৬৪ বছর বয়সী ছেং চি মিন উত্তর-পশ্চিম কৃষি ও বনবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি ও পানি সংরক্ষণ গবেষণালয়ের একজন অধ্যাপক।
গেল ৪০ বছরে, তিনি পীত-মাটির মালভূমির ভূমিক্ষয় পুনরুদ্ধার এবং তৃণভূমি গড়ে তোলাসহ নানান বিষয়ে তত্ত্ব ও প্রযু্ক্তির সমস্যা সমাধান করেন। তার গবেষণার ফলাফল নিং সিয়াং, শ্যানসি, কান সু, শানসি, ইনার মঙ্গোলিয়াসহ নানান জায়গায় কাজে লাগানো হয়, যা ৫ হাজার কোটি ইউয়ানের সুবিধা সৃষ্টি করেছে এবং ৩ লাখ পরিবারকে দারিদ্র্যমুক্ত করেছে।
সারাজীবন একটি কাজে উত্সর্গ করেন ছেং চি মিন এবং তার গবেষণা থেকে অসংখ্যা মানুষ উপকৃত হয়। তিনি মৌল বিজ্ঞানের গবেষক এবং তিনি সবসময় বলেন যে, তাঁর সাধারণ একটি হৃদয় আছে।
১৯৭৯ সালে ছেং চি মিন তার শিক্ষকদের সঙ্গে ইউন উ পাহাড় নামের একটি জায়গা পরিদর্শন করতে যান। চীনা ভাষায় 'ইউন উ' অর্থ মেঘ ও কুয়াশা। তবে এ জায়গা তার নামের মতো সুন্দর নয়। একদিন সবাই বাইরে খেতে বসেছিলেন। তখন বালিঝড় শুরু হয়। তাদের খাবার সব বালিতে নষ্ট হয়ে যায়। এ অভিজ্ঞতা ছেং চি মিনের জীবন বদলে দেয়। তার মনে প্রথমবারের মতো এ ভূমির চেহারা বদলে দেওয়ার ইচ্ছা জাগে। পরের অভিজ্ঞতা তার এ ইচ্ছা আরও দৃঢ় করে তোলে। তিনি গ্রামবাসীদের ঘরে ঘরে খোঁজ নিয়ে দেখলেন, পরিবারের সদস্যদের প্রায় সবাই ঘরে বসে থাকে, বাইরে যায় না। জিজ্ঞেস করে জানলেন, তারা এতো দরিদ্র যে, প্রায় প্রতিটি পরিবারপিছু মাত্র একটি বাইরে-যাবার-মতো-পোশাক আছে। কে বাইরে যায়? কে এ প্যান্ট পরে! তখনকার ইউন উ পাহাড়ে এমন দৃশ্য সাধারণ ছিল। পানীআয় জল, শিক্ষা, চিকিত্সা ইত্যাদির সংকট ছিল স্থানীয় মানুষের। খারাপ প্রাকৃতিক পরিবেশ বন্ধ্যা জমি সৃষ্টি করে এবং বন্ধ্যা জমি কৃষকদের দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর করে।
পরের দিন খাবার কম থাকা সত্ত্বেও, স্থানীয় মানুষ তাকে একটি রুটি খেতে দেয়। ছেং চি মিন কখনও সে-কথা ভুলে যাবেন না। তিনি নিজেও একটি কৃষক পরিবারের ছেলে। তিনি দক্ষিণ চীনে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। তিনি ভাবেন, কেন এ অঞ্চলটি দক্ষিণ চীনের মতো হতে পারে না? দক্ষিণের পাহাড় সবুজ। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, গবেষণার মাধ্যমে ইউন উ পাহাড়ের চেহারা পাল্টে দেবেন। তিনি তার ডায়েরিতে লিখেছেন, 'কৃষিবিষয়ক গবেষণা করার উদ্দেশ্য হলো, মানুষের জীবনমান উন্নত করা। আমি আমার যৌবন এ ভুমিকে দিতে চাই।'
তিনি তার শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনার পর নিংসিয়ার স্থানীয় সরকার বরাবর একটি আবেদন জানান। আবেদনের বিষয়বস্তু এমন: তারা ইউন উ পাহাড়ে একটি পর্যবেক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করতে চান এবং পীত-মাটির মালভূমিতে তৃণভূমি গড়ে তোলার চেষ্টা করতে চান। এর পরের ৪০ বছর ছেং চি মিন তার সকল সময় এ ভূমিকে দিয়েছেন।
ছেং চি মিনের প্রিয় একটি উপন্যাসের নাম 'সাধারণ বিশ্ব'। উপন্যাসে এমন একটি কথা আছে: "জীবন মানে কী? এর মানে অবিরাম প্রচেষ্টা।" সপ্তম শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দীর ৫০-এর দশক পর্যন্ত, পীত-মাটির মালভূমিতে ২৩৬ বারের মতো বড় আকারের খরার রেকর্ড আছে। এতদঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ কখনও ভাল ছিল না। কীভাবে পীত-মাটির মালভূমির প্রাকৃতিক পরিবেশ সুন্দর করা যায়—তা নিয়ে বিশ্বের পন্ডিতদের মধ্যে সবসময় বিতর্ক ছিল। কেউ কেউ বলেছেন, এখানকার পরিবেশ অনুকূলে আনা অসম্ভব। কেউ কেউ বলেছেন, এখানে কৃত্রিম বন গড়ে তোলা যেতে পারে। তবে ছেং চি মিন নিজের গবেষণা ও অনুশীলনের মাধ্যমে উপায় খুঁজে পেতে চাইলেন।
