এই পরিবারের বাবা হলেন জমির আওয়ান। সম্প্রতি সিআরআই'র সাংবাদিক জমির আওয়ান ও তাঁর বড় ছেলে মোয়াজ আওয়ান'র সাক্ষাত্কার নিয়েছেন। আজকের আসরের শুরুতে এ পরিবারের গল্প বলবো।
৫৭ বছর বয়সী জমির আওয়ান হলেন পাকিস্তানের সরকারি বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা জ্ঞান গবেষণাকেন্দ্রের উপ-পরিচালক। ১৯৮০ সালে তিনি চীন সরকারের বৃত্তি পেয়ে শাংহাই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও মাস্টার্স ডিগ্রীর জন্য লেখাপড়া শুরু করেন। চীনে প্রথম বছরে তিনি বেইজিং ভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা ভাষা শিখেছেন। দ্বিতীয় বছর থেকে তিনি শাংহাই বিশ্ববিদ্যালয়ে যন্ত্রপাতি বিভাগে স্নাতক ও মাস্টার্স ডিগ্রীর লেখাপড়া শুরু করেন। সাত বছর চীনে লেখাপাড়ার মাধ্যমে জমির শুধু যে জ্ঞান ও চীনা ভাষা শিখেছেন, তা নয়; বরং চীনা মানুষের চিন্তাভাবনা ধারণ করেছেন এবং তাদের জীবনযাপনের পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। জমির বলেন, "আমি চীনা শিক্ষা গ্রহণ করেছি। আমি ১৮ বছর বয়সে চীনে গিয়েছি এবং ২৫ বছর বয়সে পাকিস্তানে ফিরে এসেছি। ৭ বছর চীনে ছিলাম। চীনে আমার অনেক চীনা বন্ধু আছে। আমি তাঁদের সঙ্গে থাকতাম। ধীরে ধীরে আমি মন-মননে ও আচরণে একজন চীনা মানুষ হয়ে যাই। যদিও আমার চেহারা পাকিস্তানিদের মতো, কিন্তু মনের দিক দিয়ে আমি চীনা মানুষের মতো।"
শাংহাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর জমির চীন ত্যাগ করে পর্যায়ক্রমে সৌদি আরব ও পাকিস্তানে কাজ করেছেন। ২০১০ সালে তিনি চীনে পাকিস্তানের দূতাবাসের বিজ্ঞান ও শিক্ষা কাউন্সিলরের পদে নিযুক্ত হয়ে চীনে ফিরে আসেন। এবার তিনি তাঁর স্ত্রী ও চার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে চীনে আসেন।
প্রথমবার যখন তিনি চীনে আসেন, তখন চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ মাত্র শুরু হয়েছে। তখন চীনে অর্থের ঘাটতি ছিল। কিন্তু মাত্র বিশ বছরে চীনে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। এখন চীন অনেক সচ্ছল হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়েছে সমৃদ্ধ। চীনা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও অনেক বদলেছে। এ সম্পর্কে জমির বলেন, "চীনের প্রাচীন সংস্কৃতি ও কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। থাং রাজবংশ আমলে চীন ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশ। যদিও গত দুই শতাব্দীতে চীন পাশ্চাত্য দেশগুলোর অনুপ্রবেশ এবং আফিম যুদ্ধ ও জাপানি আগ্রাসনের শিকার হয়, তবুও চীনা মানুষ নিজেদের পরিশ্রমে উন্নত হবার সামর্থ্য দেখিয়েছে।"
২০১৬ সালে জমির চীনে পাক দূতাবাসের কাজ ত্যাগ করে স্বদেশে ফিরে যান। তিনি সরকারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চীন গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তোলেন। সেখানে তিনি 'চীনের উন্নয়নের অভিজ্ঞতা' তুলে ধরেন। তিনি প্রতিবছর কেন্দ্রের শিক্ষার্থীদের নিয়ে চীন সফরে আসতে থাকেন। চীনসম্পর্কিত ক্লাস দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি একসময় চীনা জ্ঞানের ওপর মাস্টার্স ডিগ্রি কোর্স চালু করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "আমাদের দু'দেশের গত প্রজন্মের নেতাদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ভালো ছিল। কিন্তু দু'দেশের যুবকদের পারস্পরিক বোঝাপড়া যথেষ্ট না। পাকিস্তানের বিশ্বিবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমার কাছ থেকে চীন সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে পারে। তাঁরা চীনা প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেতে পারে। যদি তারা প্রথমে আমার কাছ থেকে চীন সম্পর্কে জেনে নেয়, তবে চীনা কোম্পানিতে কাজ করা তাদের জন্য সুবিধাজনক হবে।"
জমির পাকিস্তানের যুবক-যুবতীদের চীনা জ্ঞান শেখানো ছাড়াও নিজের সন্তানদের চীনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর প্রভাবে বড় ছেলে মোয়াজ আওয়ান থিয়ানচিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন। এ সম্পর্কে মোয়াজ বলেন, "চীন হলো বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক সত্তা। চীনে সমাজের বিভিন্ন মহলের মানুষের জন্য সুযোগ আছে। আমি মাস্টার ডিগ্রীর জন্য সুইডেনে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি চীনা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চেয়েছি। এখন আমার অনেক চীনা বন্ধু আছে। আমি ভবিষ্যতে চীন সম্পর্কিত কাজ করতে চাই। সেজন্য আমি চীনে বর্তমানে পিএইচডি করছি।"
বাবার মতো মোয়াজও সক্রিয়ভাবে পাক-চীন সম্পর্ক গভীরতর করার লক্ষ্যে আয়োজিত বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আসছেন। তিনি পাকিস্তানের যুব-সমাজের পক্ষে শাংহাই সহযোগিতা সংস্থার যুব শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেন এবং সেখানে ভাষণ দেন। তিনি পাকিস্তানের জাতীয় টেলিভিশনে 'পাক-চীন অর্থনৈতিক করিডোর যুগ' শীর্ষক অনুষ্ঠানে হোস্টের কাজ করেন। তাঁর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত উইচ্যাট প্লাটফর্মে চীনা ও ইংরেজি ভাষায় নির্মিত ভিডিওতে দু'দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। মোয়াজ বলেন, ভবিষ্যতে তিনি পাক-চীন অর্থনৈতিক করিডোর নিয়ে গবেষণা করবেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "পাক-চীন অর্থনৈতিক করিডোরের আওতায় চীন পাকিস্তানে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করছে। এটি পাকিস্তানের পরিবহন-ব্যবস্থাকে উন্নত করেছে এবং বিদ্যুত সমস্যার সমাধান করেছে। কিন্তু পাক-চীন অর্থনৈতিক করিডোর শুধুমাত্র একটি সড়ক বা একটি বিদ্যুতকেন্দ্র নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ ব্যবস্থা। করিডোর দু'দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্থায়ী ভূমিকা পালন করবে। চীন পাকিস্তানকে সহায়তা করার পাশাপাশি নিজের পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়ন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই করিডোরের আওতায়।"
চীন-পাক মৈত্রী জোরদারের ক্ষেত্রে ছেলের অবদান নিয়ে জমির গর্ব করেন। জমিরের দৃষ্টিতে দু'দেশের যুবকের পারস্পরিক সমঝোতা বাড়াতে হবে, মৈত্রী জোরদার করতে হবে, যাতে দু'দেশের সম্পর্ক আরও উন্নত করা যায়।