মহাকাশে নং ৩৩৮৮ নামে একটি ক্ষুদ্র গ্রহ আছে। এই গ্রহের নামকরণ করা হয়েছে একজন চীনা ব্যবসায়ীর নামে। কী অদ্ভুত ব্যাপার তাইনা! আর সেই চীনা ব্যবসায়ী হলেন চেং সিয়ান য্যি।
তার নামে ক্ষুদ্র গ্রহের নাম রাখার কারণ হলো, দেশের উন্নয়নে তার অতুলনীয় অবদানগুলো স্মরণ করা। গত মাসের ২০ তারিখ তিনি মারা যান। তার মারা যাওয়ার আগের বছর, অর্থাত ২০১৮ সালে তিনি বলেছিলেন, আগামী বছর হয়তো আমি সবার সামনে আসব না। আমি যদি মরে যাই, আমি মহাকাশের ওই ক্ষুদ্র গ্রহ হয়ে থাকবো!
প্রিয় বন্ধুরা, আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের ব্যবসা মহলের এই কিংবদন্তি ব্যবসায়ী চেং সিয়ান য্যি'র কাহিনী আপনাদের শোনাবো।
৮৫ বছর বয়সী চেং সিয়ান য্যি দুটি কাজের মাধ্যমে সবার কাছে পরিচিত হয়েছেন। তিনি ২০ শতাব্দীর ৭০ দশকে হংকংয়ে নেকটাই তৈরির ব্যবসা শুরু করেন। তিনি শূন্য হাতে 'গোল্ডলায়ন' গ্রুপ স্থাপন করেন। যখন চীনে বিদেশি ব্র্যান্ড বেশি জনপ্রিয় ছিল, তখন তিনি স্পর্শকাতর বাণিজ্যিক চিন্তাধারা দিয়ে চীনের এই কাপড়ের ব্র্যান্ডকে হংকং বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চলের প্রথম শ্রেণীর বিখ্যাত ব্র্যান্ডে উন্নীত করেন।
এ ছাড়া, তিনি দেশের বিভিন্ন কাজে অনেক আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। দেশের শিক্ষা, মহাকাশ, ক্রীড়া, বিজ্ঞান, চিকিত্সা এবং সামাজিক দাতব্য কাজে ২০ শতাব্দীর ৭০ দশক থেকে এ পর্যন্ত ১৪০০ হাজারেরও বেশি বার অর্থ প্রদান করেছেন, মোট পরিমাণ ১.২ বিলিয়ন হংকং ডলার। এ ছাড়া তিনি নিজের নামে শিক্ষা তহবিল, ক্রীড়া তহবিল এবং মানববাহী মহাকাশ তহবিলও স্থাপন করেছেন।
২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বিকাল ৪টা ২৮ মিনিটে চেং সিয়ান য্যি চীনের কুয়াংতুং প্রদেশের মেইচৌ শহরে মারা যান। 'গোল্ডলাইন' গ্রুপের প্রকাশিত এক বিবৃতিতে 'বিখ্যাত শিল্পপতি' এবং 'মহাদেশপ্রেমী' হিসেবে চেং সিয়ান য্যিকে আখ্যায়িত করা হয়।
চীনাদের নিজের ব্র্যান্ড
বার্ধক্যকালে চেং সিয়ান য্যি নিজের জন্মস্থান মেইচৌ শহরে ফিরে আসেন। তিনি মনে করেন, জন্মস্থানের পানি ভালো, বাতাস ভালো, সবকিছু ভালো। তার জীবন খুব সহজ। দুপুরবেলা সবসময় শাক-সবজির নুডলস্ খান, মাংসও থাকে না। এটি আসলে চেং সিয়ান য্যি'র চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ২০ শতাব্দীর ৭০ দশকে, তার গ্রুপ 'গোল্ডলাইনের' ব্যবসা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। তবে তিনি কখনই জুয়া খেলেন না এবং বিনোদনের জায়গায় যান না। তিনি নিজের জন্য প্রতিদিন দশ হংকং ডলার ব্যয়ের নিয়ম নির্ধারণ করে রেখেছেন, তার বেশি কখনও খরচ করেন না।
