প্রাচীনকাল থেকেই চীনা মানুষ নামের ওপর বেশ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। নাম পরিবারের ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক প্রবণতা, এমনকি জ্যোতির্বিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত। ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর, অনেকে তাদের শিশুদের নাম রাখেন চিয়ান কুও, চিয়ান হুয়া, ইত্যাদি। আবার অনেকে নাম রাখেন 'চিয়ে ফাং', যার অর্থ মুক্ত করা।
২০১৯ সালের পয়লা অক্টোবর পালিত হবে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৭০তম বার্ষিকী। সম্প্রতি বিদেশে আমরা চিয়ান কুও নামক একজন চীনা নাগরিকের সাক্ষাত্কার নিয়েছি। তিনি চীন ও বিদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ বিনিময়ের দূত হিসেবে কাজ করছেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের উন্নয়ন বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষের পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। হু নানের নাগরিক ছাও চিয়ান কুওয়ের সুখী জীবনও অর্জিত হয়েছে তার সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে। তিনি ছোট একটি গ্রাম থেকে বিদেশে আসেন।
২০১৯ সালের শরত্কাল। চীনের হাজার হাজার পরিবার ঐতিহ্যিক মধ্য-শরৎ উত্সবের সময়ে পুনর্মিলিত হয়। একই সময় পাকিস্তানের মধ্যাঞ্চলের মুলতানে ৫৬ বছর বয়সী ছাও চিয়ান কুও কয়েকজন কর্মী নিয়ে সড়কপথের কাজ করছিলেন। পেশোয়ার-করাচি সড়কপথ হচ্ছে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের বৃহত্তম একটি অবকাঠামো প্রকল্প এবং ছাও চিয়ান কুও এ প্রকল্পের একজন নির্মাতা। প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ের আগে শেষ হয়েছে। তবে ছাও চিয়ান কুও ও তার দলকে শেষ দিকের কিছু কাজ করতে হয়। মুলতানের তাপমাত্রা সারা বছর ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি থাকে এবং বছরে সেখানে মাত্র ৫-৬ বার বৃষ্টিপাত হয়। তীব্র রোদে, ছাও চিয়ান কুও পাককর্মীদের সঙ্গে কাজ করছিলেন।
পেশোয়ার-করাচি সড়কপথ উচ্চ মানের এবং সম্পূর্ণ কার্যকরী একটি সড়কপথ। এর নির্মাণকাজ খুব দ্রুত গতিতে এগিয়েছে বলে পাকিস্তানের নানা মহলে ব্যাপক প্রশংসা পা ছাও চিয়ান কুওর মতো পেশাদার প্রযুক্তিবিদের বড় ভূমিকা ছিল।
ছাও চিয়ান কুও হুনান প্রদেশের একটি গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবারের ছেলে। তিনি কখনও ভাবেননি ভবিষ্যতে একদিন তিনি বিদেশে চীনা নির্মাণকাজের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবেন। তিনি বলেন,"আমি গ্রামে বড় হয়েছি। হু নান প্রদেশের ইউয়ে ইয়াং অঞ্চলের একটি গ্রাম। আমার আরও ৪ জন ভাই-বোন আছে। আমি ১৯৬৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করি এবং তা গণপ্রজতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ১৪তম বার্ষিকীর দুদিন আগে। তাই আমার বাবা-মা আমার নাম রাখেন চিয়ান কুও।"
