আবার শুরু হলো নতুন একটি সেমিস্টার; অনেক নতুন শিক্ষার্থী তাদের বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন শুরু করল সম্প্রতি। ৫১ বছর বয়সী লি চিয়ার ছেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। লি তার ছেলের জন্য এ উপলক্ষ্যে কিছু উপহার ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ছেলে তাঁকে বলল: কোনো প্রয়োজন নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে প্রয়োজনীয় সবকিছুই আছে। তা ছাড়া, এখন অনলাইনে সহজে সবকিছু কেনা যায়। সে অযথা একটা বড় লাগেজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে চায় না!
ছেলের কথা শুনে লি চিয়ার নিজের অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে যায়। গত শতাব্দীর আশির দশকে তিনিও বিশ্বিবিদ্যালয়ের নতুন শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় অনেককিছু কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। হাইনান প্রদেশের একটি গ্রাম থেকে তার লাগেজ তিন দিনে উ হান শহরে তার বিশ্বিদ্যালয়ে পৌঁছেছিল। আর তার চাচা গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ছিলেন। তার মা তাকে হাতে তৈরি ব্যাগ, লেপ ও পুরনো পোশাক দিয়ে দিয়েছিলেন।
পরিসংখ্যান অনুসারে, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন শিক্ষার্থীরা সাধারণত মোবাইলফোন, ল্যাপটপ এবং ট্যাবলেট উপহার পায়। ২০১৯ সালে এ তালিকায় যুক্ত হয় ই-বুক, ম্যাসেজ ডিভাইস ইত্যাদি।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে বৈদ্যুতিন পণ্য—বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপহারে যে-পরিবর্তন দেখা যায়, তা আসলে গেল ৭০ বছরে আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনের প্রতীক।
১৯৬৪ সালে ফু চিয়ান প্রদেশের লি ত্য চিয়ান প্রথমবারের মতো হোম টাউন ছেড়ে ৪৮ ঘন্টার ট্রেনভ্রমণ করে বেইজিংয়ের সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় এসেছিলেন। তখন তার কাছে মাত্র একটি ভাঙাচোরা স্যুটকেস ও কিছু পুরাতন পোশাক ছিল।
গেল শতাব্দির ৫০ থেকে ৭০-এর দশকে দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো ছিল না। তখনকার বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষার্থীদের লাগেজে পোশাক, লেপ, কাপ, বাটি ইত্যাদি থাকতো। ৮০ দশকের শেষ দিকে, সংস্কার ও উন্মুক্তকরণনীতি চালু ও এর ফলে সমাজ সমৃদ্ধ হতে শুরু করলে, বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষার্থীদের ভর্তি-উপহারও পরিবর্তিত হতে শুরু করে। তখন কলম, ঘড়ি ও রেডিও বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
ইয়াং পিং ১৯৮৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তখন তিনি পরিবারের কাছ থেকে একটি জাপানি ওয়াকম্যান উপহার পেয়েছিলেন। তখন গোটা ক্লাসে তার এ উপহার ছিল সবচেয়ে ভাল।
৯০-এর দশকে চীনের অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়। ১৯৯৮ সালের বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষার্থী মিঃ সিয়ে বলেন, তখন তিনি উপহার পেয়েছিলেন পেজার।
২০০৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন লি চিং। তার জন্ম ৮০-র দশকে। তখন তার উপহার ছিল মোবাইলফোন, ল্যাপটপ ও এমপিথ্রি প্লেয়ার। তার প্রথম মোবাইল ফোন থেকে শুধু এসএমএস পাঠানো ও ফোন করা যেতো।
এখন ২০০০ সালে জন্মগ্রহণকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছে। তাদের উপহার শুধু দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য নয়, উপভোগের জন্য।
গেল ৭০ বছরে বিশ্বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপহার বা লাগেজ বিশ্লেষণ করলে দু'টি মজার বিষয় উঠে আসে:
১. নিত্যপ্রয়োজনী পণ্য কম ও উপভোগের পণ্য বেশি: ওয়াং চিয়ান হুয়া ১৯৬৪ সালে ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যারয়ে ভর্তি হন এবং তখনকার ক্যাম্পাসে সবাই প্রায় একই পোশাক পরতো এবং তাদের জীবনমানও প্রায় একই পর্যায়ের ছিল। এখন ২০১৯ সালে নতুন একজন বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষার্থীর ব্যাগ খুললে আপনি হয়ত দেখতে পাবেন খেলনা-ড্রোন, প্রজেক্টর, ত্বকের যত্নের পণ্য ইদ্যাদি।
২. লাগেজ ছোট, কিন্তু দাম বেশি: ১৯৮৫ সালে ইয়াং পিং ইনার মঙ্গোলিয়া থেকে বেইজিং সি আন শহরে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। তার ৩৬ ঘন্টা লাগে এবং তার লাগেজের ওজন ছিল ২০ কেজি। ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের লাগেজ আসে ডাকে এবং সে ভ্রমণের সময় হালকা একটা ব্যাগ হয়তো বহন করে। তবে, ছোট ব্যাগে রাখা জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি। ২০১৯ সালে টিমল-এর পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী, গড়ে প্রতিটি ব্যাগে মোবাইলফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবলেটসহ নানা জিনিষের দাম ১০ হাজার ইউয়ানের বেশি।
বস্তুত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর ব্যাগ দেখে বোঝা যায় চীনের পরিবর্তন। ১৯৪৯ সালে চীনের মাথাপিছু ডিসপোজেবল আয় মাত্র ৪৯.৭ ইউয়ান ছিল এবং ২০১৮ সালে তা বেড়ে ২৮,২২৮ ইউয়ানে দাঁড়ায়।
ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের উপ-অধ্যাপক ইউয়ান ফেই বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষার্থীর লাগেজের পরিবর্তন চীনা সমাজের উন্নয়নের প্রতিফলন। সমাজে মাঝারি আয়ের গ্রুপ দিন দিন বড় হচ্ছে এবং শিক্ষায় বাবা-মার বিনিয়োগের আগ্রহ বাড়ছে।
১৯৫২ সালে চীনে চালু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি-পরীক্ষা পদ্ধতি এবং তখন নতুন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬৬ হাজার ছিল। ২০১৮ সালে চীনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ৭৯ লক্ষ ৯ হাজার ৯০০ জন ভর্তি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও সমাজ পরিবর্তনের একটা সূচক বটে। (শিশির/আলিম/রুবি)