নারী ভলিবল খেলোয়াড় ও অলিম্পিক গেমস চ্যাম্পিয়ন লাং পিংয়ের গল্প।
  2019-10-11 19:01:38  cri

লাং পিং, ১৯৬০ সালের ১০ ডিসেম্বর চীনের থিয়ানচিন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চীনের নারী ভলিবল খেলোয়াড় ও অলিম্পিক গেমস চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। বর্তমানে তিনি হলেন চীনের ভলিবল দলের প্রধান কোচ, চীনের ভলিবল একাডেমির প্রধান এবং চীনের ভলিবল সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান।

১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে, লাং পিং বেইজিং শ্রমিক স্টেডিয়ামের যুব ক্রীড়া স্কুলের ভলিবল ক্লাসে ভর্তি হন। সেখানেই তিনি ভলিবল খেলা শিখতে শুরু করেন। ১৯৭৬ সালে, লাং পিং বেইজিং সৌখিন ক্রীড়া স্কুলে ভর্তি হন। একই বছর তাকে বেইজিং ভলিবল দলের জন্য নির্বাচিত করা হয়।

১৯৭৮ সালে লাং পিং চীনের রাষ্ট্রীয় ভলিবল দলে যোগ দিতে সক্ষম হন। ১৯৮১ সালে, তিনি চীনের রাষ্ট্রীয় ভলিবল দলের সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। তিনি সেবারের প্রতিযোগিতায় 'শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের' পুরস্কারও লাভ করেন।

১৯৮২ সালে লাং পিং চীনের রাষ্ট্রীয় ভলিবল দলের সঙ্গে নবম বিশ্ব নারী ভলিবল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন, তিনি নিজেও বিশ্ব নারী ভলিবল প্রতিযোগিতা 'এমভিপি অর্থাত্ Model-View-Presenter'-এর মর্যাদা পান। ১৯৮৪ সালে লাং পিং চীনের রাষ্ট্রীয় ভলিবল দলের সঙ্গে লস এ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেমসের নারী ভলিবল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে স্বর্ণপদক জয় করেন। তাঁর সাহায্যে চীনের নারী ভলিবল দল তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছে। ১৯৮৬ সালে তিনি চীনের নারী ভলিবল দল থেকে অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।

১৯৯৫ সালে লাং পিং চীনের রাষ্ট্রীয় নারী ভলিবল দলের প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্ব পান। ১৯৯৬ সালে, তিনি আন্তর্জাতিক ভলিবল লিগ প্রদত্ত 'বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কোচের' মর্যাদা লাভ করেন। ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে, তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে the Volleyball Hall of Fame-এ নির্বাচিত করা হয়। তিনি এই মর্যাদা পাওয়া এশিয়ার প্রথম ভলিবল খেলোয়াড়। ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল, লাং পিংকে আবারও চীনের নারী ভলিবল দলের কোচ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, লাং পিং চীনের কেন্দ্রীয় টেলিভিশন সিসিটিভি থেকে শ্রেষ্ঠ কোচের পুরস্কার অর্জন করেন। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, লাং পিং 'চীনকে মুগ্ধ করা' বার্ষিক ব্যক্তির মর্যাদা পান।

সে বছরের মার্চ মাসে, লাং পিং 'বিশ্বকে প্রভাবিত করা চীনার পুরস্কার' জয় করেন। পরবর্তী অগাস্ট মাসে, লাং পিং প্রধান কোচ হিসেবে চীনের নারী ভলিবলের নেতৃত্ব দিয়ে রিও অলিম্পিক গেমস চ্যাম্পিয়ন হন।

২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, লাং পিং আবারও সেই বছর 'চীনকে মুগ্ধ করা' বার্ষিক ব্যক্তির মর্যাদায় ভূষিত হন। ২০১৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর চীন সরকার লাং পিংকে চীনের সংস্কারে অগ্রণী হিসেবে পদক প্রদান করে। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে, লাং পিং চীনের অলিম্পিক গেমস কমিশনের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, লাং পিং চীনের নারী ভলিবল দলের নেতৃত্ব দিয়ে নারী ভলিবল বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এবারের বিশ্বকাপে চীনা নারী ভলিবল দল ১১টি ম্যাচের সবগুলোতে জয়ী হয়েছে।

