'তুমি আমার জলযাত্রায়, আমি তোমার দৃষ্টিতে
  2019-07-03 08:46:01  cri

এখানে চারটা জিনিষ প্রচুর: তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, লবণ ও রোদ; দুটি জিনিষের অভাব: মাটি ও তাজা পানি; একটি জিনিষ বেশি: টাইফুন। এখানে সারা বছর শুধু একটি ঋতু এবং একসময় এখানে কোনো প্রাণ ছিল না। এ জায়গার নাম: সি সা জং চিয়ান দ্বীপ। কিন্তু এখন এটি পাঁচ রঙের একটি দ্বীপে পরিণত হয়েছে। আজকের 'পুবের জানালা' আসরে আমরা এই 'রঙে রঙিন' দ্বীপ সম্পর্কে আপনাদের ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব।

'সাদা' সৈকত

করপোরাল ওয়াং থুং প্রতি শনিবার সাদা সৈকতে এসে আবর্জনা পরিষ্কার করেন। ফেনা, প্লাস্টিক, ড্রিফটউড, সোডার বোতল ইত্যাদি তিনি কুড়িয়ে নেন সৈকত থেকে। একবার তিনি সৈকত থেকে বাণিজ্য-জাহাজের সার্চ লাইট পর্যন্ত কুড়িয়ে পেয়েছেন।

সাদা এ দ্বীপের মূল রঙ। দশ-বারো হাজার বছর ধরে এটি সাদা সৈকতে পরিণত হয়। এ দ্বীপে কোনো মাটি ছিল না। সাদা সৈকতের একমাত্র রঙ। সাদা বালি ৯০ শতাংশ রোদ প্রতিফলিত করতে পারে। তাই এখানে বেশিদিন থাকলে চোখের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। লোকে বলে, সাহস না-হলে এ দ্বীপে কেউ আসবে না।

সাদা সুখের রঙ। ২০১৬ সালে দুটি মেয়ে প্রথমবারের মতো জং চিয়ান দ্বীপে আসেন। তাদের স্বামীরা দ্বীপের সৈনিক। দুটি মেয়ে সাদা রঙের বিবাহের পোশাক পরে এবং তাদের স্বামী সাদা রঙের নৌবাহিনীর ইউনিফর্ম পরে বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করে। সাদা সৈকতে সাদা পোশাক পরে দুটি দম্পতি তাদের বিশেষ বিবাহ ছবি তোলে।

সৈনিকদের হাতে সবুজ দ্বীপ

জং চিয়াং দ্বীপে টিকে থাকা মানুষ ও গাছের জন্য কঠিন এক ব্যাপার। এক সময় দ্বীপে কোনো গাছ ছিল না। ৪০ বছর আগে, নৌবাহিনী ১৫ ধরনের ৮৯০টি গাছ দ্বীপে পাঠায়। তবে বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে একটি গাছ ছাড়া সব গাছ মরে যায়। বেঁচে থাকা গাছটি তখনকার স্কোয়াড নেতা উ রুই খুং রোপন করেছিলেন। তখন উর বয়স ছিল ২৩। এখন তিনি ৬০ বছর বয়সী একজন প্রবীণ।

মাটি না-থাকলে গাছ রোপন করা যায় না। তাই বাহিনী একটি নিয়ম চালু করে। নিয়মটি হচ্ছে: যখন একজন সৈনিক বাড়িতে ছুটি কাটাতে যাবেন, তখন দ্বীপে ফিরে আসার সময় জন্মভূমি থেকে কিছু মাটি নিয়ে আসবেন। কখনও কখনও মাটি আনার জন্য সৈনিকরা নিজেরা কিছু আনতো না; শুধু মাটি আনতো। এখন জং চিয়ান দ্বীপে যে-মাটি আছে, তা এসেছে ২০টি বিভিন্ন প্রদেশ থেকে। সৈনিকরা নিজেদের হাত দুটি দিয়ে ৭০০০টির বেশি গাছ রোপন করেন। ১৯৮২ সালে প্রথমবারের মতো ৩০০টি নারকেল গাছ বেঁচে যায় এবং ২০ বছর পর, এ নারকেল গাছ প্রথমবারের মতো ফল দেয়। এ প্রথম নারকেল এখনও সম্মাননা রুমে রাখা আছে।