আসলে তার এই মিতব্যয়ী চরিত্র ছোটবেলা থেকেই হয়েছে। তার জন্মস্থান শান ছুয়ান গ্রাম অনেক দূরে অবস্থিত। এটি একটি ছোট দরিদ্র গ্রাম। চার বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান। তার মা অনেক কষ্ট করে চেং সিয়ান য্যি ও তার বড় ভাইকে লালন-পালন করেন। কঠোর জীবনের কারণে চেং সিয়ান য্যি খুব মিতব্যয়ী ছিলেন। তিনি মার প্রতি খুব কৃতজ্ঞ বোধ করেন। গরীব এবং কষ্টকর জীবনের কারণে ছোটবেলা থেকেই তার মনে একটি লক্ষ্য নির্ধারিত হয়, তা হলো একজন ভালো মানুষ হওয়া এবং দারিদ্র্যকে জয় করা।
প্রাথমিক স্কুলে ছয় বছর বয়সে তিনি দারিদ্র্যতার জন্য স্কুল থেকে ঝড়ে পরেন। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর গরীব শিক্ষার্থীরা সরকারের সহায়তায় আবারো স্কুলে ফিরে যেতে সক্ষম হয়। তিনিও লেখাপড়ার সুযোগ পান।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর চাচার কাছ থেকে পাওয়া দশ হাজার হংকং ডলারের বিনিময়ে তিনি প্রথম নেকটাই তৈরি করেন। তিনি প্রতিদিন হংকংয়ের বাণিজ্যিক এলাকায় নেকটাই বিক্রি করতেন। তবে নোংরা কাপড় পরার কারণে দোকানের মালিকা তাকে খুব ছোট করে দেখত। চেং সিয়ান য্যি এতে কিছু মনে করেন না; তিনি পরের দিন কফি হাতে আবারও সেসব দোকানে যান এবং মালিকের কাছ থেকে সম্মান আদায় করেন। পরে, সাফল্যের সঙ্গে নিজের নেকটাই বিক্রি করেন তিনি। আস্তে আস্তে তার ব্যবসা ভালো হতে থাকে।
পরে চেং সিয়ান য্যি আবিষ্কার করেন যে, দীর্ঘসময় ধরে ফ্রান্স ও ইতালির নেকটাই হংকংয়ের বাজারকে দখল করে আছে। হংকংয়ের নিজের কোনো নেকটাই-এর ব্র্যান্ড ছিল না। তাই, তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, হংকংবাসীর জন্য নিজের একটি নেকটাই ব্র্যান্ড গড়ে তুলবেন।
তিনি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নেকটাই-এর কাপড়, ডিজাইন, রং, ব্র্যান্ডের ডিজাইন, সব উপাদান গবেষণা করেন। তিনি জানতে পারেন, বিদেশের ব্র্যান্ডের সুবিধা কি। এত পরিশ্রমের পর তিনি অবশেষে ভালো গুণগতমান এবং সুন্দর ডিজাইনের নেকটাই তৈরি করতে সক্ষম হন।
এরপর তার কোম্পানি 'গোল্ডলাইন' নেকটাই উন্নয়নের পথে সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে যায়।
হংকং কমার্সিয়াল ডেইলি চেং সিয়ান য্যিকে এভাবে মূল্যায়ন করেছে: তিনি হংকংবাসীর জন্য, চীনাদের জন্য নিজের ব্র্যান্ড স্থাপন করেছেন, এর ফলে হংকংবাসীর মন থেকে 'হংকংয়ের পণ্য সস্তা এবং মন্দ' এ ধারণা দূর হয়ে যায়। এটি হংকংবাসীর জন্য খুব গর্বের বিষয়।
সারা জীবন দেশকে প্রতিদান দেওয়া
যখন গণমাধ্যম চেং সিয়ান য্যি'র সাক্ষাত্কার নেয়, তখন 'দেশের জন্য প্রতিদান দেওয়া' একটি অবিচ্ছেদ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন তাকে তাঁর শখ, তার সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার, তার স্বপ্ন এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়, তখন তার উত্তরই নিশ্চয়ই দেশের সঙ্গে জড়িত। তার শুধুই একটি স্বপ্ন: দেশের জন্য কিছু করা। তার সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার হলো, চীনের মূল ভূখণ্ডের কোলে হংকংয়ের ফিরে আসা এবং একজন চীনা হিসেবে গর্বের অনুভূতি লালন করা।
তিনি নিজেকে একজন গরীব মানুষ হিসেবে মনে করেন। তিনি নিজেকে কমিউনিস্ট পার্টি এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের কারণে ভাগ্য পরিবর্তিত হওয়া মানুষ হিসেবে দেখেন। যখন পরিবারের আর্থিক সমস্যার কারণে তিনি স্কুল থেকে বাধ্য হয়ে সরে যান, তখন একজন শিক্ষক দেখেছেন যে চেং সিয়ান য্যি লেখাপড়া করতে এত পছন্দ করেন, তাকে প্রতি মাসে তিন ইউয়ান সাহায্য দিতেন এবং আবার তাকে স্কুলে ভর্তি করে দেন। চেং সিয়ান য্যি বলেন, ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি টাকা ব্যবহার করেন নি এবং টাকা দেখতেও পারেন নি। তাই ৩ ইউয়ান তার মনে খুব গভীর ছাপ ফেলে। তিনি বার বার বলেন, ১৭ বছর থেকে ২৭ বছর পর্যন্ত, আমার দেশ আমাকে দশ বছর ধরে সাহায্য করেছে। কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী চীন নেই, কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া আমিও নেই।
হংকং মাতৃভূমির কোলে ফিরে আসার আগে চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদ চেং সিয়ান য্যিকে হংকংবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়। তিনি হংকংয়ের অন্তর্বর্তীকালীন কাজ করেন, হংকংয়ের মৌলিক আইনের কনসুলেট কমিশনের কাজে অংশ নেন এবং মাতৃভূমির কোলে ফিরে আসার কাজ করেন। অনেকেই ফোন করে তাকে সমর্থন জানায়, আবারও কেউ কেউ তাকে গালি দেয়। চেং সিয়ান য্যি বলেন: আমি পাত্তা দেই না। কারণ আমার মনে হয়, আমি যা করি, তা ঠিক। আমি তা করতেই থাকবো। আমি অনেক বার বলেছি, দেশের জন্য জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করবো। কেউ আমার দেশ ও হংকংয়ের ক্ষতি করলে আমি তা হতে দেবো না।
দেশের কোলে ফিরে আসার দ্বিতীয় দিন, হংকং সরকার তাকে পদক প্রদান করে। তিনি এক হাজারেরও বেশি মানুষের একটি সমাবেশ আয়োজন করেন। সমাবেশে তিনি পাঁচ তারকা খচিত লাল পতাকা ঝুলান এবং দেশপ্রেমের গান বাজান।
সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি চালু হওয়ার পর চেং সিয়ান য্যি হলেন, মূল ভূভাগে পুঁজি বিনিয়োগকারী প্রথম দফা হংকংয়ের অন্যতম ব্যবসায়ী। ১৯৮৪ সালে চীন ও ব্রিটেন যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে এবং ঘোষণা করে যে, ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই হংকংয়ে চীনের সার্বভৌমত্ব পুনরায় কার্যকর হয়। হংকংয়ের অর্থনীতি এক সময় অস্থিতিশীল ছিল। চেং সিয়ান য্যি আগে যুক্তরাষ্ট্রে ১০ লাখ মার্কিন ডলার পুঁজি বিনিয়োগ করতে চেয়েছিলেন, তবে তখন তিনি চীনের মেইচৌ শহরে কারখানা স্থাপনের জন্য এই ১০ লাখ মার্কিন ডলার পুঁজি বিনিয়োগ করেন। তিনি দেশের জন্য নিজের কিছু অবদান রাখতে চেয়েছিলেন।
আসলে ১৯৭৮ সালের সময় তিনি কুয়াংতুং প্রদেশের চুংশান মাধ্যমিক স্কুলের জন্য ৩ লাখ হংকং ডলার বরাদ্দ দেন, যাতে স্কুলে একটি নতুন বিল্ডিং নির্মাণ করা যায়। আর, এটিই হলো তার দানের সূচনা।