বলা যায়, চীনের নারী ভলিবল দল চীনাদের মনে গর্বের প্রতীক। আর লাং পিং হলেন এই দলের প্রতিনিধিত্বকারী মানুষ। তার কাছে, অলিম্পিক চেতনা হলো অংশগ্রহণ, শুধু চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চিন্তাটা সঠিক নয়।

প্রথমবার অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণ করে তিনি স্বর্ণপদক পান। লাং পিং বলেন, তখন তিনি অসীম গর্ব বোধ করেন। তবে ১৯৮৮ সালে সিউল অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণ করে তিনি অলিম্পিক গেমস সম্বন্ধে নতুন উপলব্ধি পান।

১৯৮৫ সালে লাং পিং চীনের নারী ভলিবল দল থেকে অস্থায়ীভাবে অবসর নেন। ১৯৮৬ সালে তিনি চীনা নারী ভলিবল দলের সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করতেন। তবে, ১৯৮৮ সালে চীনের নারী ভলিবল দল সিউল অলিম্পিক গেমসে শুধু তৃতীয় পুরস্কার পায়। তখন দেশে নারী ভলিবল দলের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ছিল। লাং পিং অলিম্পিক গেমস সম্বন্ধে নতুন উপলব্ধি অর্জন করেন। আগে তার ধারণা ছিল, শুধু স্বর্ণপদকই সম্মানজনক। তবে, দলের সবাই প্রতিযোগিতার জন্য কঠোর প্রশিক্ষণ নেয়, প্রতিযোগিতার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে। তাই সবার পরিশ্রমই সম্মানজনক। তাই রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদকও খুব মর্যাদাপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।

লাং পিং বলেন, ক্রীড়ার আসলে নিয়ম আছে। ভালোর সময় আছে, মন্দার সময়ও আছে। অলিম্পিক গেমসে অংশ নিতে পারাটা আসলে খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার। অনেক খেলোয়াড় আসলে খুব দক্ষ, তবে ভাগ্য মন্দ হওয়ায় অলিম্পিক গেমসে অংশ নিতে পারে না। তাই তিনি জানতে পারেন, অংশগ্রহণ করলে অগ্রগতি অর্জন করা যায়। আপনি পরিশ্রম করলে আপনাকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। তার মতে: অলিম্পিক গেমসের চেতনা হলো অংশগ্রহণ; আর অংশগ্রহণ করাটাই সাফল্য।

প্রথম অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণের স্মৃতি:

সেসময়ের কথা স্মৃতিচারণ করে লাং পিং বলেন, চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার আগে তার অ্যাপেনডিসাইটিসের ব্যথা শুরু হয়। তবে অলিম্পিক গেমসের জন্য তার সব ব্যথা যেন দূর হয়ে যায়।

তিনি বলেন, ১৯৮০ সালের অলিম্পিক গেমসে আমরা অংশ নেই নি। তাই ১৯৮৪ সালে যখন আমাদের অলিম্পিক গেমসে অংশ নেওয়ার সুযোগ আসে, তখন সবাই খুব পরিশ্রম শুরু করে। কারণ, খেলোয়াড়দের ক্রীড়া জীবন বেশি দীর্ঘ নয়। জীবনে দুইবার বা একবার অলিম্পিক গেমসে অংশ নেওয়ার সুযোগ আসে। তখন আমাদের চাপ অনেক বেশি হয়, দেশ এবং দেশের জনগণ আমাদের ওপর খুব আশা করে। আমাদের খাওয়া এবং ঘুমানোর সময়ও মাথায় শুধু অলিম্পিক গেমস থাকে। সেই বছরের অলিম্পিক গেমসের প্রতিযোগিতার সময় আমার শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল না; আপেনডিসাইটিস ব্যথার কারণে আমার অত্যন্ত কষ্ট হতো। এখন মনে হলে আমার খুব ভয় লাগে, এ অবস্থায় কীভাবে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া যায়!