এখানে বার্ষিক বৃষ্টিপাত মাত্র ৪৩০ মিলিমিটার এবং একবার বৃষ্টি হলে দীর্ঘ সময় আরও বৃষ্টি হয় না। এমন অবস্থায় ছেং চি মিন একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন। যেখানে গাছপালার কভারেজ ৩০ শতাংশের চেয়ে কম, সেখানে দক্ষিণ চীনের চা-বাগানের মতো, পাহাড়ের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত এক একটি ঘাসের মাফলার তৈরি করা হবে। তাহলে বৃষ্টির পানি সহজে মাটি ধরে রাখতে পারবে। আর যেখানে গাছপালার কভারেজ ৩০ শতাংশের চেয়ে বেশি, সেখানে চালু করতে হবে পাহাড়-বন্ধন নীতি। সেখানে সব পশুপালন কাজ নিষিদ্ধ করতে হবে।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পর, সংরক্ষণ এলাকার পানি আর জমির ক্ষয় পরিমাণ প্রতি বর্গকিলোমিটার বার্ষিক ৫ হাজার কিউবিক মিটার থেকে ১০০০ কিউবিক মিটারে কমে যায়। আর সংরক্ষণ অঞ্চলের আয়তন ৩৫ হাজার মুন থেকে বেড়ে ২ লাখ মু-এ দাঁড়ায়।
ছেং চি মিনের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইউন উ পাহাড়ে যেতে দু'তিন দিন সময় লাগে। ছেং চি মিন প্রতিবছর দশ-বারো বার ইউন উ পাহাড় ও স্কুলের মধ্যে আসা-যাওয়া করেন এবং অর্ধেক বছর ইউন উ পাহাড়ে কাটান। এ পর্যন্ত তিনি ৬০০ বারের মতো আসা-যাওয়া করেছেন এবং মোট যাত্রা ৫ লাখ কিলোমিটারের বেশি।
শুরুতে যখন ছেং চি মিন ইউন উ পাহাড়ে কাজ শুরু করেন, তখন কোনো উন্নত সরঞ্জাম ছিল না। তিনি থার্মোমিটার এবং হাইড্রোমিটার নিয়ে পাহাড়ের এক এক জায়গায় গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। প্রতিদিন বারো ঘন্টার মতো পাহাড়ে কাজ করেন এবং ১৫ কিলোমটার হাঁটেন। কৃষকদের আয় বৃদ্ধির জন্য তিনি জমির উপাদান বিশ্লেষণ করেন এবং চাষের সময় বসন্তকাল থেকে শরত্কালে পরিবর্তনের পরামর্শ দেন। তার গবেষণার মাধ্যমে বিশেষ পশুখাদ্য তৈরি করা হয়, যা ইউন উ পাহাড়ের প্রাকৃতিক চারণ রক্ষার পাশাপাশি গৃহচারণের চাহিদা পূরণ করে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ছেং চি মিন ও তার দলের গবেষণা ফলাফলের সাহায্যে চীনের নিংসিয়াং, শ্যানসি, কানসুসহ বিভিন্ন অঞ্চলের উদ্ভিদ পুনরুদ্ধার ও কৃত্রিম তৃণভূমির আয়তন ১০ লাখ মু ছাড়িয়েছে। চীনা কৃষিবিজ্ঞান একাডেমির অর্থনীতি গবেষণালয়ের আনুমানিক হিসেব অনুযায়ী, ১৯৮৯ সাল থেকে ছেং চি মিন ও তার দলের সৃষ্ট অর্থনৈতিক ফলপ্রসূতা ৫২১০ কোটি ইউয়ান।
গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে গবেষণা তহবিলের অভাব ছিল। গবেষণা অবহ্যাত রাখার জন্য ছেং চি মিন প্রতিবছর নিজের পকেট থেকে ৩০ হাজার ইউয়ান ব্যয় করেন। তখন তার পরিবারিক বার্ষিক আয় ছিল মাত্র ৪০ হাজার ইউয়ান। তিনি ছেলেকে কোনো খেলনা কিনে দেননি, স্ত্রীকে কোনো নতুন পোশাক কিনে দিতে পারেননি। এভাবে তার পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা গেল ৪০ বছরে একবারও বন্ধ হয়নি।
অর্জিত সাফল্যের কারণে ছেং চি মিন পদোন্নতির সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। তিনি চার দেয়ালের মধ্যে একটা অফিসে বসতে চাননি। তিনি বলেন, 'আমি ইউন উ পাহাড়ের।'
৪০ বছরের গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ফলাফল তিনি বিনামূল্যে তার দলের সদস্য ও অন্য কৃষিবিদদের সঙ্গে ভাগাভাগি করেন। তিনি আশা করেন, আরও বেশি যুবক-যুবতী তাদের কাজে অংশগ্রহণ করবেন।
ছেং চি মিন বলেন, ৪০ বছর খুবই ছোট। মারা যাওয়ার সময়ও তিনি এ পাহাড়কে দেখতে চান। তিনি এ পাহাড়ের ৬০ বছর পরের চেহারা দেখতে চান। (শিশির/আলিম/রুবি)