পাইতুর সূচিতে ৭৪০ মিলিয়নেরও অধিক ওয়েবসাইট, ৮০ মিলিয়ন চিত্র, ১০ মিলিয়ন মাল্টিমিডিয়া ফাইল রয়েছে। পাইতু ইন্টারনেটে মাল্টিমিডিয়া ফাইল যেমন-এমপিথ্রি, ভিডিও, চলচ্চিত্র ইত্যাদি খোঁজার সুযোগ দেয়। পাইতু চীনের প্রথম কোম্পানি যারা মোবাইল ভিত্তিক ওয়াপ ও পিডিএ সেবা প্রদান করে।
পাইতু'র সিইও রবিন লি। একজন চীনা শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে কম্পিউটার গ্রাফিকসে স্নাতক করার জন্য আবেদন করেছিলেন। অধ্যাপক তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, 'চীনে তোমাদের কম্পিউটার আছে?' প্রশ্নটি শুনে লি কিছুটা অপ্রস্তুতই হয়েছিলেন। বলেন, 'প্রশ্নটি আমাকে বিব্রত করেছে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি একদিন প্রমাণ করব কম্পিউটার শিল্পে চীন অন্যতম প্রভাবশালী দেশ।'
পরিশ্রম ও মেধাবী উদ্যোক্তা লি'র সেই স্বপ্নের সফলতা বিশ্বকে অবাক করেছে। ওই ঘটনার মাত্র আট বছর পরই ২০০০ সালে তিনি 'পাইতু' সার্চ ইঞ্জিন প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি এখন জনপ্রিয়তার দিক থেকে গুগলের পরই অবস্থান করছে। বর্তমানে চীনের ৮০ শতাংশ মার্কেট শেয়ার পাইতুর দখলে। ২০০৫ সালে যখন চীনে গুগল প্রবেশ করে তখনো পাইতুর দখলে ৪০ শতাংশ মার্কেট শেয়ার ছিল। ২০১০ সালে গুগল চলে গেলে পাইতুর মার্কেট শেয়ার বেড়ে হয় ৭৫ শতাংশ। পাইতু এখন ৬০ বিলিয়ন ডলারের একটি বৃহৎ কোম্পানি। যেটিকে আলিবাবা বা টেনসেন্টের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
চীনের ডিজিটাল সাফল্যের অন্যতম রূপকার মনে করা হয় রবিন লিকে। যিনি একজন উদ্ভাবক পথপ্রদর্শক, বিজ্ঞানী ও উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে সমানভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর তৈরি সার্চ ইঞ্জিন পাইতু এখন চীনের প্রত্যেকের চাহিদা মেটাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার নানা তথ্য, একজন ভ্রমণকারীর জন্য রাস্তাঘাটের ম্যাপ, বলা যায় পাইতুর চোখেই এখন চীনারা ডিজিটাল জগতকে দেখছে।
বর্তমান বিশ্বে শীর্ষ ই-কমার্স মার্কেট এখন চীন। স্মার্টফোন আর কিউআর কোডের কল্যাণে দেশটি এখন বিশ্বের অন্যতম নগদ অর্থবিহীন লেনদেনের দেশ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) জগতেও চীন আগামী দিনের বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে চায়। গুগলের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান এরিক এমারসন স্মিডেট বলেন, আগামী এক দশকে চীনের এআই সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে যাবে। চীনের এ চ্যালেঞ্জকে রবিন লির চেয়ে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আর কেউ নেয়নি। ২০১৭ সালের প্রথম তিন প্রান্তিকেই তাঁর কোম্পানির ৯ বিলিয়ন ডলার আয়ের ১.২ বিলিয়ন ডলার তিনি ব্যয় করেছেন গবেষণায়। যার বেশির ভাগ বিনিয়োগই এআইতে। লি মনে করেন, এআইর কল্যাণে বিশ্ববাজার শাসন করতে পারবে পাইতু। তিনি বলেন, চীন হচ্ছে একটি বৃহৎ দেশ। এখানে সবাই একই ভাষায় কথা বলে। তাই এআইতে এখানে সাফল্যের দারুণ সুযোগ রয়েছে। চালকবিহীন গাড়ি নিয়েও কাজ করছে পাইতু। যদিও তা এখন পুরোপুরি সফলতা অর্জন করতে পারেনি, কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। তবে পাইতুর স্বচালিত গাড়ির প্ল্যাটফর্ম 'অ্যাপোলো' বিশ্বের ১৩০টি কোম্পানি গ্রহণ করেছে।
