব বেশি আলোচিত ছিল, তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে কি 'বিশেষ মেধাবী শিক্ষার্থীদের' শেখানো হয়? নাকি 'সব কিছুই জানে এমন শিক্ষার্থীদের' শেখানো হয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই দেশের ভবিষ্যত্ এবং নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণী কেমন হবে?

লিউ তাও ইয়ু জানান, 'সাংস্কৃতিক বিপ্লবের' পর, যদিও অনেক শিক্ষাবিদ এবং বিজ্ঞানী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয় শেখানোর আহ্বান জানালেও, তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে নি। অন্যদিকে, ১৯৮১ সালে লিউ তাও ইয়ু চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চশিক্ষা বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন, তখন চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ব্যবস্থা চালু করে, বৈজ্ঞানিক গবেষণা তখন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সের একটি অংশে পরিণত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কার্যক্রম স্থাপন করা চীনের উচ্চশিক্ষা-ব্যবস্থা সংস্কারের একটি ইঙ্গিত হিসেবে মনে করা হয়।

লিউ তাও ইয়ু বলেন, 'আমার দায়িত্ব পালনের শুরুর দিকে, আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি যে, উহানের লেখাপড়ার বিষয়গুলো খুব পুরোনো, বৈজ্ঞানিক গবেষণার মান অনুন্নত, যা নতুন প্রযুক্তিগত সংস্কারের চাহিদার সঙ্গে একেবারে অসঙ্গতিপূর্ণ!' তিনি স্মরণ করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের পর, তিনি তদন্ত এবং চিন্তার ভিত্তিতে ক্রমাগতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার বিভিন্ন বিষয় পুনর্বিন্যাস করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় আইন বিভাগ স্থাপিত হয়, নতুন করে সংবাদ বিভাগ, ফরাসি ভাষা বিভাগ, জাপানি ভাষা বিভাগ, জার্মান ভাষা বিভাগ, অর্থ বিভাগ, প্রকাশনা বিভাগ, মহাকাশ বিভাগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বিভাগ, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগসহ বিভিন্ন নতুন বিভাগ স্থাপন করা হয়। একটি নতুন ধরনের বহুমুখী বিশ্ববিদ্যালয় সবার সামনে হাজির হয়।

নতুন বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং চালু করা সহজ ব্যাপার নয়! তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্রেডের সংবাদ বিভাগের শিক্ষার্থীরা ইন্টার্নশিপ করতে চায়, তবে বেইজিংয়ের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের গণমাধ্যমে কোনো সুযোগ ছিল না! ছাত্রছাত্রীদের চিন্তাধারা খুব আধুনিক ও উন্মুক্ত। তবে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দফা সংবাদবিষয়ক শিক্ষার্থী, সমাজের কেউ তা জানে না। শিক্ষার্থীদের সুযোগ পাওয়ার জন্য লিউ তাও ইয়ু ট্রেনে করে বেইজিংয়ে আসেন এবং এক এক করে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের তথ্যমাধ্যমে ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা চালু করার জন্য আবেদন করতে থাকেন। এভাবে তাঁর শিক্ষার্থীরা অবশেষে ইন্টার্নশিপের সুযোগ পায়।

'লিউ তাও ইয়ু সবসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকে শীর্ষে রেখেছিলেন। তিনি যা করেন, তা সবই শিক্ষার্থীদের জন্য। তখন আমরা সবাই মনে করতাম যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান খুব হতভাগা মানুষ, তার নিজের জন্য কোনো সময় নেই, তাঁর সবটুকো সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই'। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদ বিভাগের প্রধান উ কাও ফু তাঁর সম্পর্কে এ কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন, তখনকার উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক অবস্থা ভালো না, যথেষ্ট অর্থ ছিল না। তখন সাংবাদিকতা শেখানোর জন্য ফটোগ্রাফি কোর্স চালু করা প্রয়োজন। তবে একটি ভালো ক্যামেরা কেনার অর্থও পাওয়া সম্ভব ছিল না। অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান লিউ তাও ইয়ু নিজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সরঞ্জাম বিভাগের প্রধানের কাছে আবেদন করে এ সমস্যার সমাধান করেন। উ কাও ফু বলেন, যখন সমস্যা হাজির হয়, তখন তা লিউ তাও ইয়ুকে জানাতে পারেন, তিনি সবসময় আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবেন এবং আপনার সমস্যা সমাধান করেন।

উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন স্থাপিত বিভাগের মধ্যে সংবাদ বিভাগ অন্যতম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্তরের কর্মী, শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের যদি সমস্যা হতো, তারা সরাসরি লিউ তাও ইয়ুর কাছে জানাতো। অনেকেই লিউ তাও ইয়ুর বাসায় ফেরার পথে তাঁর জন্য অপেক্ষা করত। তাঁর অফিস থেকে বাসার দূরত্ব ছিল মাত্র ১০ মিনিট। কিন্তু এই পথে অনেকেই তার নিজের সমস্যা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত এবং সাহায্য চাইতো। তাই, ১০ মিনিটের পথ পার হয়ে বাসায় যেতে তাঁর এক ঘণ্টা সময় লেগে যেত।

তখন উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা লিউ তাও ইয়ুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের 'কেন্দ্র' হিসেবে উল্লেখ করতো। বলা যায়, তিনি সবার স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রতিদিন তাঁর কাজ অনেক বেশি ছিল এবং তিনি সবসময় খুব ব্যস্ত সময় কাটাতেন। তারপরও তিনি সবসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ এবং তরুণ শিক্ষকদের খোঁজ-খবর নিতেন এবং তাদের বিভিন্ন পরামর্শ শুনতেন। অনেকেই বলত: আমাদের প্রধান লিউ তাও ইয়ু সত্যিই সবাইকে খুব সম্মান করেন।

সংস্কার

লিউ তাও ইয়ু মনে করেন, সংস্কার মানে পুরোনো ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিয়ে নতুন ব্যবস্থা স্থাপন করা। তদন্ত ও গবেষণার ভিত্তিতে লিউ তাও ইয়ু শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার সূচনা করেন। তিনি মনে করেন, শিক্ষাব্যবস্থা হলো যোগ্য মানবসম্পদ লালনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য স্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা। তাঁর সংস্কারের মাধ্যমে, উহান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের আগ্রহ অনেক বেড়ে যায়।

লিউ তাও ইয়ু বলেন, উচ্চশিক্ষার একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: যারা শিক্ষা গ্রহণ করেন, তাদের অবাধ বাছাইয়ের অধিকার নিশ্চিত করা। তবে তাদেরকে 'কাঁচামাল' হিসেবে দেখা ঠিক নয়।

উহান বিশ্ববিদ্যালয়ে, লিউ তাও ইয়ু শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষার বিষয় এবং পরিচালনা ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সংস্কার করেছেন, তা চীনের উচ্চশিক্ষা সংস্কারের সূচনার উন্মোচন করে। চীনের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় উহান বিশ্ববিদ্যালয়কে দৃষ্টান্ত হিসেবে মেনে নেয়।

লিউ তাও ইয়ুর চেষ্টায় ১৯৮৫ সালে, পুরো চীনের শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক সংস্কার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। যদিও অনেকের স্মৃতিতে তখনকার সংস্কার বেশ সুষ্ঠু ছিল, তবে লিউ তাও ইয়ু মনে করেন, সংস্কার আসলে খুব কঠিন ব্যাপার। অনেকের মূল্যায়নে, লিউ তাও ইয়ুর বুদ্ধির পাশাপাশি অনেক সাহসও আছে। অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হতে চায় শুধু ক্ষমতার জন্য, আরও বড় নেতাদের পছন্দের মানুষ হওয়ার জন্য। তবে, লিউ তাও ইয়ু এমন মানুষ নন। চীনের উন্নয়ন, চীনের অগ্রগতি, চীনের অনেক সমস্যার সমাধান লিউ তাও ইয়ুর মতো মানুষের কারণে সম্ভব হয়।

তবে খুব কম শিক্ষার্থী জানে যে, সবসময় শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর জন্য ব্যস্ত থাকা লিউ তাও ইয়ু, সারা জীবন যুগের উন্নয়ন এবং দেশের উন্নয়নের দিকেই এগিয়েছেন। ছোটবেলায় লিউ তাও ইয়ুর পরিবার খুব গরীব ছিল। মাধ্যমিক স্কুল থেকে তিনি আলফ্রেড নোবেলের মতো একজন বড় উদ্ভাবক হতে চাইতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সময় ছুটি হলেও তিনি কখনই বাসায় ফিরে যান নি, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতেন। তিনি বলেন, বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের পথ কণ্টকাকীর্ণ, যারা পরিশ্রম করতে পারে, যারা কঠিনতাকে ভয় পায় না, তারাই সফলতার তুঙ্গে পৌঁছাতে পারবে।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040