বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ২ বছর : অনিশ্চিত প্রত্যাবাসন
  2019-08-25 18:34:13  cri

মিয়ানমারের রাখাইনে সে দেশের সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গাদের ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটতে শুরু করে বাংলাদেশে। মাত্র কয়েক মাসে কক্সবাজারের বিপুল এলাকা জুড়ে আশ্রয় নেয় সাত লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মিলিয়ে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ লাখে।

বিশাল এ জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব নেয়ার সামর্থ্য না থাকলেও মানবিক কারণে আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ। গত দু'বছরে বাংলাদেশ সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে বাস্তুচ্যুত এ মানুষগুলোর আশ্রয় ও ভরণপোষণের। বাংলাদেশের এ প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক মহলে ভূঁয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে, এ জন্য বাংলাদেশকে দিতে হয়েছে অনেক বড় মূল্য।

এক হিসাবে দেখা গেছে, বিশাল এ জনগোষ্ঠীর জন্য গত দুবছরে বাংলাদেশকে ব্যয় করতে হয়েছে ৭৮ হাজার কোটি টাকা। পাহাড় ও বন ধংস হয়ে কক্সবাজারে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে। কক্সবাজারের ওই এলাকায় নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়ায় সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। রয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকির মতো বিষয়।

মানবিক কারণে আশ্রয় দিলেও রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশের জন্য এক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন দেশ ও জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা রোহিঙ্গাদের সহায়তায় এগিয়ে এলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ১১ লাখ রোহিঙ্গার আবাসন, খাবার, চিকিৎসা ও রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা সহজসাধ্য কাজ নয়। আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশের প্রশংসায় উদার হলেও সহায়তা দেয়ার বেলায় তারা ততটা অকৃপণ নয়।

সবচেয়ে বড় কথা বাস্তুহারা এ সব মানুষ কবে ফিরে যাবে নিজ দেশে তার কোনো কুল-কিনারা মিলছে না। আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে মিয়ানমার নামমাত্র সংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হলেও, তারা ফিরে যেতে না চাওয়ায় বারবার আটকে যাচ্ছে প্রত্যাবাসন কাজ। গত বছর নভেম্বরে প্রথম দফায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবার কথা ছিল। কিন্তু নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা ঝুঁকিসহ বিভিন্ন দাবিতে তারা যেতে রাজি হয়নি। বাংলাদেশও তাদের জোর করে ফেরত পাঠায়নি।

রোহিঙ্গাদের ফেরার মতো উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির জন্য জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল মিয়ানমারকে চাপ দিয়ে আসছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। নানা টালবাহানার পর চলতি মাসের ২২ আগস্ট থেকে দ্বিতীয় বারের মতো প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করার দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়। এ দফায় সাড়ে তিন হাজারের মতো রোহিঙ্গার ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে প্রত্যাবাসন কাজ শুরু হবার কথা ছিল। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সব রকম প্রস্তুতিও নেয়া হয়। কিন্তু আবারো নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তাসহ ৫ দফা দাবিতে একজন রোহিঙ্গাও ফিরে যেতে রাজি হয়নি নিজ দেশে।

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম আজাদ জানান, যেহেতু রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে রাজি নয়, তাই বাংলাদেশ সরকারের নীতি অনুযায়ী জোর করে তাদের ফেরত পাঠানো হবে না। রোহিঙ্গাদের ফিরে যেতে রাজি না হওয়াকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি জানান, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন উদ্যোগে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো গাফিলতি নেই। আস্থার সংকটের কারণে রোহিঙ্গারা যাচ্ছে না। তাই মিয়ানমারকেই এ আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এ বিষয়ে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহল দায় এড়াতে পারে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দিতে বাংলাদেশ এবার শক্ত অবস্থানে যাবে বলেও সতর্ক করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। যারা তাদের ফিরে যেতে নিরুৎসাহিত করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

এদিকে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরাও মনে করেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ব্যর্থতার দায় মিয়ানমারের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মোহসীন, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর প্রত্যেকেই মনে করেন এবিষয়ে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে বাংলাদেশকে আরো জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতিসংঘের আগামী অধিবেশনে বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরারও পরামর্শ দেন তারা।

সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বাংলাদেশ সফরে এসে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। দিল্লি রোহিঙ্গাদের দ্রুত ও টেকসই প্রত্যাবাস চায়। আর চীন বরাবরই দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান চেয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারত ও চীনের পূর্ণাঙ্গ সমর্থন আদায়ে সরকারকে আরো তৎপর হতে পরামর্শ তাদের।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। বাংলাদেশের পক্ষে যা যা করার তার সবই করা হয়েছে। এখন জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল এ সমস্যার সমাধানে তাদের দায়িত্ব পালন করবে বলে আশা করে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ।

ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040