চলতি বছর গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৭০তম বার্ষিকী। গেল ৭০ বছরে অসংখ্য বিদেশি রাজনীতিক, পন্ডিত, শিল্প ও বাণিজ্য মহলের ব্যক্তি ও সাধারণ মানুষ নিজেদের চোখে চীনের উন্নয়ন দেখেছেন। চীনের উন্নয়ন যেমন তাদেরকে আকর্ষণ করে, তেমনি তাদেরকে চীন সম্পর্কে জানতে আরও আগ্রহী করে তোলে। ইরানের রাজধানী তেহরানে এমন একজন ডাক্তার আছেন। তাঁর নাম আমির হুমান কাজেমি। তিনি একজন বিখ্যাত চায়নিজ মেডিসিন চিকিত্সক। তিনি আকুপাংচার পদ্ধতি প্রয়োগ করে রোগীদের চিকিত্সাসেবা দিয়ে থাকেন। তিনি ইরানের তরুণ-তরুণীদের চীনা ঐতিহ্যিক চিকিত্সা সম্পর্কে জানতে এবং তা নিয়ে লেখাপড়া করতে উত্সাহ দেন। সম্প্রতি তিনি চীন আন্তর্জাতিক বেতারকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাত্কারে বলেন, চীনের উন্নয়নের বিশাল সাফল্য দেখে তিনি খুবই খুশি। আজকের 'পুবের জানালা' আসরে আমরা হুমানের গল্প বলব।
২০০৫ সালে আমির হুমান চীনে এসে বেইজিং University of Traditional Chinese Medicine-এ চীনা ঐতিহ্যিক চিকিত্সাপদ্ধতির ওপর লেখাপড়া শুরু করেন। ২০১০ সালে তিনি আকুপাংচারবিষয়ক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি চীনে প্রথম বিদেশি যিনি এ ডিগ্রি অর্জন করেন। এখন হুমান তেহরান চিকিত্সা বিশ্ববিদ্যালয় ও বেইজিং চীনা ঐতিহ্যিক ওষুধ ও চিকিত্সা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে আকুপাংচার শিখিয়ে থাকেন। তিনি তেহরান চিকিত্সা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ হাসপাতালে ইরানি রোগীদেরকে আকুপাংচার-চিকিত্সা দিয়ে থাকেন। তিনি চীনে দশ-বারো বছর বাস করেছেন। তিনি বলেন, চীন তার দ্বিতীয় মাতৃভূমি।
"প্রতিবার আমি যখন চীনে ফিরে আসি, তখন মনে হয় আমি যেন মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছি। আমি চীনা ঐহিত্যিক চিকিত্সা-পদ্ধতি নিয়ে লেখাপড়া করি। চীনা সংস্কৃতি সম্পর্কেও আমি গভীরভাবে জানি। আমি বেইজিং চীনা ঐতিহ্যিক ওষুধ ও চিকিত্সা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছি। এখানে আমার রোগী ও শিক্ষার্থীরা সবাই চীনা মানুষ। চীনের প্রতি আমার গভীর ভালবাসা আছে। চীনে আমি কখনও নিজেকে একজন বিদেশি হিসেবে মনে করি না। আমার চীনা বন্ধুদের চোখেও আমি বিদেশি নই। আমি চীনসম্পর্কিত খবরগুলোর প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখি এবং চীনের উন্নয়ন দেখে আমার ভাল লাগে।"
চীনে থাকার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে হুমান বলেন, ২০০৯ সালের জাতীয় দিবস তথা গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৬০তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে থিয়েন আন মেন মহাচত্বরে বড় আকারের উদযাপনী অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল। তিনি ১০০ জন বিদেশি অতিথির অন্যতম হিসেবে সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, যেটা তার জন্য গর্বের বিষয়। তিনি বেইজিং, শাংহাইয়ের মতো বড় শহর যেমন পরিদর্শন করেন, তেমনি অনেক দূরবর্তী গ্রামেও গিয়েছেন। চীনের অর্থনীতি ও সমাজ এবং মানুষের জীবিকায় বড় পরিবর্তন হয়েছে। তিনি বলেন
