কিংবদন্তি মার্শাল আর্টিস্ট ব্রুস লি
  2019-08-23 18:51:01  cri

আমাদের অনেকেই ছেলেবেলায় ব্রুস লি-কে দেখে মার্শাল আর্ট সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন। অনেক হলিউডের অভিনেতা ছেলেবেলা থেকেই ভাবতেন যে, বড় হয়ে তারা একদিন ব্রুস লি-র মতো হবেন। এই সব কিছু ঘটেছিল শুধুমাত্র একটি ছবির দৌলতে। ১৯৭৩ সালে তৈরি হওয়া ক্লাসিক পর্যায়ে উন্নীত হওয়া ছবি- 'এন্টার দ্য ড্রাগন' ছবি। এই ছবিটি কার্ল্ট ক্লাসিক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। দুঃখের ব্যাপার এই সাফল্য স্বয়ং ব্রুস লি দেখে যেতে পারেননি। ছবি মুক্তির আগেই এক রহস্যময় কারণে তাঁর মৃত্যু হয়। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩২ বছর।

ব্রুস লি ১৯৪০ সালের ২৭ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর চায়না টাউনে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা লি হো-চুং ছিলেন ক্যান্টনিজ অপেরা ও চলচ্চিত্র তারকা এবং মা গ্রেস হো। ব্রুস বড় হন হংকংয়ের কাউলুনে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে মাস্টার ইপ ম্যানের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তার। তিনি তাকে ইয়ুং ছুন স্টাইলের মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ দেন। হংকংয়ে লি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। হাই স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেন ১৯৬০ সালে। উচ্চতর পড়াশোনার জন্য ১৮ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। ১৯৬১ সালে ভর্তি হন ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে। এ সময় তিনি মার্শাল আর্ট শেখানো শুরু করেন।

চলচ্চিত্রে প্রবেশ:

বাবার হাত ধরে তার চলচ্চিত্রে প্রবেশ। শিশুশিল্পী হিসেবে অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন। মার্শাল আর্টের বিভিন্ন কৌশল আয়ত্ত করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন দ্রুত। এর মধ্যে ছিল গতি ও নির্ভুলতা কাজে লাগিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর বিভিন্ন অ্যাকশন দৃশ্যে অভিনয়। প্রথমদিকে হংকংভিত্তিক মার্শাল আর্টনির্ভর ছবিতে অভিনয় করেন। পরে হলিউড প্রযোজিত ছবিতে অভিনয় শুরু করেন। এর মাধ্যমে হংকংয়ের মার্শাল আর্টকে শিল্প হিসেবে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে যান ব্রুস। মার্শাল আর্টের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়। যা সত্তরের দশকের পশ্চিমা তরুণদের আকর্ষণ করে। ধীরে ধীরে বিশ্ব চলচ্চিত্রে মার্শাল আর্ট গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। এ ছাড়া তিনি জিৎ কুন দো নামের নতুন ধরনের মার্শাল আর্টেরও প্রতিষ্ঠাতা।

অভিনীত চলচ্চিত্র:

৩২টি চলচ্চিত্র এবং অনেক ডকুমেন্টারি ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ব্রুস লিকে দেখা গেছে। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য পাঁচটি চলচ্চিত্র হল- দ্য বিগ বস (১৯৭১), ফিস্ট অব ফিউরি (১৯৭২), ওয়ে অব ড্রাগন (১৯৭২), এন্টার দ্য ড্রাগন (১৯৭২) এবং দ্য গেম অব ডেথ (১৯৭৩)। এসব ছবির মাধ্যমে তিনি বিশ্বজোড়া আইকনিক ফিগার হয়ে ওঠেন। চাইনিজ জাতীয়তাবাদকে ধারণ করার কারণে চীনাদের মধ্যে বিশেষ সমাদর লাভ করেন ব্রুস লি। বলা হয়, 'ওয়ে অব দ্য ড্রাগন' ছবির মাধ্যমে মার্শাল আর্টকে গোটা বিশ্বের দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেন ব্রুস। তিনি এ ছবির চিত্রনাট্য তৈরি করেন ও কারাতেতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন চাক নরিসকে অভিনয় করতে বলেন। দুই লিজেন্ড অভিনীত ছবিটির অ্যাকশন দৃশ্যগুলো ইতিহাস সৃষ্টি করে।

চীন-মার্কিন যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত প্রথম ছবি 'এন্টার দ্য ড্রাগন' মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে। এটি তার সর্বশেষ ও সবচেয়ে সফল ছবি এটি। এর প্রিমিয়ারের কয়েক দিন আগে মারা যান ব্রুস। মৃত্যুর আগে চিত্রায়িত অ্যাকশন দৃশ্যগুলো 'গেম অব ডেথ' ছবিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

পারিবারিক জীবন:

ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন লিন্ডা এমারির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। দুই বছর প্রেমের সম্পর্ক, তারপর ১৯৬৪ সালে তাদের বিয়ে হয়। তাদের ঘরে দুই সন্তান ব্র্যান্ডন লি ও শ্যানন লি। ১৯৯৩ সালে ব্র্যান্ডন মারা যান।

মৃত্যুরহস্য:

মাত্র ৩২ বছর বয়সে হংকংয়ে ব্রুস লির মৃত্যু হয়। তখনই এই মৃত্যু নিয়ে নানা বিতর্ক তৈরি হয়। ১৯৭৩ সালের মে মাসে একটি চলচ্চিত্রে ডাবিংয়ের সময় ব্রুস লির মস্তিষ্ক হঠাৎই ফুলে উঠতে শুরু করে, সঙ্গে শুরু হয় তীব্র মাথাব্যথা। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় সেরেব্রাল এডেমা। ডাক্তারদের সার্বিক চেষ্টায় লি মস্তিষ্কের সমস্যা থেকে মুক্তি পান। কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মস্তিষ্কের ফুলে ওঠা কমাতে সক্ষম হলেও ছয় সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে তা আবার মারাত্মক হয়ে ফিরে আসে। ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই ব্রুস লি গিয়েছিলেন তার সহ-অভিনেত্রী বেটি টিং পেইর কাউলুন টংয়ের বাড়িতে। উদ্দেশ্য ছিল তার আসন্ন একটি ছবির চরিত্র নিয়ে নায়িকার সঙ্গে আলাপ করা। তখন হঠাৎ মাথাব্যথা শুরু হয় তার। বেটি ব্রুসকে ইকুয়াজেসিক নামে একটি পেইন কিলার খেতে দেন। ব্রুস বেডরুমে চলে যান বিশ্রাম নিতে। কিন্তু ঘুম থেকে আর জাগছেন না দেখে তাকে কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তাররা তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এর কয়েক ঘণ্টা পর ঘোষণা করা হয় ব্রুস লি মারা গেছেন।

কিছু অজানা তথ্য:

ব্রুস লি অসাধারণ নাচতে পারতেন। ১৯৫৮ সালে তিনি একটি নাচের প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নও হন। তখন মাত্র হাই স্কুলে পড়তেন তিনি। অভিনয়, মার্শাল আর্টের ট্রেনিংসহ দৈনন্দিন অন্যান্য কাজের বাইরে নাচের অনুশীলনের জন্য আলাদা সময় বের করতেন তিনি।

ব্রুস লি বাতাসের চেয়েও দ্রুত গতিতে ফাইট করতে পারতেন। এত ক্ষিপ্র গতিতে তিনি হাত চালাতেন যে প্রতিপক্ষ আঘাত প্রতিহত করারও সময় পেত না। ১৯৬২ সালে একটি লড়াইয়ে তিনি মাত্র ১১ সেকেন্ডে তার প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেন। এই ১১ সেকেন্ডে তিনি ১৫টি ঘুষি আর একটা কিক মেরেছিলেন প্রতিপক্ষকে।

ব্রুস লি অবসরে ছবি আঁকতে পছন্দ করতেন। তা ছাড়া কবিতাও লিখতেন তিনি। মার্শাল আর্ট আর ফাইটিংয়ের দৃশ্য বেশি আঁকতে পছন্দ করতেন। তার নিজের সংগ্রহের ২ হাজারের বেশি বই নিয়ে একটি লাইব্রেরিও ছিল তাঁর। নতুন কিছু পড়তে তার খুবই ভালো লাগত।

কিছু কাজ ছিল যা ব্রুস লি একদমই করতে পারতেন না। তিনি সাঁতার কাটতে পারতেন না। পানি দেখলেই তার ভয় করত। বাইক, গাড়ি কোনোটাই তিনি চালাতে পারতেন না।

ব্রুস লির কয়েকটি উক্তি:

যদি জীবনকে ভালোবাসো তবে সময় নষ্ট করো না। কারণ, সময়ের যথাযথ ব্যবহারেই জীবন গড়ে ওঠে।

সবসময় তোমাকে নিয়ে তোমার মধ্যে তোমার মতো করে থাকো। সাফল্যের জন্য অন্য কোনো ব্যক্তিত্বকে অনুসরণ করতে যেও না।

জ্ঞান তোমাকে ক্ষমতা দেবে। কিন্তু চরিত্র দেবে শ্রদ্ধা।

জ্ঞানীর কাছ থেকে বোকা যা শেখে- জ্ঞানী তারচেয়ে বেশি শেখে বোকার প্রশ্ন থেকে।

সত্যিকারের বেঁচে থাকা মানে অন্যদের জন্য বেঁচে থাকা।

তুমি শুধু অপেক্ষা করো, আমি বিশ্বে সবচেয়ে বড় চাইনিজ তারকা হতে চলেছি।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040