চীনা ব্র্যান্ডের পুনরুত্থানের গোপন রহস্য
  2019-10-16 08:55:56  cri

একসময়, পণ্যের গুণগতমান এবং ব্র্যান্ডের জনপ্রিয়তার কারণে, জাতীয় ব্যান্ডের চেয়ে চীনা মানুষ বিদেশি ব্র্যান্ড বেশি পছন্দ করতো। বিদেশি ব্র্যান্ডের উপর তাদের ছিল বেশি আস্থা। তবে, সাম্প্রতিক কালে এসে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে।

উপাত্ত বিশ্লেষণ কোম্পানি নেলসন প্রকাশিত চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের চীনা ভোগ্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬৮ শতাংশ চীনা ভোক্তা জাতীয় ব্র্যান্ড বেশি পছন্দ করে এবং ৬২ শতাংশ ভোক্তা বলেন, বিদেশি ব্র্যান্ড কিনলেও জাতীয় ব্র্যান্ড তাদের প্রথম পছন্দ।

২০১৮ সালে চিংতুংয়ের প্রথম ১০০টি সার্চ টার্মের ৩১টি ব্র্যান্ডসম্পর্কিত এবং এর মধ্যে আবার ১৭টি শব্দ চীনা ব্র্যান্ডসম্পর্কিত। অনেকে হুয়া ওয়ে, সিয়াও মি ও ভিভো'র পণ্য অনুসন্ধান করেছেন। অন্যদিকে আলিবাবার উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১৮ সালে আলিবাবা খুচরা প্ল্যাটফর্মে চীনা ব্র্যান্ডের অনুপাত ৭১ শতাংশ।

বাজারের অনুপাত বৃদ্ধির পাশাপাশি, জাতীয় ব্র্যান্ডগুলো প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ধরনের পণ্য বাজারে নিয়ে আসছে। ক্রীড়াপণ্য, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, মা ও শিশুদের ব্যবহারের পণ্যসহ নানা ক্ষেত্রে চীনা ব্র্যান্ডের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে।

আগে যখন চীনা ব্র্যান্ডের কথা উল্লেখ করা হতো, তখন মানুষের মনে প্রথমে আসতো 'সস্তা' 'লো কোয়ালিটি' ইত্যাদি টার্ম। অনেক চীনা কোম্পানির দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলেন, যখন চীনে প্রথমে চালু হয় সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি, তখন চীনা কোম্পানিগুলোর বেশিরভাগই মানুষের খাওয়া ও পরার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণকারী পণ্য তৈরি করতো। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্যের মধ্যে পার্থক্যও থাকতো খুব কম। এখন গত শতাব্দীর ৮০-৯০-এর দশকে জন্মগ্রহণকারীরা হচ্ছে উত্পাদিত পণ্যের মূল ভোক্তা। তাদের কাছে পণ্যের মানের পাশাপাশি, সৌন্দর্যও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই এখন অনেক জাতীয় ব্র্যান্ড পণ্যের নকশার ওপরও গুরুত্ব দিচ্ছে।

চলতি বছরের জুলাই মাসে, চীনা স্পোর্টস ব্র্যান্ড 'আনথা' যুক্তরাষ্ট্রে কিটি৪ নামের একটি বাস্কেটবল খেলার জুতার লঞ্চ অনুষ্ঠান আয়োজন করে। হাজার হাজার মার্কিনি বাস্কেটবল অনুরাগী দিনরাত লাইন দিয়ে এ জুতা কেনে। কেউ কেউ এমনকি অনুষ্ঠান শুরুর ৩০ ঘন্টা আগে এসে লাইনে দাঁড়ায়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনা ব্র্যান্ড কেবল দেশের অভ্যন্তরে জনপ্রিয় হয়ে উঠে তা নয়, বিদেশেও চীনা ব্র্যান্ড এখন অনেক জনপ্রিয়। সিয়াও মি মোবাইলফোনের অনুরাগীদের ডাকা হয় 'মিফ্যান'। মি মানে সিয়াও মি এবং ফ্যান মানে অনুরাগী। বিশ্বের ৭০টি দেশ ও অঞ্চলে সিয়াও মির অনুরাগী পাওয়া যায়। তা চিয়াং কোম্পানির তৈরি ড্রোন টানা কয়েক বছর বিশ্ব ড্রোন বাজারের ৭০ শতাংশের বেশি দখল করে আছে। অনেক হলিউড তারকা 'সাইবেক্স' ব্র্যান্ডের স্ট্রোলার এবং শিশু নিরাপত্তা চেয়ার ব্যবহার করে এবং এ ব্র্যান্ডও চীনের।

আগে চীন ছিল বিশ্বের কারখানা। বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানি চীনে উত্পাদন বেস স্থাপন করে তখন। কারণ, চীনের শ্রম তুলনামূলকভাবে সস্তা। তখন বিদেশি ব্র্যান্ডের পণ্য তৈরি করা হতো চীনে, কিন্তু মুনাফা ছিল তাদের। আর অধিকাংশ চীনা ব্র্যান্ড আজকাল সাফল্য অর্জন করছে। তাদের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।