ছিও হুয়া ১৯৯৯ সালে এ দ্বীপে আসেন এবং তিনি এখানে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় থাকেন একজন সৈনিক হিসেবে। তিনি জানান, নিজের হাতে কতো গাছ রোপণ করেছেন, এখন আর তার কোনো হিসাব নাই। তবে দ্বীপের গাছগুলো তাঁর ও তাঁর মতো সৈনিকদের পরিশ্রম ও সবুজের প্রতি ভালোবাসা ফসল।

সিসা কালো

সুপেরিয়র সৈনিক ছাং ওয়ে প্রতিবার যখন পরিবারের সঙ্গে ভিডিও চ্যাট করেন তখন ফিল্টার ব্যবহার করেন। কারণ, তার মুখ কালো হয়ে গেছে। তিনি ভয় পান যে, তাঁর মা তাঁর মুখ দেখে দুঃখ পাবেন। তবে ছাং ওয়ের মুখ সবচেয়ে কালো তা নয়। সৈনিক হং ইউং ছুন তার চেয়ে আরও কালো, দেখতে চকলেটের মতো। তীব্র রোদে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিতে হয় সৈনিকদের এবং কালো তাদের স্ট্যান্ডার্ড ত্বক রঙ। তারা এমনকি 'সিসা কালো' নামে একটি গান রচনা করেন। গানে বলা হয়েছে: কারও ত্বক কালো না-হলে তার লজ্জা বোধ করা উচিত।

সৈনিক ছাং খাই যখন দ্বীপে আসেন তখন তার বয়স মাত্র ১৮ বছর। তার নেতা কালো রঙের মোটর তেল তার মুখে মাখিয়ে তাকে স্বাগত জানান। ছাং খাই কখনও বিশেষ এ অনুষ্ঠান ভুলবেন না। তিনি তেলের মেশিন বাহিনীতে যোগ দেন এবং তখন থেকে কালো তার জীবনের রঙে পরিণত হয়।

লাল হিপ্পোক্যাম্পাস ঘাস

সাদা সৈকতে দেখা যায় লাল রঙের একটি উদ্ভিদ, যার নাম হিপ্পোক্যাম্পাস ঘাস। এর একটি বৈশিষ্ট্য হলো: পানির অভাব হলে এটি আরও লাল হবে। ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ফান ছি হং বলেন, জং চিয়ান দ্বীপে মাত্র তিনটি জিনিষ লাল রঙের: পতাকা, হিপ্পোক্যাম্পাস ঘাস এবং হিপ্পোক্যাম্পাস ঘাস দিয়ে তৈরি পতাকা। সিপিসির ১৮তম জাতীয় কংগ্রেসের সময় তারা হিপ্পোক্যাম্পাস ঘাস দিয়ে ২৫০০ বর্গমিটার আকারের জাতীয় পতাকা তৈরি করেন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৭০তম বার্ষিকীতে তারা একইভাবে সিপিসির পতাকা তৈরি করেন। বড় এ পতাকা দ্বীপের এয়ারিয়াল ছবিতে দেখা যায়, যা জং চিয়ান দ্বীপে চীনের সার্বভৌমত্বরের প্রতীক।

সৈনিক ওয়াং ছাও-এর প্রিয় একটি কাজ হচ্ছে, জীবন্ত এই পতাকার ঘাসগুলোর গোড়ায় পানি দেওয়া। ওয়াং চাও বলেন, সাগরের পানি দিলে এ ঘাস বেশি দিন বেঁচে থাকবে।

নৌবাহিনীর নীল

সৈনিক ও ই ছাও মজার একটি দৃশ্য আবিষ্কার করেন। যখন বাণিজ্য-জাহাজ দ্বীপের কাছাকাছি আসে, জাহাজের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, এখন দ্বীপে ৪জি সিগনাল পাওয়া যায় এবং এ জাহাজগুলো এ সুবিধা ভোগ করতে চায়। আসলে নীল এ সাগরের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য জং চিয়ান দ্বীপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে দুর্যোগ মোকাবিলা, মানবিক ত্রাণ এবং জলযাত্রার নিরাপত্তা রক্ষার জন্য এই দ্বীপক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন চীনা নৌবাহিনীর জাহাজ দ্বীপের কাছাকাছি আসে, তখন তারা সবসময় দ্বীপে এমন একটি তথ্য পাঠায়: তুমি আমার জলযাত্রায়, আমি তোমার দৃষ্টিতে। দ্বীপের সৈনিকরা অন্যান্য সৈনিকদের মতো জাহাজযোগে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে কর্তব্য পালন করতে পারে না। তবে তারা সবসময় জলযাত্রার একটি অংশ। (শিশির/আলিম/রুবি)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040