"২০০৫ সালে, যখন আমি প্রথমে চীনে আসি, যে-চীন আমি দেখি, তা ছিল আমার কল্পনার তুলনায় ভিন্ন। চীন দ্রুত উন্নত হচ্ছে। প্রতিবার আমি চীনে ফিরে দেখেছি পরিবর্তন। বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে এ পরিবর্তন আরও দ্রুততর। যেমন, ২০০৫ সালে, চীনে কোনো হাইস্পিড ট্রেন ছিল না। ২০০৮ সালেই বেইজিং অলিম্পিক গেমসের সময়ে চালু হয় প্রথম হাইস্পিড ট্রেন। তার পর বড় বড় শহরে পর্যায়ক্রমে চালু হয় হাইস্পিড ট্রেন এবং এখন চীনে হাইস্পিড ট্রেন সাধারণ একটি ব্যাপার। চীনা মানুষের জীবিকার মানও অনেক উন্নত হয়েছে। আমি চীনের ছোট ছোট শহর ও গ্রামে গিয়েছি। ওখানে মানুষের জীবনমানও উন্নত হয়েছে। চীনে শুধু বড় শহরে পরিবর্তন দেখা যায়, তা নয়; গোটা চীনে পরিবর্তন ঘটছে।"
তেহরানে নিজের কাজ সম্পর্কে হুমান জানান, তিনি খুব ব্যস্ত সময় পার করেন। সকালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইরানি শিক্ষার্থীদের চীনা ঐতিহ্যিক ওষুধ ও চিকিত্সাবিষয়ক ক্লাস নেন। বিকেল ৪টা থেকে রাত পর্যন্ত তিনি ৭০ থেকে ১০০ জন রোগীকে চিকিত্সা দেন। গেল কয়েক বছরে তিনি আকুপাংচার পদ্ধতি দিয়ে অনেক রোগীকে সাহায্য করেছেন। তিনি তাদের সামনে বিস্ময়কর চীনা ঐতিহ্যিক চিকিত্সা-পদ্ধতি প্রদর্শন করেন। রোগীদের সেরে ওঠা দেখে তিনি উত্সাহিত হন এবং আরও মন দিয়ে চীনা ওষুধ ও চিকিত্সার ওপর লেখাপড়া করেন।
সাক্ষাত্কারে তিনি একজন ইরানি মেয়ের উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, এ মেয়ে বিরল প্রজাতির স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি চলাচল করতে পারতেন না। ১০ লাখ মানুষের মধ্যে একজন এমন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তার বাবা-মা প্রতিমাসে তাকে নিয়ে হুমানের কাছে আসতেন চিকিত্সার জন্য। এখন তার অবস্থা অনেক ভাল হয়েছে। তিনি বলেন,
"এর আগে তারা জার্মানিসহ অন্যান্য দেশেও গিয়েছেন এবং চিকিত্সা নিয়েছেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। অনেক উন্নত হাসপাতালে বিখ্যাত ডাক্তাররা মেয়ের চিকিত্সা করেছেন। শেষ পর্যন্ত বাবা-মা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমি আমি হাল ছেড়ে দিইনি। আমি তার বাবা-মাকে চীনা চিকিত্সা-পদ্ধতি গ্রহণে রাজি করাই। এখন এ মেয়ে কথা বলতে পারে, হাঁটাহাঁটি করতে পারে। আমি আকুপাংচার তথা চীনা চিকিত্সা দিয়ে তাদের জীবন পরিবর্তন করি।"
চীনের অর্জিত সফলতা সম্পর্কে হুমান বলেন, চীন সরকার যুক্তিগ্রাহ্য পরিকল্পনা অনুসারে দেশের উন্নয়নে কাজ করছে এবং জাতিকে সঠিক দিক্নির্দেশনা দিচ্ছে। চীনা মানুষ পরিশ্রমী এবং এটাও চীনের সাফল্যের অন্যতম কারণ। তিনি বিশ্বাস করেন, সরকারের নেতৃত্ব ও মানুষের পরিশ্রমের মাধ্যমে চীন আরও উন্নত হবে। তিনি বলেন,
"চীন সরকার ও নেতৃবৃন্দ দেশের উন্নয়নে ভাল পরিকল্পনা তৈরি করেন। একজন বিদেশি হিসেবে আমি দেখেছি, চীনের সকল পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ খুব ভাল পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেন, যা মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সহায়ক। আমি এর খুব তারিফ করি। চীনা নেতৃবৃন্দ সবসময় মানুষের জীবিকার মান উন্নয়নের প্রতি খেয়াল রাখেন এবং চীনা মানুষ সরকারকে বিশ্বাস করে। চীনা মানুষ যেমন পরিশ্রমী, তেমনি বন্ধুভাবাপন্ন। তাই চীনের ভবিষ্যত আরও উজ্জ্বল হবে বিশ্বাস করি আমি।"(শিশির/আলিম/রুবি)