চীনা কোম্পানিগুলো চীনা ব্র্যান্ডকে কীভাবে দেশে ও বিদেশে জনপ্রিয় করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে অনেকগুলো কারণ উল্লেখ করা যায়। চীনা কোম্পানিগুলো গবেষণার ওপর গুরুত্ব দেয়। ২০১৫ সালে চীনারা জাপানে গিয়ে স্মার্ট টয়লেট কভার দেখে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা প্রচার করে। বিষয়টা তখন ভাইরাল হয়। অথচ তখন চীনেও ভালো মানের স্মার্ট টয়লেট কভার তৈরি হচ্ছিল! কিন্তু চীনারা সে সম্পর্কে ছিল অজ্ঞ। যাই হোক, ওই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর চীনে তৈরি স্মার্ট টয়লেট কভারসহ নানা পণ্য জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে।

চে চিয়াংয়ের একটি কোম্পানি ১৯৯৮ সাল থেকে এ পণ্য উত্পাদন শুরু করে। তবে কোম্পানির টানা লোকসান হচ্ছিল। কোম্পানিকে অন্য পণ্য তৈরির মাধ্যমে লোকসান সামলাতে হয়। শুধু তাই নয়, কোম্পানি লোকসানি পণ্যটি তৈরি বন্ধ করেনি। কারণ, কোম্পানির গবেষণা অনুসারে, একসময় পণ্যটি বাজার পাবে। বস্তুত, এই কোম্পানি প্রতিবছরের লাভের ৯-১০ শতাংশ গবেষণায় বিনিয়োগ করে।

চীনা কোম্পানিগুলো নিজেদের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পণ্য তৈরির চেষ্টা করে। একই ধরনের পণ্য তৈরি করলেও, বিভিন্ন কোম্পানি ভিন্ন ভিন্ন বাজারকে টার্গেট করে নিজেদের পণ্য ডিজাইন করে। দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের একটি গাড়ি কোম্পানির দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, "সকল গাড়ি কোম্পানি হাই-এন্ড গাড়ি করে, তা নয়। আমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় পণ্য ৩৫ হাজার ইউয়ানের একটি মিনিভ্যান। এখন চীনের বড় শহরে মালবাহী ট্রাকের চলাচল সীমিত হয়ে যাওয়ায়, এই মিনিভ্যান পণ্য পরিবহনের জন্য প্রয়োজন।"

বোস্টন পরামর্শ ও আলিবাবা গবেষণালয় যৌথভাবে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ভোগ্যপণ্য ও সেবা নেওয়ার সময় ভোক্তারা যে-চারটি বিষয়কে আমলে নেয়, সে চারটি বিষয় হচ্ছে: হাই-এন্ড সেবা ও পণ্য, স্বাস্থ্য ও মানসম্পন্ন জীবনরীতি, সাশ্রয়ী মূল্য ও উপভোগ ভোগ্য এবং জীবনের প্রয়োজনীয়তা। লাক্সারি পণ্য, জৈব খাদ্য, জলখাবার এবং শ্যাম্পু এ চারটি চাহিদা পূরণকারী চার ধরনের পণ্য। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, যারা লাক্সারি পণ্য কিনে, তারা বাকি তিন ধরনের পণ্যও অনেক কিনে থাকে।

চীনা কোম্পানির ব্যবস্থাপনার ধারণাও অনেক বদলে গেছে। অনেক ব্র্যান্ড এখন চীনের বড় শহরের মূল রাস্তায় দোকান খুলেছে। সব জায়গায় দোকান বা শোরুমগুলো দেখতে একই রকম। দেখতে বিদেশি ব্র্যান্ডের মতো লাগে।

২০১৭ সালের চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদ প্রতিবছরের ১০ই মে-কে 'জাতীয় ব্র্যান্ড দিবস' হিসেবে নির্ধারণ করে এবং তথ্যমাধ্যমও এখন চীনা ব্যান্ডের ওপর অনেক গুরুত্ব দিচ্ছে।

দেশি ব্র্যান্ডের প্রতি চীনাদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। তবে স্বীকার করতে হবে যে কোনো কোনো পণ্য, বিশেষ করে হাই-এন্ড পণ্য উত্পাদনের ক্ষেত্রে চীনা কোম্পানিগুলো সঙ্গে বিদেশি কোম্পানিগুলোর পার্থক্য আছে।

পণ্য ও নকশার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যেমন, অ্যাপল কোম্পানি আসলে একটি 'নকশা কোম্পানি'। নকশা এই কোম্পানির কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর চীনা কোম্পানিগুলো কী ধরনের পণ্য উত্পাদনে সক্ষম, তা বিবেচনায় রেখে পণ্যের নকশা করে।

তা ছাড়া, বিদেশি ব্র্যান্ড বিশেষ ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সংস্কৃতি তৈরি করতে চেষ্টা করে। আপনি একটি পণ্য কিনলে এ কোম্পানির সংস্কৃতি ও ধারণার প্রতি সেটা হবে এক ধরনের স্বীকৃতি। এটা একটি অতিরিক্ত মূল্য। চীনের নিজের ব্র্যান্ড উন্নয়ন করতে হলে নিজস্ব সংস্কৃতিকে ব্যবহার করতে হবে।

ব্র্যান্ড গড়ে তোলা একটি দীর্ঘমেয়াদি কাজ। ব্র্যান্ড গড়ে তুলতে কোম্পানিকে অবিরাম অর্থ ও সময় ব্যয় করতে হয়। পাশাপাশি, সরকারি সমর্থনও প্রয়োজন। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040