১৯৯২ সালে চেং সিয়ান য্যি চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সহযোগিতা করে চেং সিয়ান য্যি শিক্ষা তহবিল স্থাপন করেন। তখন তিনি এই তহবিল স্থাপনের জন্য ১০ কোটি হংকং ডলার প্রদান করেন। ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তহবিল শিক্ষাবিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০২৮জন শ্রেষ্ঠ শিক্ষককে পুরস্কার দেয়, যার মোট পরিমাণ ৪.৫ কোটি ইউয়ান।
২০০০ সাল থেকে চেং সিয়ান য্যি তহবিল 'শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর বৃত্তি পরিকল্পনা' চালু করে। যাতে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং পরিবার খুব গরীব, তাদেরকে সাহায্য করতে পারে। এই পরিকল্পনা চালুর পর থেকে এই পর্যন্ত মোট ১২.২ কোটি ইউয়ান বৃত্তি দেওয়া হয়েছে।
চেং সিয়ান য্যি'র জন্মস্থান মেইচৌ শহরে, চেং সিয়ান য্যি মাধ্যমিক স্কুল আছে, চেং সিয়ান য্যি স্টেডিয়াম আছে, চেং সিয়ান য্যি সেতু আছে। কুয়াংচৌ শহরের চুংশান বিশ্ববিদ্যালয়ে চেং সিয়ান য্যি হল আছে, চেং সিয়ান য্যি বিল্ডিং আছে, চেং সিয়ান য্যি বৃত্তি আছে। চেং সিয়ান য্যি চুংশান বিশ্ববিদ্যালয়কে ৫.৩ কোটি ইউয়ান দান করেছেন।
এ ছাড়া, বেইজিং নর্মাল ইউনিভার্সিটি, নানচিং ইউনিভার্সিটি, ছিংহুয়া ইউনিভার্সিটিসহ চীনের ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চেং সিয়ান য্যি'র আর্থিক সাহায্যে ভবন তৈরি হয়েছে।
চেং সিয়ান য্যি ১০ কোটি হংকং ডলার বরাদ্দ দিয়ে মানববাহী মহাকাশ তহবিল স্থাপনও করেছেন। এ ছাড়া, তিনি ৩০ কোটি হংকং ডলার বরাদ্দ দিয়ে চেং সিয়ান য্যি ক্রীড়া তহবিল গঠন করেছেন। যথাক্রমে চীনের ১৭৬জন খেলোয়াড় এই তহবিল থেকে পুরস্কার পেয়েছেন। পুরস্কারের মোট মূল্য ৭.৫ কোটি ইউয়ান। এ ছাড়া ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিক গেমসের স্টেডিয়াম হিসেবে বেইজিংয়ের বার্ডনেস্ট নির্মাণে তিনি বিপুল পরিমাণ আর্থিক সাহায্যও দিয়েছেন!
২০০৭ সালে যখন তিনি চীনের কেন্দ্রীয় টেলিভিশন সিসিটিভিতে সাক্ষাত্কার দেন, তখন তিনি বলেন, তার 'গোল্ডলাইন' কখনই দেউলিয়া হবে না। কারণ, এই গ্রুপ খুবই শক্তিশালী। তবে চেং সিয়ান য্যি মারা যাবেন। যখন তিনি মৃত্যুবরণ করবেন, তখন তার মোট সম্পদের ১০ শতাংশ দাতব্য কাজে ব্যয় করা হবে'।
২০ শতকের ৮০ দশকে চেং সিয়ান য্যি সামাজিক সেবায় অনেক কাজ করেন। মাতৃভূমির কোলে হংকংয়ের ফিরে আসা এবং এরপর, চেং সিয়ান য্যি অনেক কাজ করেন। ২০০৮ সালে, চেং সিয়ান য্যিকে 'চীনের শিল্প প্রতিষ্ঠান সংস্কারের দশজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির' একজন হিসেবে মর্যাদা দেয় সরকার। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে, চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের ৪০ বছর পূর্তি উদযাপনী সম্মেলন বেইজিংয়ে আয়োজন করা হয়। এতে চেং সিয়ান য্যিকে 'দেশের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণকে সমর্থনকারী হংকংয়ের শিল্পপতির' পুরস্কার দেওয়া হয়।