জ্যাক মার জীবন:
যদি আপনিও স্বপ্ন দেখেন নিজের চেষ্টা, মেধা আর শ্রম দিয়ে একদিন নিজেকে ও পৃথিবীকে বদলে দেয়ার—তবে আপনার জন্য লড়াকুর উপহার: বাংলা ভাষায় জ্যাক মা-এর পূর্ণাঙ্গ জীবন কাহিনী। জ্যাক মা একজন চীনা উদ্যোক্তা, যিনি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় অনলাইন পাইকারী ক্রয়-বিক্রয় সাইট আলিবাবা'র প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক সিইও ও বর্তমানে নির্বাহী চেয়ারম্যান। ২০১৯ এর এপ্রিল মাসের হিসাব অনুযায়ী তাঁর বর্তমান সম্পদের পরিমাণ ৪০.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! এই বিপুল সম্পদ তাঁকে বর্তমান বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকা এনে দিয়েছে।
বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ব্যবসা বাণিজ্যকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে আসার পেছনে যে কয়জন মানুষের অবদান সবচেয়ে বেশি– জ্যাক মা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
ফোর্বস ম্যাগাজিন তাঁকে প্রতি বছরই বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী মানুষদের একজন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। ২০১৭ সালে ফরচুন ম্যাগাজিন তাঁকে পৃথিবীর সেরা ৫০জন নেতার তালিকায় ২য় স্থান দেয়।
"জ্যাক মা বা মা ইউন" এর জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৫ই অক্টোবর, চীনের চ্যচিয়াং প্রদেশের হাংচৌ শহরের এক দরিদ্র পরিবারে। তাঁর বাবা-মা ছিলেন পেশাদার গল্প বলিয়ে ও সংগীত শিল্পী। এই পেশায় আয় রোজগার খুব বেশি হত না। দুই ভাই ও এক বোনের মাঝে দ্বিতীয় মা ইউন যে এতবড় বিজনেস ম্যাগনেট হবেন– তা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি।
ছোটবেলায় তাঁর প্রথম প্যাশন ছিল ইংরেজি ভাষা শেখা। ঐ বয়সেই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে ইংরেজি শেখার কোনো বিকল্প নেই। হাংচৌ ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে আসা ইংরেজি-ভাষী পর্যটকদের ফ্রি গাইড হিসেবে কাজ করতেন তিনি।
৯ বছর ধরে তিনি ৭০ মাইল পথ সাইকেল চালিয়ে পর্যটকদের বিভিন্ন এলাকা ঘুরিয়ে দেখাতেন, শুধুমাত্র ইংরেজি শেখার জন্য!
এরকমই এক পর্যটকের সাথে তাঁর এক পর্যায়ে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সেই ব্যক্তিই মা ইউনকে 'জ্যাক মা' নাম দেন। কারণ চীনা নামটি ইংরেজদের জন্য উচ্চারণ করা কঠিন ছিলো।
জ্যাক মা খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন না। চীনে কলেজ ভর্তি পরীক্ষা বছরে মাত্র একবার হয়। সব কলেজেই একই সময়ে পরীক্ষা হয় এবং পরীক্ষায় পাশ করে কলেজে সুযোগ পেতে জ্যাক মার ৪ বছর সময় লাগে।
তিনি ১৯৮৮ সালে হাংচৌ টিচার্স ইন্সটিটিউট (বর্তমান 'হাংচৌ নরমাল ইউনিভার্সিটি) এর ইংরেজি বিভাগ থেকে বি.এ ডিগ্রি নিয়ে বের হন।
ব্যর্থতার গল্প:
আলিবাবার আগে জ্যাক মা সত্যি সত্যিই একজন পুরোপুরি ব্যর্থ মানুষ ছিলেন। ৪বার ফেল করে কলেজে ঢোকার পর, যখন পাশ করে বের হলেন– তখন ব্যর্থতা কাকে বলে, তা তিনি আবারও হাড়ে হাড়ে টের পেলেন। জ্যাক মার জীবন কাহিনীর সবচেয়ে করুণ, কিন্তু শক্তিশালী অংশ এটি। 'হাংচৌ তিয়ানচি ইউনিভার্সিটি'তে ইংরেজির লেকচারার হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে, তিনি ৩০টি চাকরির জন্য চেষ্টা করেন এবং প্রতিটিতেই ব্যর্থ হন।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি টক শোতে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে জ্যাক মা বলেছিলেন : "আমি যখন পুলিশের চাকরির জন্য আবেদন করলাম, ১০জনের মধ্যে ৯জনের চাকরি হল; আমাকে বলা হল, 'তুমি উপযুক্ত নও'। – আমার শহরে যখন কেএফসি আসলো, আমরা ২৪ জন চাকরির আবেদন করেছিলাম। ২৩জনের চাকরি হল, আমি বাদ পড়লাম। -হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে আমি ১০ বার আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলাম। তারপর চিন্তা করলাম 'হয়তো একদিন আমি হার্ভার্ডে লেকচার দেব।"
আরেকটি সাক্ষাৎকারে জ্যাক মা বলেন, "২০০৩ সালে যখন আমরা 'থাওবাও' শুরু করি, তখন আমার টিমের সবাইকে বলা হয়েছিল, বাসায় গিয়ে বিক্রি করার মত ৪টি জিনিস নিয়ে আসতে। আমাদের বেশিরভাগই বিক্রি করার মত ৪টি জিনিস বাসায় খুঁজে পাইনি। কারণ আমরা খুবই গরীব ছিলাম।"
আলিবাবা অধ্যায়:
১৯৯৮ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত জ্যাক মা চীনের বৈদেশিক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি আইটি কোম্পানির প্রধান হিসেবে কাজ করেন।
১৯৯৯ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি নিজের শহর হাংচৌতে ফিরে আসেন এবং ১৮জন বন্ধু মিলে অনলাইন পাইকারি পন্য বেচাকেনার সাইট আলিবাবা প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন।
আলিবাবা এর নামকরন এর ইতিহাস বলতে গিয়ে, জ্যাক মা বলেছিলেন:
"শুরু করার সময়ে আমার মনে হয়েছিল, ইন্টারনেট যেহেতু একটি বৈশ্বিক ব্যাপার, আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামটিও বৈশ্বিক হওয়া উচিৎ, সেইসাথে নামটি যেন সহজেই চেনা যায়। হঠাৎ একদিন তার মনে হল- আলিবাবা নামটি ভালো হতে পারে।
সৌভাগ্যই বলতে হবে, চিন্তাটি মাথায় আসার সময়ে আমি সানফ্রান্সিস্কোর একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম। ওয়েট্রিস খাবার সার্ভ করতে এলে, আমি তাকে বললাম আলিবাবাকে চেনে কিনা। সে বলল সে চেনে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আলিবাবা কে? – সে বলল "চিচিং ফাক"! – অসাধারণ!