ভয়েস চেনার সফটওয়্যারও চালু করেছে পাইতু। বলা হয়, একজন চীনার চেয়েও অনেক ভালো ম্যান্দারিন ভাষা বুঝতে পারে এ সফটওয়্যার। এটির মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া সন্তানদেরও খুঁজে বের করা যাবে। লি বলেন, 'আমাদের ভিশন হচ্ছে ভাষা ব্যবহার করে সব ডিভাইসের সঙ্গে মানুষের ভাব বিনিময়ের ব্যবস্থা করা।'
১৯৬৮ সালে রবিন লি জন্মগ্রহণ করেন। মা-বাবার পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। মা-বাবা দু'জনই ছিলেন কারখানাকর্মী। ১৯৯১ সালে পিকিং ইউনিভার্সিটি থেকে ইনফরমেশন সায়েন্সের ওপর স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন লি। এরপর ফেলোশিপ পেয়ে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের দ্য স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্ক-বাফেলোতে। ১৯৯৪ সালে সেখান থেকে মাস্টার ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি ডোও জোন্স অ্যান্ড কোম্পানির আইডিডি ইনফরমেশন সার্ভিসে যোগ দেন। সেখানে ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের অনলাইন সংস্কারের জন্য সফটওয়্যার ডেভেলপ করেন। সার্চ ইঞ্জিনের জন্য অলগারিদম নিয়েও কাজ করেন তিনি। পরে তিনি ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিন ইনফেসিকে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন। ২০০০ সালে তিনি দেশে ফিরে এসে পাইতু প্রতিষ্ঠা করেন।
লির শৈশব কেটেছে চীনের ইয়াংকুয়ান শহরে। তিনি যে হাই স্কুলে পড়তেন তাতে এক হাজার ৮০০ শিক্ষার্থীর জন্য ছিল পাঁচটি অ্যাপল টু কম্পিউটার। ফলে সেখানে যারা অঙ্কে ভালো করত তাদেরই অগ্রাধিকার দেওয়া হতো কম্পিউটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে। সে সুযোগটি পেয়েছিলেন লি। কিন্তু অঙ্ক থেকে দ্রুতই তিনি কম্পিউটারের প্রেমে পড়ে যান। তিনি বলেন, 'আমার কাছে কম্পিউটারকে ম্যাজিক্যাল মনে হয়েছে।'
লি তাঁর অ্যাকাডেমিক সাফল্যের পেছনে মায়ের অবদানকে বড় অনুপ্রেরণা হিসেবে মনে করেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'মা বলেছেন, সাফল্যের কোনো পেছনের দরজা নেই। যদি তুমি সুন্দর জীবন চাও, ভালো চাকরি চাও তাহলে তোমাকে পড়াশোনায় কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। মায়ের সেসব কথা আমি মন দিয়ে মেনেছিলাম।'
লি চীনের অন্যতম শীর্ষ ধনী। ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তাঁর সম্পদের পরিমাণ ১৮.৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও ফোর্বস ম্যাগাজিনের হিসাব অনুযায়ী তাঁর সম্পদের পরিমাণ ১২.৩ বিলিয়ন ডলার। তিনি বিশ্বের ১২৪তম ধনী ও চীনে অষ্টম। ২০১১ সালে এশিয়ান সায়েন্টিস ম্যাগাজিন তাঁকে এশিয়ার শীর্ষ ১৫ বিজ্ঞানীর অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০১ সালে তিনি চীনের শীর্ষ ১০ উদ্ভাবনী পথপ্রদর্শকদের একজন নির্বাচিত হন।
রবিন লি'র কিছু মন্তব্য:
'লক্ষ্য নির্ধারিত হলে কোনোমতেই পরিবর্তন হবে না'
