ক্রীড়ার উন্নয়ন একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। চীনের ক্ষেত্রেও কথাটা প্রযোজ্য। চার দশক আগে সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া শুরুর পর চীন অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেছে। এখন চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতেও চীন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চীন বিশ্বের সকল দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। ক্রীড়া বা খেলাধুলায়ও পিছিয়ে নেই চীন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি চীন এখন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ক্রীড়া-পরাশক্তি। ২০০৮ সালের অলিম্পিক গেম্সে চীন চ্যাম্পিয়ন হয়।
সম্প্রতি চীনে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংখ্যালঘু জাতির গেম্স। গণপ্রজাতান্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর ১৯৫৩ সালে চীনে প্রথম জাতীয় সংখ্যালঘু জাতির গেমস অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এবার অনুষ্ঠিত হয় একাদশ জাতীয় সংখ্যালঘু গেমস।
এবারের গেম্সে ৪৮ বছর বয়সী আদিলি উইগুর জাতির প্রাচীন ক্রীড়া 'তাওয়াজ' প্রদর্শন করেন। 'তাওয়াজ' মানে দড়ির উপর দিয়ে হাঁটা। রোমাঞ্চকর ও উত্তেজনাপূর্ণ এ খেলা। আদিলি একটি তাওয়াজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। যখন তার বয়স ১১ বছর, তখন তিনি সিন চিয়াংয়ের পক্ষে দ্বিতীয় জাতীয় সংখ্যলঘু জাতির গেমসে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে, আদিলির বাবা, সিন চিয়াং ইংচিশা জেলার কৃষক উসোর থিয়ান চিন শহরে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংখ্যালঘু গেমসে অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রথস গেমসে মাত্র ১৩টি জাতির ৩৯৫ জন অংশগ্রহণকারী ছিল এবং ৫ ধরনের ইভেন্ট ছিল। তবে গণপ্রজতান্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর প্রথম জাতীয় পর্যায়ের সংখ্যালঘু ক্রীড়া অনুষ্ঠান বলে সেটি ছিল খুব তাত্পর্যপূর্ণ।
দ্বিতীয় গেমস ১৯৮২ সালে ইনার মঙ্গোলিয়ার রাজধানী হহটে অনুষ্ঠিত হয়। তখন চীনে চালু হয়ে গেছে সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ কার্যক্রম। রাষ্ট্রীয় পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রতি চার বছর অন্তর এ গেমস্ আয়োজনের সিদ্ধান্তও হয় সেবছর।
আদিলি জানান, ১৯৮২ সাল থেকে তিনি টানা ১০ বার এ গেমসে অংশগ্রহণ করেছেন। গেমসের আকার প্রতিবার বাড়ছে এবং অংশগ্রণকারীদের সংখ্যাও বাড়ছে। প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন ইভেন্টে।
তৃতীয় গেমসে নির্ধারণ করা হয় গেমসের প্রতীক ও পতাকা। চতুর্থ গেমসে ঠিক করা হয় থিম সংগীত। এ গানটি চীনে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। গানটির শিরোনাম: 'চীনকে ভালবাসি'। চতুর্থ গেমসে তাইওয়ানের সংখ্যালঘু জাতির প্রতিনিধি প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করেন। পঞ্চম গেমসে চীনের গণমুক্তি ফৌজ ও সিনচিয়াং কনস্ট্রাকশন কর্পস প্রথমবারের মতো প্রতিনিধিদল পাঠায়। ষষ্ঠ গেমস বেইজিং ও তিব্বতের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় এবং যথাক্রমে বেইজিং ও তিব্বতে ডিভিশন স্থাপন করা হয়। সপ্তম গেমস নিং সিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়। এ পর্যন্ত চীনের ৫টি সংখ্যালঘু জাতির স্বায়ত্তশাসিত এলাকা অন্তত একবার এ গেমস আয়োজন করে। নবম গেমস থেকে স্বর্ণ, রৌপ্য এবং ব্রোঞ্জ পদকের ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। তখন থেকে অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়। দশম গেমসে হান জাতির ক্রীড়াবিদরাও অংশগ্রহণ করেন।