রাস্তায় বের হবার পর আমি প্রায় ২০ জন মানুষকে আলিবাবা সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। সবাই আলিবাবা, ৪০ চোর ও তাদের গুপ্তধন– সবই জানে। আমি বুঝে গেলাম এটা আসলেই দারুণ একটা নাম হতে পারে। বলতে গেলে সবাই এটা একবারে ধরতে ও মনে রাখতে পারবে, আর নামটা শুরু হয় A দিয়ে"।
তাঁদের এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল, চীনের আভ্যন্তরীণ ই-কমার্স মার্কেট উন্নত করা। সেই সঙ্গে, চীন দেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে নিতে সাহায্য করা।
জ্যাক মা ও আলিবাবা
২০০৩ সালে জ্যাক মা আন্তর্জাতিক ই-কমার্স সিস্টেমের উন্নতির জন্য eBay এর আদলে Taobao Marketplace, আলি-পে, আলি মামা প্রতিষ্ঠা করেন।
এসব উদ্যোগ সেই সময়ে পাগলামি হিসেবে দেখা হয়েছিল। কেউ ভাবেনি যে প্রতিটি উদ্যোগেই জ্যাক মা সফল হবেন। সে সময়ে একটি পত্রিকা তাঁকে 'ক্রেজি জ্যাক' বা 'পাগল জ্যাক'– নামে অভিহিত করেছিল।
কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই দেখা গেল, থাওবাও দারুণ সফল একটি ই-কমার্স সাইট হয়ে উঠেছে। এ সাফল্যের কারণে ই-বে বিপুল অর্থের বিনিময়ে থাওবাওকে কিনে নিতে চায়, কিন্তু জ্যাক মা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং তার বদলে ইয়াহুর সহপ্রতিষ্ঠাতা জেরি ইয়াং এর কাছ থেকে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ গ্রহণ করেন।
বর্তমানে থাওবাও মার্কেটপ্লেস বিশ্বের এক নম্বর ই-কমার্স ওয়েবসাইট। ২০১৮ সালের অ্যালেক্সা রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি মাসে গড়ে ৬১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ সাইটটি ব্যবহার করে।
আলি পে (বর্তমান Ant Financial) পৃথিবীর সবচেয়ে দামী 'ফিনটেক' বা ফাইনানশিয়াল টেকনোলজি কোম্পানি, যার বর্তমান মার্কেট ভ্যালু ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! মূলত এই আলি-পে'র আইডিয়ার কারণেই জ্যাক মাকে পাগল খেতাব দেয়া হয়েছিল। বর্তমানে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় মোবাইল এবং অনলাইন পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম।
বর্তমানে জ্যাক মা আলিবাবা গ্রুপের নির্বাহী চেয়ারম্যান। আলিবাবা গ্রুপের অধীনে মোট ৯টি বড় কোম্পানি রয়েছে।
২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তিনি ঘোষণা দেন, তিনি এক বছরের মধ্যে আলিবাবা থেকে পুরোপুরি অবসর নিয়ে শিক্ষার প্রসার ও মানবসেবার কাজে মনোনিবেশ করবেন।
এর আগে তিনি আলিবাবার সিইও পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নির্বাহী চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। জ্যাক মার কথা অনুযায়ী, প্রতিটি সফল মানুষের ৫০ বছর বয়স হওয়ার পর অর্থের চিন্তা ছেড়ে দিয়ে মানবসেবা ও নতুনদের সফল করার কাজে মনোনিবেশ করা উচিৎ।
ব্যক্তিজীবন:
স্টিভ জবস এর মতো জ্যাক মা-ও তাঁর পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনকে মিডিয়ার বাইরে রাখতে পছন্দ করেন। তাঁর পরিবারের আভ্যন্তরীণ বিষয় সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না।
ছাত্র অবস্থায় জ্যাক মার পরিচয় হয় ক্যাথি চ্যাং-এর সঙ্গে। পরবর্তীতের তাঁরা বিয়ে করেন। জ্যাক মার সাফল্যের পেছনে ক্যাথির অবদান সব সময়েই স্বীকার করেন জ্যাক মা।