চীনের হুপেই প্রদেশের সেন নং চিয়া বনাঞ্চলের উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত জাতীয় ৫-এ পর্যায়ের এক দর্শনীয় স্থান—তা চিও হু জলাভূমি পার্ক। মধ্য-চীনে তা চিও হু জলাভূমির প্রাকৃতিক পরিবেশ সবচেয়ে ভাল। এখানকার জীববৈচিত্র্যও উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়া, এই জলাভূমি একটি গুরুত্বপূর্ণ পানি-উত্স। গবেষণা ও পরিবেশ সংরক্ষণের জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ এ পার্ক। তবে, গতে শতাব্দীর ৯০-এর দশকে, তা চিও হু-র প্রাকৃতিক পরিবেশ অন্যরকম ছিল। বন ধ্বংস, হ্রদকে চাষের ভূমিতে পরিণত করাসহ নানা কারণে এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে পর্যটকসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে বর্জ্যের দূষণও বাড়ে। ফলে পরিবেশের আরও ক্ষতি হয়।
জলাভূমি সংরক্ষণ এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০১৩ সাল থেকে তা চিও হু এলাকায় চালু হয় সেন নং চিয়া অঞ্চলের বৃহত্তম একটি স্থানান্ত-প্রকল্প। ৪৫৭টি পরিবারকে জলাভূমি পার্কের তা চিও হু গ্রাম থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। তারা ২০ কিলোমিটার দূরে পিং ছিয়ান নামের একটি পুরাতন নগরে নতুন করে বসতি গড়ে তোলে। ৫০ বছর বয়সি লু কুয়াং হুয়া ২০১৪ সাল থেকে তা চিও হু গ্রামের সিপিসি সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি নিজের চোখে গেল কয়েক বছরে তা চিও হু এলাকার পরিবর্তন দেখেছেন। তিনি বলেন, এখন ৯০ শতাংশ বাসিন্দাকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং পশুপালন এখানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই কোনো দূষণ নেই। পাশাপাশি, মানুষ অনেক কমে যাওয়ায় গার্হস্থ্য-বর্জ্যের পরিমাণও অনেক কমেছে। আগে যারা দর্শনীয় স্থানে বাস করতেন, তাদের ব্যবহৃত দূষিত পানি সরাসরি হ্রদে প্রবেশ করত এবং জমিতে যে-কীটনাশক ও সার ব্যবহার করা হতো, সেগুলোও সরাসরি হ্রদে প্রবেশ করতো। এখন আর এমন সমস্যা নাই।
তা চিও হু এলাকা থেকে যারা নতুন নগরে স্থানান্তরিত হয়েছেন, তারা পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসা করছেন। পিং ছিয়ান পুরাতন নগরের ৯৯ শতাংশ পরিবার পর্যটন-শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তা চিও হু এলাকায় যারা ভ্রমণে যাবেন, তারা এসব পরিবারের সঙ্গে বাস করতে পারেন। এখানে সবমিলিয়ে ১১ হাজারটি শয্যা আছে। তার মানে ১১ হাজার পর্যটক এখানে একসঙ্গে রাত কাটাতে পারবেন। সিয়ে চুন ছেং আগে তা চিও হু গ্রামে দোকানের জন্য পণ্য পরিবহনের ব্যবসা করতেন। ২০১৩ সালে স্থানান্তর-প্রকল্প অধীনে তিনি পিং ছিয়ান পুরাতন নগরে আসেন এবং এখানে দো'তলা রেস্টুরেন্ট খোলেন। তার ব্যবসা অনেক ভাল এবং আয় আগের ১০ গুণা। তিনি বলেন, "পর্যটনবিষয়ক ব্যবসা করার পর আমার আয় অনেক বেড়েছে। প্রতিবছর ৩ লাখ ইউয়ান আয় করতে পারি আমি, যা নিট আয়। পর্যটনশিল্প উন্নয়নের সাথে সাথে জীবনযাপনের মানও উন্নত হয়েছে এবং মানুষের ধারণাও বদলে গেছে। পাহাড় আবার সবুজ হয়ে উঠেছে; মানুষ আর গাছ কাটে না। গার্হস্থ্য-বর্জ্যও অনেক কমেছে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ ভাল হয়েছে।"
পিং ছিয়ান পুরাতন নগরের উন্নয়ন দেখে অনেক তরুণ-তরুণীও এখানে ফিরছেন। তরুণ ছাং লং পাহাড়ে বড় হয়েছেন। পশুপালন করতেন। আর এ কাজে প্রতিদিন তাকে দূরে যেতে হতো। তখনও এলাকায় বিদ্যুত আসেনি। তিনি কখনও ভাবেননি যে, তার জীবন এমন হতে পারে। তার পরিবার ২০১৬ সাল থেকে পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসা শুরু করে এবং ছুটির সময়ে তাদের ব্যবসা খুবই ভাল হয়। তখন সব শয্যা আগেই বুক হয়ে থাকতো। একজন পর্যটকতো তাদের বাড়িতর একটি সোফা বুক করতে চেয়েছিলেন! ছুটির সময় তাদের এক সপ্তাহের আয় ২০ হাজার ইউয়ান। আগে তাদের সারা পরিবার অর্ধেক বছরে এ বেশি টাকা আয় করতে পারত না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি নিজেকে নিজে বলতেন, পাহাড় থেকে একবার বের হতে পারলে আর ফিরবো না। তবে তিনি নিজের প্রতি নিজের প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি! কারণ, তার জন্মস্থান আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছে এবং তিনি গ্রামের উন্নয়নে নিজের উন্নয়নের সুযোগ দেখেছেন। তিনি ভাবেন, তার মতো দক্ষ ও শিখিত তরুণ গ্রামে ফিরে আসলে জন্মস্থান আরও উন্নত হবে।
তা চিও হুর একজন নেতা হুয়াং লেই বলেন, এখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নেওয়া তরুণ-তরুণীদের গ্রামে ফিরে নিজেদের ব্যবসা গড়ে তুলতে উত্সাহ দেয় সরকার এবং তাদের নবায়ন ও আধুনিক ধারণা গ্রামের উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখছে।
তা চিও হু সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উঁচুতে অবস্থিত বলে, শীতকালে এখানে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে এবং তাপমাত্রা শূন্যের নিচে ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়। তাই তখন এখানে পর্যটকের সংখ্যা খুব কমে যায়। তাই এখন সবাই শুধু গ্রীষ্মকালে পর্যটন-ব্যবসা করে। পিং ছিয়ান পুরাতন নগরের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন নিয়ে হুয়াং লেই বলেন, "প্রথমত, প্রতিটি পরিবার নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসা করবে। আমাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে না। তা ছাড়া, শীতকালে আমরা বাস্তব অবস্থা অনুযায়ী নতুন পর্যটন-কর্মসূচি গ্রহণ করব এবং পাশাপাশি আমদের সেবার মান উন্নত করব।"
তা চিও হু গ্রামের পরিবর্তন আসলে চীনের হাজার হাজার গ্রাম রূপান্তরের একটি উদাহরণ। গ্রাম পুনরুদ্ধার ও দারিদ্র্যমুক্তির প্রচেষ্টার ফল হচ্ছে তা চিও হু'র মতো হাজার হাজার গ্রামের রূপান্তর। (শিশির/আলিম/রুবি)