ইউয়ান লুং পিং ১৯৩০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর চীনের বেইজিংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হলেন চীনের সংকর ধান বিশেষজ্ঞ, চীনের সংকর ধান গবেষণা ও উন্নয়নের প্রতিষ্ঠাতা, তাকে 'বিশ্বের সংকর ধানের পিতা' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি হলেন চীনের রাষ্ট্রীয় সংকট ধান প্রকল্প ও গবেষণা কেন্দ্র এবং হুনান প্রদেশের সংকর ধান গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক মহাপরিচালক, চীনের ইঞ্জিনিয়ারিং একাডেমির একাডেমিশিয়ান।
বলতে গেলে চীনাদের নিজের খাবার সমস্যা সমাধান করেছেন তিনি। ৯০ বছর বয়সী 'সংকর পিতা' ইউয়ান লুং পিং মনে করেন, এটি দেশের জন্য তাঁর দায়িত্ব। চীনের রাষ্ট্রীয় খাদ্য নিরাপত্তা সম্পর্কে তাঁর এমন দায়িত্বশীল মনোভাব কখনই পরিবর্তিত হয় নি।
ইউয়ান লুং পিং চীনের প্রথম সর্বোচ্চ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পুরস্কার, 'সংস্কারের অগ্রণী' এবং ভবিষ্যত বিজ্ঞান পুরস্কারসহ বিভিন্ন গৌরবময় খেতাব পেয়েছিলেন। নয়া চীন প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পূর্তিতে তিনি আবারও 'চীনের রাষ্ট্রীয় পদক' পেয়েছেন। প্রথম দফা সুপার ধান থেকে চতুর্থ দফার সুপার ধান পর্যন্ত, প্রতি হেক্টর ১৬ টন, ১৭ টন এবং ১৮ টনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা পর্যন্ত, চীনের সংকর ধান গবেষণা কাজের মান সবসময় বিশ্বের শীর্ষ স্থানে রয়েছে। ইউয়ান লুং পিং মনে করেন, নিজের প্রিয় মাতৃভূমি হলো তার সবসময় পরিশ্রমের চালিকাশক্তি।
দেশের জন্য অবদান রাখায় কৃষিকে বাছাই করা সিদ্ধান্ত
ইউয়ান লুং পিং গোলযোগের যুগে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তিনি পরিবারের সঙ্গে নিরাপদ স্থান পাওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে পালিয়ে জীবন কাটাতেন। তিনি গভীরভাবে অনুভব করেন যে, নিজের দেশকে আগে শক্তিশালী করতে হবে। নয়া চীন প্রতিষ্ঠার আগে, ইউয়ান লুং পিং স্বচক্ষে দেখেছেন, দুর্ভিক্ষের কারণে রাস্তার পাশে মানুষের মৃতদেহ। তা দেখে তিনি খুবই মর্মাহত হন। আগে ইউয়ান লুং পিং-এর ক্রীড়া অথবা সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে দেশের জন্য অবদান রাখার ইচ্ছা করতেন। তবে এ অবস্থা দেখে তিনি কৃষিকে বাছাই করেন। কারণ তিনি চীনাদের খাবারের সমস্যা সমাধান করতে চান। তিনি আশা করেন, চীনারা আর ক্ষুধার্ত থাকবে না।
১৯৫৩ সালে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিম কৃষি ইন্সটিটিউট (বর্তমানের দক্ষিণ-পশ্চিম বিশ্ববিদ্যালয়' থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর ইউয়ান লুং পিং হুনান প্রদেশের আনচিয়াং কৃষি স্কুলে কাজ করতে শুরু করেন। তিনি বলেন, নয়া চীনের প্রথম দফা কৃষিবিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছাত্র হিসেবে, আমি সিদ্ধান্ত নেই যে, চীনের খাদ্য উত্পাদনের পরিমাণ বাড়ানোর সমস্যা সমাধান করবো এবং এর ফলে চীনারা আর ক্ষুধার্ত থাকবে না।