ছাও চিয়ান কুওর পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম কৃষক এবং গ্রামে ছিলেন। তবে চিয়াং বাইরের জগতটা দেখতে চেয়েছিলেন। তার বাবা-মা তাকে সমর্থন দেন। ১৮ বছর বয়সে ছাও চিয়ান কুও গ্রাম ছেড়ে বাইরে যান। তিনি কুয়াং চৌ, তুং কুয়ান, শেনচেনসহ নানা শহরে গিয়েছেন এবং নানা ধরনের কাজ করেছেন। ১৯৯১ সালে, ২৮ বছর বয়সে ছাও চিয়ান কুও কাঠমিস্ত্রী হিসেবে ইউয়ে ইয়াং শহরে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন।
১৯৯৫ সালে তিনি বন্ধুর সঙ্গে একটি নির্মাণ কোম্পানি খোলেন। ২০০৭ সালে, তিনি একজন সহপাঠির সঙ্গে রিয়াল এস্টেট ব্যবসা শুরু করেন। তারা একটি ভবন নির্মাণ করেন। একটি ফ্লাট ছাড়া বাকিগুলো বিক্রয় করেন ছাও চিয়ান কুও । পরে তার ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়। ২০১৬ সালে, তিনি ২০ জন কর্মী নিয়ে পাকিস্তানে আসেন পেশোয়ার-করাচি সড়কপথ নির্মাণকাজে অংশগ্রহণ করতে।
আকস্মিক এক সুযোগে তিনি পাকিস্তানে আসেন। ছোটবেলা থেকে তিনি বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। ১৯৭৯ সালে, চীনে চালু হয় সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি। ছাও চিয়ান কুও বলেন"মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার সময়, এক শিক্ষক আমাদেরকে নিয়ে একটি কারখানা পরিদর্শন করতে যান। ওখানে আমি প্রথম একজন বিদেশি দেখি এবং তিনি আমাদেরকে দেখান অনেক মজার ও নতুন জিনিস। তখন আমি ভাবলাম, বড় হলে বিদেশে নিশ্চয় একবার যাব এবং ওখানে কিছু লেখাপড়া করব।"
এখন ছাও চিয়ান কুও বিদেশে আছেন এবং তিনি বিদেশের নির্মাণকাজে জড়িত আছেন। তিনি ৩ বছর ধরে পাকিস্তানে আছেন এবং তার পরিশ্রম, আন্তরিকতা ও সহৃদয়তা সহকর্মীদের মনে গভীর ছাপ ফেলে। ওয়াং হুয়া ছিং তার একজন সহকর্মী। তিনি বলেন"চিয়ান কুও খুব পরিশ্রমী ও কর্মনিষ্ঠ একজন মানুষ। তিনি আন্তরিক ও হৃদয়বান এবং সবসময় অন্যের কথা চিন্তা করেন। কখনও কখনও আমরা নির্মাণস্থলে এসে সবার মধ্যে কিছু হিটস্ট্রোক প্রতিরোধক খাবার বিতরণ করি। প্রতিবার চিয়ান কুও খাবারগুলো অন্য কর্মীদেরকে দিয়ে দেন। সব কর্মী খাবার পেলে, তিনি নিজের ব্যাগ থেকে একটি পানির বোতল বের করে আমাকে বলেন, আমি পানি খাই।"
বিদেশি সহকর্মীরাও ছাও চিয়ান কুওর মাধ্যমে চীনা মানুষের আত্মা অনুভব করেন। পাকিস্তানী কর্মী কাসির আব্বাস বলেন,"চীনা কর্মীদের সঙ্গে থেকে আমি পরিবারের উষ্ণতা অনুভব করতে পারি। চীনা মানুষ শিক্ষিত ও মার্জিত। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং উত্থাপিত 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী সফলতা অর্জন করছে। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর অর্থনীতির উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ১৯৮০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত, চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বার্ষিক গড়ে ১০ শতাংশ ছিল। এর সঙ্গে অন্য কোনো দেশের অর্জনের তুলনা চলে না।"
বিদেশি কর্মীরা চীনের প্রশংসা করেন দেখে ছাও চিয়ান কুও খুব গর্ব বোধ করেন। মাতৃভূমি শক্তিশালী বলেই ছাও চিয়ান কুও বিদেশে কাজ করার সুযোগ পান এবং নিজের জন্য একটি সুখী জীবনের সন্ধান পান। ছাও চিয়ান কুও বলেন, তিনি বিদেশে আরও বেশি নির্মাণকাজে অংশগ্রহণ করতে চান এবং আরও বেশি দেশে যেতে চান। (শিশির/আলিম/রুবি)