তবে তখন আমার মনে, অলিম্পিক গেমসে অংশ নেওয়া মানে দেশের জন্য গর্ব ও মর্যাদা অর্জন করা। তাই আমার কোনো ভয় নেই। আমাদের স্লোগান, কঠিনতাকে ভয় পাবো না, কোনো কিছুকেই ভয় পাবো না। তাই আমার ব্যথাকেও পরাজিত করি।

পদক প্রদান মুহূর্তের কথা স্মরণ করে লাং পিং বলেন, পদক প্রদানের মঞ্চে ওঠার অনুভূতি খুব ভালো। তখন আমার মনে হলো, আমার এ জীবন সত্যিই চমৎকার হয়েছে। স্বর্ণপদক পেয়ে আমি অনেকক্ষণ তা দেখেছি। তখন, পদক প্রদান মঞ্চে আমি হাসতেও পারি নি, কারণ, প্রথমবার স্বর্ণপদক পাওয়ার কারণে জানতাম না— এমন গুরুগম্ভীর অনুষ্ঠানে হাসি ঠিক কিনা!

ভলিবল দলের একজন খেলোয়াড়ের কাছে লাং পিং সবচেয়ে প্রিয় মানুষ

দৈনন্দিন জীবনে, খেলোয়াড়দের মধ্যে লাং পিং যেন 'বড় বোন'এর মতো। তাদের সমস্যা থাকলে, তাদের কষ্ট হলে, সবকিছুই লাং পিংকে জানানো যায় এবং লাং পিং নিশ্চয়ই তাদের সাহায্যের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। সময় পেলেই লাং পিং পার্টির আয়োজন করেন, যাতে সবাই একসাথে আরামে সময় কাটাতে পারে। এ ছাড়া, লাং পিং সবসময় নিজের বাসায় রান্না করে খেলোয়াড়দের খাওয়ান। তিনি মনে করেন, নারী ভলিবল দলের খেলোয়াড়ের জন্য প্রতিদিনের প্রশিক্ষণ অনেক কঠিন এবং ক্লান্তিকর! তাই সুযোগ পেলে তিনি খেলোয়াড়দের অনেক যত্ন নেন।

যারা লাং পিং-এর সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন, তারা সবাই লাং পিং-এর প্রশংসা করেন। লাং পিং-এর নেতৃত্বে, খেলোয়াড়রা উন্নয়নের সুন্দর ভবিষ্যত্ খুঁজে পান, অন্তরঙ্গ যত্নও পান। লাং পিংয়ের 'পরিবারের মতো পরিচালনা' ব্যবস্থা সবার মন জয় করেছে। লাং পিং-এর দলে যোগ দেয়া হলো চীনে ভলিবল মহলের সব খেলোয়াড়ের চূড়ান্ত স্বপ্ন।

বিশ্ব ভলিবল মহলের 'জাদুকর'

বিশ্ব ভলিবল মহলে লাং পিং 'জাদুকর' হিসেবে পরিচিত। তিনি চীনের নারী ভলিবল দলকে চূড়ান্ত মন্দাবস্থা থেকে উদ্ধার করেছেন। যখন তিনি মার্কিন নারী ভলিবল দলের কোচ ছিলেন, তখন তাঁর নেতৃত্বে মার্কিন নারী ভলিবল দলও অলিম্পিক গেমসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।

লাং পিং বলেন, আমাকে 'জাদুকর' বলা অতিরিক্ত প্রশংসা! তবে ২০০৯ সালে আমি অল্প সময়ের মধ্যে চীনের প্রথম পেশাদার ভলিবল ক্লাব গঠন করতে পেরেছিলাম। এটা আমার খুব ভালো লাগে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমরা ভালো সাফল্য পেয়েছি।

আহত খেলোয়াড়দের সহায়তায় 'লাং পিং তহবিল' গঠন

আহত এবং অসুস্থ খেলোয়াড়দের সাহায্য করার জন্য ২০১০ সালে 'লাং পিং তহবিল' গঠন করেন তিনি। যাতে আহত খেলোয়াড়ের সুস্থতায় সহযোগিতা করা যায়, অবসরে যাওয়া খেলোয়াড়দের আর্থিক সহায়তা দেওয়া যায়, এ ছাড়া চীনের চিকিৎসা প্রযুক্তির মান উন্নয়ন এবং দরিদ্র অঞ্চলের ক্রীড়া ব্রত উন্নয়নেও সাহায্য করা যায়।

 

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040