১৯৫৬ সালে ইউয়ান লুং পিং তার শিক্ষার্থীদের নিয়ে কৃষি পরীক্ষা শুরু করেন। তিনি আবিষ্কার করেন যে, ভিন্ন ধানের সঙ্করীকরণের সুবিধা আছে। তিনি মনে করেন, এটাই হলো ধান উত্পাদনের পরিমাণ বাড়ানোর গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। তখন থেকে সংকর ধান চাষ করার চেতনা তার মাথায় ঢুকে যায়।
১৯৬৬ সালে ইউয়ান লুং পিং 'ধানের পুং বন্ধ্যাত্ব' নামে গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তখনই মূলত চীনের সংকর ধান গবেষণার সূচনা উন্মোচিত হয়।
গবেষণার সময়ের কথা স্মরণ করে ইউয়ান লুং পিং বলেন, তখন তিনি কয়েক মাসের জন্য খাবার নিয়ে কয়েক দিনের ট্রেন করে চীনের ইয়ুননান, হাইনান ও কুয়াংতুং প্রদেশসহ বিভিন্ন জায়গায় যান। শুধুই ধানের জন্য উপযোগী সূর্যের আলো খুঁজতে থাকেন তিনি। তিনি বলেন, এমন অভিজ্ঞতা যে 'সূর্যের পিছে পিছে যাযাবর পাখির মতো ছুটে চলা'।
সুপার ধান জনপ্রিয়করণ
১৯৭৩ সালে ইউয়ান লুং পিং-এর গবেষণায় সংকর ধান প্রথমে চীনের হুনান প্রদেশে চাষ করা হয়। এরপর সারা চীনে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তখন ৬৬৬ বর্গমিটার (অর্থাত্ চীনের হিসাবে এক মু)তে ধানের উত্পাদন অনেক বেড়ে যায়। ১৯৭৬ সালে ২৩১ কেজি, ১৯৮৪ সালে ৩৫৮ কেজি, ১৯৯৮ সালে ৪২৪ কেজি....।
১৯৯৬ সালে চীনের কৃষি মন্ত্রণালয় সুপার ধান পরিকল্পনা উত্থাপন করে। ইউয়ান লুং পিং-এর বিজ্ঞান গবেষণাদল সাফল্যের সঙ্গে সুপার ধান পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। এখন সুপার ধান পরিকল্পনার পাঁচ পর্যায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়িত হয়েছে। তা হল ৬৬৬ বর্গমিটার জমিতে ধানের উত্পাদন ৭০০ কেজি, ৮০০ কেজি, ৯০০ কেজি, ১০০০ কেজি এবং ১১০০ কেজি।
ইউয়ান লুং পিং বলেন, আমি আশা করি চলতি বছর প্রতি হেক্টরে ধান উত্পাদনের পরিমাণ ১৮ টন হবে, যাতে নয়া চীন প্রতিষ্ঠার ৭০ বছরে নতুন অবদান রাখা যায়।
পরিশ্রমী পদক্ষেপ থামানো যায় না: যথেষ্ট খাবার থেকে ভালো খাবার এবং স্বাস্থ্যকর খাবারের লক্ষ্য বাস্তবায়ন
এখন সংকর ধান উত্পাদনের পরিমাণ পরীক্ষামূলকভাবে প্রতি হেক্টর জমিতে ১৮ টন হয়েছে। তবে ইউয়ান লুং পিং এতে সন্তুষ্ট হন নি। তিনি বলেন, আগামীতে প্রতি হেক্টরে ১৯ টন এবং ২০ টন লক্ষ্যের জন্য চেষ্টা করতে হবে।
'যথেষ্ট খাবারের' সমস্যা সমাধানের পর ইউয়ান লুং পিং 'ভালো খাবার' এবং 'স্বাস্থ্যকর খাবারের' ওপর আরো বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাঁর নেতৃত্বে, এক যুগ ধরে চাষ করা সুপার ধান আগের উত্পাদনের পরিমাণের চেয়ে পরিবেশবান্ধব হচ্ছে।
তাঁর ৯০ বছর বয়সের জন্মদিনের প্রত্যাশা সম্বন্ধে ইউয়ান লুং পিং বলেন, তার দু'টি স্বপ্ন আছে। একটি হলো 'ধানের নিচে বসে ঠান্ডা বাতাস উপভোগ করা', আরেকটি হল 'সারা বিশ্বে সংকর ধান জনপ্রিয় করা'।
প্রথমটা হলো ইউয়ান লুং পিং-এর সত্যিকার স্বপ্ন। তিনি ঘুমের স্বপ্নে দেখেছেন যে, তার পরীক্ষামূলক ক্ষেতে সুপার সংকর ধান মানুষের চেয়েও লম্বা। তিনি এবং তার সহকারীরা ধানের নিচে বসে ঠান্ডা বাতাস উপভোগ করেছেন।
