২০০৩ সালে চীনা জাতীয় ক্রীড়া কমিটি চীনের বিশ্বমানের ৩১ জন কোচ নির্বাচন করে মেক্সিকোয় পাঠায়। মা চিন হলেন ৩১ জন কোচের মধ্যে একজন। মা চিন আগে ছিলেন বেইজিং ডাইভিং দলের কোচ। ১৬ বছরে মা চিন মেক্সিকোর ডাইভিংয়ের মান উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। মেক্সিকোর 'ডাইভিং রাজকুমারী' বলে পরিচিত পাওলা এস্পিনোসা হলেন বর্তমান মেক্সিকোর প্রতিনিধি। মা চিন'র নেতৃত্বে মেক্সিকোর ডাইভিং দল বিশ্বে 'মেক্সিকোর স্বপ্ন দল' বলে পরিচিত।
মা চিন সাংবাদিককে বলেন, মেক্সিকোয় কাজ করা হলো তাঁর জীবনের বড় সুযোগ। তিনি বলেন, আসলে মেস্কিকো'র মানুষের ফিগার ডাইভিংয়ের জন্য খুব উপযুক্ত। মেক্সিকোর ডাইভিংয়ের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯৪৮ সালে লন্ডন অলিম্পিক গেমসে ডাইভিং ইভেন্টে দু'টি পদক লাভ করেছিল মেক্সিকোর ডাইভাররা। চীনা কোচ মেক্সিকোয় যাওয়ার আগে মেক্সিকোর ডাভিংয়ের মান উচ্চ ছিল না। মান উন্নয়নের পাশাপাশি মেক্সিকোর ক্রীড়া বিভাগ ডাইভিংয়ের ওপর আরো বেশি গুরুত্ব দেয়। বর্তমানে মা চিন মেক্সিকোর ক্রীড়ামহলের সুপার স্টারে পরিণত হয়েছেন এবং আরো বেশি ভালো খেলোয়াড় সেখানে তৈরি হয়েছে। মেস্কিকোর সরকার মা চিন'র সাফল্যের উচ্চ মূল্যায়ন করে। ২০১২ সালে মেক্সিকোর সরকার মা চিনকে 'দি অ্যাজটেক ইগল' পুরস্কার প্রদান করে। মা চিন দু'দেশের ক্রীড়া ও সংস্কৃতির যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিশিষ্ট অবদান রেখেছেন। মা চিন হলেন এ পুরস্কার লাভ করা প্রথম চীনা ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "আমি মেক্সিকো আসার পর চার জন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এর মধ্যে তিন জন প্রেসিডেন্ট আমার সাথে দেখা করেছেন। তাঁরা আমার প্রশংসা করেছেন। আমি 'দি অ্যাজটেক ইগল' লাভ করেছি। এ পুরস্কার হলো বিদেশিদের শ্রেষ্ঠ মর্যাদা। আমার মনে হয়, নিজের পরিশ্রমের সাফল্য অর্জিত হয়েছে।"
বিদেশে কাজ করার সময় মা চিন সাংস্কৃতিক পার্থক্যের সমস্যার সম্মুখীন ছিল। বেইজিংয়ের স্থানীয় বাসিন্দা হিসেবে মা চিন স্ট্রেট-ফরওয়ার্ড চরিত্রের। কিন্তু মেক্সিকো হলো একটি বৈশিষ্ট্যমূলক লাটিন আমেরিকান দেশ। তিনি বলেন, আবহাওয়া ও খাবারের পার্থক্যের চেয়ে মেক্সিকোয় তাঁর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা। কিন্তু তিনি আস্তে আস্তে মেক্সিকোর খেলোয়াড়ের সঙ্গে মানিয়ে নেন। তিনি বলেন, "আমি সরাসরি চীনের অনুশীলন-স্টাইল মেক্সিকোর খেলোয়াড় ওর প্রয়োগ করতে পারি না। সেজন্য আমি মেক্সিকোয় আসার পর প্রথমে বুঝতে, শিখতে, ও মানিয়ে নিতে শিখেছি। মেক্সিকোর খেলোয়াড়রা প্রতিদিন একই সময় অনুশীলন করতে পারে না। কারণ, তাঁরা বেশিসময় ধরে অনুশীলন করতে পারে না। আমি দেখলাম, তাদের পক্ষে টানা এক সপ্তাহ অনুশীলন করা সম্ভব না। তাই আমি অনুশীলনের সময় কমিয়েছি। কখনও কখনও অনুশীলনের সময় তাঁরা চলচ্চিত্র দেখতে চায়। আসলে বিদেশে চীনা কোচরা এ ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হন। তাঁরা সত্যি সত্যি চীনা খেলোয়াড়ের মতো পরিশ্রমী না।'