এবার একাদশ গেমস হ্য নান প্রদেশে অনুষ্ঠিত হয়। হ্য নান চীনের মাঝখানে অবস্থিত। প্রাচীন কাল থেকে চার দিক থেকে আসা মানুষ এখানে এসে মিলেছে। তাদের মধ্যে বিনিময় হয়েছে, ঘটেছে মিশ্রণ। এবার ৫৬টি জাতির ৭ হাজারের বেশি ক্রীড়াবিদ ১৭টি বিভাগের ১৯৪টি ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে।
১৭টি বিভাগের অন্যতম 'হুয়া পাও'। এ খেলার ইতিহাস ৫০০ বছরের বেশি প্রাচীন এবং কুয়াং সি চুয়াং জাতিসহ কয়েকটি জাতির মধ্যে জনপ্রিয়। গত শতাব্দীর ৮০-র দশকে, ফুটবল রেফারি হুয়াং চি সিয়ান লোকজনকে কৃষিক্ষেতে হুয়া পাও খেলতে দেখেন। এ খেলা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি ভাবলেন, এমন আর্কষণীয় খেলা সম্পর্কে বাইরের মানুষ কেন জানবে না! তিনি নিজে হুয়া পাও'র নিয়ম তৈরি করলেন এবং চীনে এ খেলা জনপ্রিয় করিয়ে তোলেন। ১৯৮৬ সালে এ খেলা আনুষ্ঠানিক আইটম হিসেবে জাতীয় সংখ্যালঘু জাতির গেমসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। হুয়া চি সিয়ান বলেন, জাতীয় সংখ্যালঘু জাতির গেমস ঐতিহ্যিক চীনা ক্রীড়া কার্যক্রমের প্রদর্শন ও বিনিময়ের ভাল একটি মঞ্চ এবং জাতীয় ঐতিহ্যিক খেলাধুলার উত্তরাধিকার ও সংরক্ষণের জন্য সহায়ক।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, সারা চীনে আবিষ্কৃত হয় ১০০০টির বেশি ঐতিহ্যিক খেলা এবং এর মধ্যে ৭০০টির বেশি সংখ্যালঘু জাতির খেলা।
তিব্বতি প্রতিনিধিদলের ছি ওয়াং ছু চেন একজন crossbow ক্রীড়াবিদ। তিনি ছয় বার এ গেমসে অংশগ্রহণ করেন। ক্রীড়াবিদ ছাড়া, তিনি একজন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকও বটে। তিনি বলেন, গেমসের মাধ্যমে অনেক ভাল বন্ধু হয়েছে তাঁর। crossbow আসলে চীনের ইউন নান প্রদেশের লি সু জাতির ঐতিহ্যিক খেলা। তবে গেমসের মাধ্যমে অনেক মানুষ এ খেলা সম্পর্কে জানতে পেরেছে এবং নানা জাতির মানুষ এ খেলায় অংশগ্রহণ শুরু করে। হু পাও, ড্রাগন নৌকা দক্ষিণ চীনের সংখ্যালঘু জাতির খেলা। অথচ এগুলো এখন উত্তর চীনে আরও বেশি জনপ্রিয়। উত্তর-পূর্ব চীনের মান জাতির প্রিয় খেলা 'মুক্তা বল' এখন দক্ষিণ-পশ্চিম চীনেও দেখা যায়।
জাতীয় সংখ্যালঘু জাতির গেমসে এমন একটি দৃশ্য সবসময় দেখা যায় যে, কোনো একটি খেলা একটি বিশেষ জাতির ঐতিহ্যিক খেলা হলেও, প্রতিযোগিতায় অন্য জাতির মানুষ বেশি ভালো করছে! যেমন, অষ্টম গেমসে, তিব্বতের প্রতিনিধি দল 'সিরিমু' ও 'ক্য'—এই দুটি ইভেন্টের চ্যাম্পিয়ন হয়। অথচ 'সিরিমু' ও 'ক্য' যথাক্রমে কোরীয় ও ই জাতির ঐতিহ্যিক খেলা! নবম ও দশম গেমসে হু নান প্রতিনিধিদল 'মু ছিও' নামের একটি খেলায় প্রথম স্থান অর্জন করে। অথচ এ খেলা পশ্চিম-উত্তর চীনের হুই জাতির মধ্যে উত্পত্তিলাভ করেছিল।
জাতীয় ঐক্য জোরদার পারস্পরিক সংস্কৃতির স্বীকৃতির ওপর নির্ভর করে এবং নানা জাতির সংস্কৃতিও এ গেমস-এ এসে মিলিত হয়। দশম গেমসের একটি ইভেন্টের নাম ছিল 'জাতীয় অ্যারোবিকস'। এতে রয়েছে উইগুর, চিনপো, তিব্বত, মঙ্গোলিয়ান ও থুচিয়াসহ ২০টি জাতির নৃত্যের অ্যাকশন।
জাতীয় সংখ্যালঘু জাতির গেমসের থিম সংগীতে একটি কথা এমন: ৫৬টি জাতির ভাই-বোন একটি পরিবার এবং সবার ভাষা ভিন্ন হলেও একই কণ্ঠে বলে চীনকে ভালোবাসি।
গণপ্রজতান্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর বিগত ৭০ বছর ধরে, চীনের নানান জাতির মানুষের মধ্যে বিনিময় ও যোগাযোগ অনেক বেড়েছে এবং নানান জাতির মধ্যে ঐক্যও দিন দিন জোরদার হয়েছে। বলা বাহুল্য, এক্ষেত্রে সংখ্যালঘু জাতির গেমস্ বিশেষ অবদান রেখেছে। (শিশির/আলিম/রুবি)