আরেকটি স্বপ্ন হল সারা বিশ্বে সুপার সংকর ধান জনপ্রিয় করা এবং বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তায় অবদান রাখা। তিনি বলেন, 'বিশ্বে ১৬ কোটি হেক্টর ধানের ক্ষেত আছে। যদি এতে অর্ধেক ক্ষেতে সুপার সংকর ধান চাষ করা যায়, প্রতি হেক্টরে ধানের উত্পাদন ২ টন বৃদ্ধি পেলে প্রতি বছর আরো ৫০ কোটি মানুষের খাবার সমস্যা সমাধান করা যাবে। ইউয়ান লুং পিং-এর মতে, সংকর ধান উন্নত করা বিশ্বের খাদ্যাভাব সমস্যা সমাধানে বিরাট অবদান রাখতে পারবে। জানা গেছে, ১৯৭৯ সালে চীনের সংকর ধান প্রথমবারের মতো বিদেশে পাঠানো হয়। সংকর ধান বিশ্বের ডজনখানেক দেশ ও অঞ্চলে গবেষণা ও জনপ্রিয় হয়েছে। বিদেশে ৭০ লাখেরও বেশি হেক্টর জমিতে এই ধান চাষ করা হচ্ছে।
এখন এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হচ্ছে। চলতি বছর ইউয়ান লুং পিং-এর নেতৃত্বে চীনের বিশেষজ্ঞরা মাদাগাস্কারে ৫ হেক্টর জমিতে সংকর ধান চাষ করছেন, প্রতি হেক্টরে ধান উত্পাদনের পরিমাণ ১০.৮ টন। যা স্থানীয় সাধারণ ধান উত্পাদন পরিমাণের তুলনায় তিন গুণেরও বেশি। তা আফ্রিকার খাদ্য সমস্যা সমাধানের নতুন আশা সৃষ্টি করেছে। আফ্রিকার বন্ধুরা চীনের সুপার সংকর ধানকে 'পূর্বের অসাধারণ ধান' হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
বিশ্ব খাদ্য তহবিলের চেয়ারম্যান ইউয়ান লুং পিং-এর ৯০ বছর বয়সের জন্মদিনে লেখা এক অভিনন্দনবাণীতে বলেন, ২০০৪ সালে গৌরবান্বিত হয়ে আমরা আপনাকে বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার প্রদান করেছিলাম। যাতে সংকর ধানের পিতা হিসেবে আপনার অর্জনের অতুলনীয় সাফল্যের প্রশংসা করা যায়। তারপর ১৫ বছর পার হয়ে গেছে। ১৫ বছরে আপনি এখন ধান গবেষণা ক্ষেত্রে নতুন সাফল্য অর্জন করছেন এবং মানবজাতির কল্যাণ করে যাচ্ছেন।
এটা হলো 'সংকর ধানের পিতাকে' এই বিশ্বের পক্ষ থেকে জানানো শ্রদ্ধা।
চরম অবস্থায় ধান চাষের সফলতা
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, লোনা পানিতে ধান চাষের পরীক্ষা সফল হয়। যা চীনের 'সংকর ধানের পিতা' ইউয়ান লুং পিংয়ের প্রযুক্তি দলের সর্বশেষ চেষ্টা 'সমুদ্র পানি ধান'।
৬৬৬ বর্গমিটার জমিতে ৬২০.৯৫ কেজি ধান উত্পাদন করা যায়।
২০১৮ সালের মে মাসে ইউয়ান লুং পিং-এর দল মরুভূমিতে ধান চাষের পরীক্ষা করে এবং তা সফলও হয়। এতে প্রতি ৬৬৬ বর্গমিটারে ৫শ কেজি ধান উত্পাদিত হয়। এর মাধ্যমে বিশ্বে প্রথমবারের মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মরুভূমিতে ধান চাষের পরীক্ষা করা হয়। এটি মরুভূমি অঞ্চলে খাদ্য উত্পাদানের সামর্থ্য বাড়ায় এবং বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা ও মরুভূমির প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়নে 'চীনের অবদান'।
ভবিষ্যত সম্পর্কে ইউয়ান লুং পিং বলেন, আমি আশা করি ১০০ বছর বয়স পর্যন্ত যেতে পারবো। আমি চীনের ভবিষ্যত্ সম্পর্কে খুব আশাবাদী। আমি দেশের সমৃদ্ধির জন্য আরো বেশি অবদান রাখতে চাই।
(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)