মানুষের জীবনের পথ সহজ হতে পারে। এই সহজ পথ নিজের মতো থাকবে। তবে যদি আমরা আপোষ করি, অন্যের চাপে নতি স্বীকার করি, তাহলে আমরা নিজের পথ থেকে দূরে যাবো, নিজের সময়কে নষ্ট করবো। আস্থা খুব শক্তিশালী জিনিস। আমাদের নিজের প্রিয় কাজ করা উচিত, অন্যরা যা করবে, তা আমাদের জন্য সবসময় সঠিক হবে না।
'শুরুতে আমরা যে নির্দেশনা নির্ধারণ করেছিলাম, তা না থাকলে পাইতু দেউলিয়া হতে শুধু ৩০ দিন সময় লাগবে।'
রবিন লি কোম্পানির কর্মীদের দেওয়া এক চিঠিতে নিজের দল এবং নিজেকে মনে করিয়ে দেন: যদি পাইতু ব্যবহারকারীদের সমর্থন হারায়, মনের দৃঢ়তা হারায়, তাহলে আমাদের পাইতু অল্প সময়ের মধ্যে দেউলিয়া হয়ে যাবে।
'এআই যেন শিল্প সংস্কারের মতো'
ভবিষ্যতে চীনের ইন্টারনেটের উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি হবে এআই অর্থাত্ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। অর্থ থেকে রিয়েল এস্টেট, শিক্ষা, চিকিত্সাসহ, যে শিল্প আপনার জীবনের সঙ্গে জড়িত, এতে এআইর মাধ্যমে পরিবর্তন ঘটাতে পারবে। এআই যেন শিল্প সংস্কারের মত গুরুত্বপূর্ণ।
'ইন্টারনেট হল এপেটাইজার, এআই হলো আসল মেইন কোর্স'।
ইন্টারনেটের জন্য 'দ্রুত' সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা যেন পাশ্চাত্য খাবারের এপেটাইজারের মত, খুব তাড়াতাড়ি টেবিলে রাখা হয়। তবে তা প্রযুক্তির জন্য বড় কোনো চ্যালেঞ্জ নয়। এ দিক থেকে এআই হল সূচক, গণনার পদ্ধতি এবং গণনার সামর্থ্য এই তিন বিষয়ের সমন্বিত উন্নয়ন। তাই তাতে বেশি সময় লাগবে। তা যেন একটি মেইন কোর্সের মত, বেশি সময় এবং ধৈর্য লাগে, তবে এর 'পুষ্টি'ও আরো বেশি। এই 'আস্তে' থেকে 'দ্রুত' হওয়ার প্রক্রিয়া, ঠিক শিল্পের রূপান্তরে প্রযুক্তির উদ্ভাবন সম্প্রসারণের প্রক্রিয়ার মতো।
'এআই নিয়ে হাসিখুশি ফুর্তিবাজ লোক হলেও, আমারও উদ্বেগ আছে'।
সব এআই পণ্য এবং প্রযুক্তি লোকজনের যৌথ অনুসরণের চিন্তাধারা এবং নিয়মের ভিত্তিতে উন্নত করা উচিত। প্রথমত: এআই-এর সর্বোচ্চ নিয়ম হল নিরাপদ এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। দ্বিতীয়ত, এআই উদ্ভাবনের উদ্দেশ্য হলো মানবজাতির আরো সমানভাবে প্রযুক্তিগত সামর্থ্য জোরদার করা। তৃতীয়ত: এআই দিয়ে মানবজাতিকে শেখানোর কাজটি করা। মানবজাতির স্থলাভিষিক্ত করা নয় এবং মানবজাতিকে অতিক্রম করা নয়। অবশেষে, এআই-এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো মানবজাতিকে আরো স্বাধীন এবং আরো বেশি সম্ভাবনা তৈরি করা।
'শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে চাকরি দেবো, সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা দেবো, চূড়ান্ত ফলাফল দেখবো, শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করবে'।
পাইতু'র মানব সম্পদ বিভাগের চিন্তাধারা এমন: শ্রেষ্ঠ মানুষকে চাকরি দেওয়া, সবচেয়ে বড় সুযোগ দেওয়া, শ্রেষ্ঠ মানুষের শ্রেষ্ঠ কাজের ব্যবস্থা করা। বিভিন্ন লোকের অবদানও বিভিন্ন রকম, তার পাওয়া পুরস্কারও ভিন্ন হওয়া উচিত বলে মনে করে পাইতু।
কোম্পানি স্থাপন নিয়ে রবিন লি' কিছু পরামর্শ:
সামনের দুই বছরের জন্য পরিকল্পন করা।
কম প্রতিশ্রুত দেয়া, বেশি বাস্তবায়ন করা।
যখন আপনার টাকা লাগে না, তখন ঋণগ্রহণ করা।
ক্রেতাকে বিক্ষিপ্ত না করা।
শুরুতেই মুনাফার জন্য কাজ করা ঠিক না।
নিজের কাজের ক্ষেত্রে মনোযোগ রাখা।
প্যাশন বজায় রাখা উচিত।