মা চিন বলেন, বিদেশে চীনা কোচের চ্যালেঞ্জ শুধু যে নিজের মান ঠিক রাখা, তা নয়; বরং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগের মানও উন্নত করতে হয়। তিনি বলেন, বিভিন্ন খেলোয়াড়ের শৈলী অনুযায়ী বিভিন্ন অনুশীলন-পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "খেলোয়াড়ভেদে ভিন্ন ভিন্ন অনুশীলন-পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। একই পরিকল্পনা অন্যদের জন্য ঠিক না-ও হতে পারে। সেজন্য আমাকে নিজের শিক্ষার মানও উন্নত করতে হয়।"
অনুশীলনের বাইরেও তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের খোঁজ-খবর রাখেন। ডলোরেস হার্নান্দেজ হলেন মেক্সিকোর বিখ্যাত ডাইভার। তিনি ২০১৪ সালে মধ্য-আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান গেমস, ২০১৫ সালে প্যান-আমেরিকান গেমস ও ২০১৭ সালে বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয় গ্রীষ্মকালীন গেমসের ডাইভিং ইভেন্টে স্বর্ণপদক লাভ করেছেন। ১২ থেকে ২২ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি মা চিনের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাঁর দৃষ্টিতে মা চিন হলেন তাঁর শিক্ষক ও মা। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "কোনো কোনো সময় আমার কোচ খুবই কঠোর। কিন্তু তিনি আমাদের অনেক যত্ন নেন। তিনি একজন মায়ের মতো আমাদের যত্ন নেন। যখন আমাদের সমস্যা হয়, তখন তিনি আমাদেরকে সহায়তা করেন।"
মা চিন বলেন, শুরুতে মেক্সিকোর সরকার চীনা কোচ সেদেশে ভাল সাফল্য অর্জন করতে পারবে কি না, এ নিয়ে সন্দিহান ছিল। কিন্তু মা চিন মেক্সিকোর জন্য সাফল্য অর্জন করেছেন। যদিও বিদেশে থাকেন তবুও তিনি চীনা মানুষের ভাবমূর্তির প্রতিনিধিত্ব করেন। একজন কোচ ছাড়াও তিনি চীনকে প্রচার করার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের চীনা ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি, দার্শনিক চিন্তাভাবনা, এবং নৈতিক ধারণা সম্পর্কে জানান। ১৭ বছর বয়সী র্যান্ডাল উইলার্স ২০১৮ সালে বিশ্ব যুব গেমসের পুরুষ ১০ মিটার প্ল্যাটফর্ম ডাইভিংয়ের চ্যাম্পিয়ন হন। তিনি ৯ বছর বয়স থেকে মা চিন'র কাছে অনুশীলন শুরু করেন। কেন মা চিন তার কাছে 'চীনা মা'? তিনি বলেন, "তিনি খুবই পরিশ্রম করেছেন। আমাদের শ্রেষ্ঠ সহায়ক তিনি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি আমাদেরকে সাহায্য করেছেন এবং করছেন। আমি তার কাছে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি ৭ বছর ধরে। তাঁর সঙ্গে অনুশীলন করি, প্রতিযোগিতায় অংশ নেই এবং উত্সব ও ছুটি কাটাই। তিনি মাঝে-মাঝে আমাদেরকে চীনা খাবার রান্না খাওয়ান বা আমাদেরকে নিয়ে চীনা রেস্তরাঁয় যান। এ ছাড়াও, তিনি আমাদেরকে নিয়ে চীনা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যান। আমরা চীনা সংস্কৃতি সম্পর্কে বেশ জেনেছি।"
মা চিন বলেন, মেক্সিকোয় কাজ করা হলো তাঁর বিশেষ অভিজ্ঞতা। তিনি মেক্সিকোর মানুষের কাছ থেকে সুখী হবার ও জীবন উপভোগ করার ধারণা শিখেছেন। তিনি বলেন, সুস্থ প্রতিযোগিতায় দু'দেশের ক্রীড়া পারম্পরিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারে।