১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে, তত্কালিন সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্যোগে, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ব্রিটেন—এই চার দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বার্লিন সম্মেলনে একই বছরের এপ্রিল মাসে সুইজারল্যান্ডে উত্তর কোরিয়া ও ইন্দোচীন সমস্যা নিয়ে জেনিভা সম্মেলন আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ব্রিটেন ছাড়াও গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল।
১৯৫৪ সালের ২৬ এপ্রিল সম্মেলন জেনিভায় শুরু হয়। ৪০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে অংশ নেন। চীনের তখনকার প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই'র নেতৃত্বে ১৮০ জনেরও বেশি প্রতিনিধি সম্মেলনে অংশ নেন।
প্রাথমিক পর্যায়ে সুষ্ঠু প্রস্তুতিন পরে এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সঠিক গবেষণা ও বিচার করার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই সম্মেলনে তাঁর ভূমিকার প্রাথমিক পরিকল্পনা করেছিলেন। বহু বছর পর জেনিভা সম্মেলনের চীনা প্রতিনিধিদলের তথ্যগ্রুপের অনুবাদক গুয়ান চেন হু স্মৃতিচারণ করে বলেন, "আমরা সম্মেলনে যাওয়ার তিন/চার দিন আগে প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই আমাদের জানান যে, জেনিভায় আসার লক্ষ্য হলো উত্তর কোরিয়ার সমস্যা ও ভিয়েতনামে ইন্দোচীন সমস্যা সমাধান করা। তিনি ভেবেছিলেন, সম্মেলনে উত্তর কোরিয়ার সমস্যা সমাধান করা যাবে, কিন্তু ইন্দোচীন সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে না। আমরা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবো।'
জেনিভা সম্মেলনে প্রথমে উত্তর কোরিয়ার সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। চীন রাজনৈতিক পদ্ধতিতে উত্তর কোরিয়ার সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব উত্থাপন করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাধার কারণে সম্মেলনে উত্তর কোরিয়ার সমস্যায় কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। আর ইন্দোচীন সমস্যা সমাধানেও চৌ এন লাই'র নেতৃত্ব চীনা প্রতিনিধিদল অনেক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। সে বছরের জুলাই মাসে চৌ এন লাই জেনিভা সম্মেলনের অবকাশে চীনের গুয়াংস্যি'র লিউচৌতে ফিরে এসে ভিয়েতনামের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এরপর তিনি মস্কোয় গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি ভিয়েতনামের দক্ষিণ-উত্তর সীমানারেখার সমস্যা সমাধানে তিন দেশের নেতাদের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। সর্বশেষে জেনিভায় ইন্দোচীন সমস্যার সমাধান হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো মনে করে, চৌ এন লাই জেনিভা সম্মেলনে বেশি অবদান রেখেছেন।
জেনিভা সম্মেলনের সময় চৌ এন লাই নিজের সাময়িক বাসস্থানে বিভিন্ন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও নেতৃবৃন্দের সঙ্গে অসংখ্য বৈঠক করেন। যেমন, তিনি বিশ্ববিখ্যাত্ কমেডিয়ান চার্চি চ্যাপলিনের সঙ্গে বৈঠক করেন। দু'জন আনন্দের সঙ্গে সময় কাটান এবং বিভিন্ন সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করেন। এসব বৈঠকের মাধ্যমে নয়াচীনের আসল চরিত্র প্রকাশিত হয়। নয়াচীনকে 'অসুর' হিসেবে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে চৌ এন লাইয়ের প্রচেষ্টা ছিল শক্তিশালী পাল্টা-আঘাত। বিদেশি বন্ধুদেরকে শাংহাই'র স্থানীয় ইউয়ে অপেরা 'লিয়াং শান বো ও জু ইং থাই' দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন চৌ এন লাই। এ ইউয়ে অপেরা চীনের 'রোমিও ও জুলিয়েট' নামে পরিচিত। তখনকার ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট অ্যান্থনি এডেন একাধিকবার চৌ এন লাই'র বাসস্থানে গিয়েছিলেন। তিনি চৌ এন লাই'র সঙ্গে আলোচনায় দু'দেশের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত বিনিময়ের সিদ্ধান্তে পৌঁছান। এর মাধ্যমে দু'দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অনেক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। এরপর রবার্ট অ্যান্থনি এডেন তাঁর স্মৃতিকথায় চৌ এন লাই'র সঙ্গে তাঁর আলাপ-আলোচনার স্মৃতি তুলে ধরেন।
৫০ বছর হয়ে গেছে। জেনিভার যে ভিলায় চৌ এন লাই থাকতেন, বর্তমানে তার কাছাকাছি আরো অনেক ভিলা নির্মিত হয়েছে। ভিলাটিতে কোনো চীনা মানুষের স্মৃতি দেখা যায় না। ভিলাটি ভিলাটি বেসরকারি সংস্থার কার্যালয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু অনেক চীনা পর্যটক এখানে আসেন। লি ছিউ ফিং এখানকার একটটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। তিনি হলেন এখানকার কার্যালয়গুলোর একমাত্র চীনা কর্মী। তিনি বলেন, চীনা পর্যটকরা ভিলাটি পরিদর্শনে আসেন। বিশ্ব মেধাস্বত্ব সংস্থার পেটেন্ট সহযোগিতা চুক্তি অপারেশন বিভাগের পরিচালক চাও থিং হলেন তেমন একজন পরিদর্শক। তিনি বলেন, "আমি অনেক আগে এ ভিলার গল্প শুনেছি। আজকে ভিলা পরিদর্শন করে ভালো লাগছে। আমি নিজেও আন্তর্জাতিক সংস্থার চীনা কর্মী। ভিলাটি নয়াচীন প্রতিষ্ঠার পর বহুপক্ষীয় কূটনীতির উত্সস্থান। সেজন্য আমার উচিত পরিদর্শন করা।"
১৯৫৪ সালে আয়োজিত জেনিভা সম্মেলনে অংশগ্রহণ বহুপাক্ষিক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন চীনের প্রথম পদক্ষেপ ছিল। সেটি ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের কূটনীতির ইতিহাসে একটি মাইলফলক। জেনিভায় জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধি ছেন স্যু বলেন, বিগত ৬৫ বছর ধরে জেনিভা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীনের অংশগ্রহণের সাক্ষী। তিনি আরও বলেন, "প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই'র নেতৃত্বে চীনের প্রতিনিধিদল জেনিভায় বিশ্বের সামনে নয়াচীনকে তুলে ধরেছিল। সেদিন বিশ্ব দেখেছিল কূটনৈতিক পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে নয়াচীনের আন্তরিকতা ও সংকল্প। চীন ও বিশ্বের কূটনীতির ইতিহাসে সেটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর পর, ৬৫ বছর ধরে, চীন নিজের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের স্বার্থ সুরক্ষা করে গেছে এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়ন করে বিশ্বের শান্তি ও কল্যাণে ভূমিকা রেখে চলেছে। আন্তর্জাতিক বিষয়ে চীনের ভূমিকা অব্যাহতভাবে বাড়ছে।"