চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও ক্ষতিকর প্রমাণিত হচ্ছে: শ্বেতপত্র (অর্থ-কড়ি; ৮ জুন ২০১৯)
  2019-06-08 18:33:34  cri

১. সম্প্রতি 'চীন-মার্কিন আর্থ-বাণিজ্যিক সংলাপে চীনের অবস্থান' শীর্ষক শ্বেতপত্র প্রকাশ করে চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদের তথ্য-কার্যালয়। এতে দু'দেশের মধ্যে সংলাপের সর্বশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে 'চীন-মার্কিন আর্থ-বাণিজ্যিক সংলাপের বাস্তবতা ও চীনের অবস্থান' শীর্ষক শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল বেইজিং।

এবারের শ্বেতপত্রে প্রায় ৮৩০০টি অক্ষর আছে। ভুমিকা ও সারাংশ ছাড়া মোট তিনটি অধ্যায় রয়েছে এতে। তিনটি অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছে: যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্ট চীন-মার্কিন বাণিজ্য-সংঘাত দ্বিপাক্ষিক ও বৈশ্বিক স্বার্থ লঙ্ঘন করেছে; চীন-মার্কিন আর্থ-বাণিজ্যিক সংলাপ নিয়ে মার্কিন মিথ্যাচার; চীন বরাবরই পারস্পরিক সম্মান, কল্যাণ ও আন্তরিকতার ভিত্তিতে সংলাপ চালিয়ে যেতে চায়।

শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, চীন-মার্কিন আর্থ-বাণিজ্যিক সম্পর্ক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তি ও চালিকাশক্তি, যা দু'দেশের জনগণের স্বার্থ ও বিশ্বের সমৃদ্ধি আর স্থিতিশীলতার সাথে জড়িত।

শ্বেতপত্রে বলা হয়, ২০১৭ সালে মার্কিন নতুন সরকার শপথগ্রহণের পর শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন হুমকি নিয়ে বাণিজ্যিক অংশীদারদের সাথে সংঘাতের সূত্রপাত ঘটনায়। ২০১৮ সালের মার্চ থেকে মার্কিন সরকারের সৃষ্ট চীন-মার্কিন আর্থ-বাণিজ্যিক সংঘাতের মোকাবিলায় চীন কার্যকর ব্যবস্থা নেয় এবং দেশ ও জনগণের স্বার্থ দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে। পাশাপাশি, সংলাপের মাধ্যমে মতভেদ দূর করার চেষ্টাও করে বেইজিং। এর অংশ হিসেবে, দ্বিপাক্ষিক আর্থ-বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থিতিশীল করতে চীন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কয়েক দফায় সংলাপে বসে।

শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, চীনের রফতানিপণ্যের ওপর আরও শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে ওয়াশিংটন, যা দ্বিপাক্ষিক আর্থ-বাণিজ্যিক সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর। চীন নিজের যুক্তিযুক্ত স্বার্থ রক্ষায় যথাযথ প্রতিক্রিয়া দেখাবে।

শ্বেতপত্রে জোর দিয়ে বলা হয়, চীনের অবস্থান বরাবরই স্পষ্ট। চীন-মার্কিন সহযোগিতা দু'দেশের জন্যই কল্যাণকর; আর অসহযোগিতা দু'দেশের জন্যই ক্ষতিকর। পারস্পরিক সহযোগিতা দু'দেশের জন্য একমাত্র সঠিক সিদ্ধান্ত। দু'দেশের মধ্যে আর্থ-বাণিজ্যিক ইস্যুতে যে-মতভেদ আছে, তা সহযোগিতার ভিত্তিতে দূর করতে ইচ্ছুক বেইজিং। তবে সহযোগিতার গ্রহণযোগ্য নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে চীন কোনো ছাড় দেবে না। চীন বাণিজ্যযুদ্ধ চায় না; আবার একে ভয়ও পায় না। বাণিজ্যযুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হলে, চীন সর্বশক্তি নিয়োগ করেই যুদ্ধ করবে।

২. যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য-সংঘাত যে-দিকেই মোড় নিক না কেন, চীন বিদেশিদের জন্য নিজেকে আরও উন্মুক্ত ও অভ্যন্তরীণ সংস্কার গভীরতর করবে। চীন তার নিজের কাজ ভালভাবে সম্পন্ন করবে ও একটি সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ে তুলতে অবদান রেখে যাবে। সম্প্রতি বেইজিং থেকে প্রকাশিত শ্বেতপত্রে এ কথা বলা হয়েছে।

শ্বেতপত্রে বলা হয়, বাণিজ্য-সংঘাতের কুফল কাটিয়ে উঠতে, সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের মাধ্যমে নিজের উন্নয়নসাধনকেই মূল পদ্ধতি বিবেচনা করে চীন। এ লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও ধারাবাহিক পদক্ষেপ নেবে বেইজিং।

শ্বেতপত্রে আরও বলা হয়, বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের জন্য আরও অভ্যন্তরীণ খাত উন্মুক্ত করা হবে; মেধাস্বত্ব সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করা হবে; পণ্য ও সেবা আমদানি বাড়িয়ে দেওয়া হবে; এবং উন্মুক্তকরণের নীতি বাস্তবায়নের ওপর আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে।

৩. চীনা রফতানিপণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও ক্ষতিকর প্রমাণিত হচ্ছে। বেইজিং থেকে চীন-মার্কিন বাণিজ্যিক সংলাপের ওপর প্রকাশিত শ্বেতপত্রে এ কথা বলা হয়েছে।

এতে বলা হয়, অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ফলে মার্কিন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উত্পাদন-ব্যয় বাড়বে, অভ্যন্তরীণ পণ্যের দাম বাড়বে, মার্কিন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জীবিকার উন্নয়নের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

শ্বেতপত্রে মার্কিন চেম্বার অব কমার্সের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র সকল চীনা রফতানিপণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করলে, আগামী ১০ বছরে মার্কিন জিডিপি এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার কমে যাবে।

৪. যুক্তরাষ্ট্র চীনা রফতানিপণ্যের ওপর একতরফাভাবে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করায় দু'দেশের মধ্যে বাণিজ্য কমে গেছে। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে চীনা রফতানি টানা ৫ মাস ধরেছে কমেছে এবং চীনে মার্কিন রফতানি টানা ৮ মাস ধরে কমেছে।

বাণিজ্য-সংঘাতের ফলে দু'দেশেই কোম্পানি পর্যায়ের বিনিয়োগ কমেছে। এই প্রেক্ষাপটে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ২০১৯ সালে বৈশ্বিক বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধির হার ২.৬ শতাংশ হতে পারে বলে জানিয়েছে। অথচ সংস্থার পূর্বানুমান ছিল ৩.৭ শতাংশ।

৫. চীনের উপ-বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং শৌ ওয়েন বলেছেন, 'বিরল মাটি' (Rare earth)-এর ক্ষেত্রে বিশ্বে সবচেয়ে সমৃদ্ধ তার দেশ। বিশ্বে এই মাটির যে-চাহিদা রয়েছে, তা মেটাতেও চীনের কোনো আপত্তি নেই। তবে, একদিকে চীনের কাছ থেকে 'বিরল মাটি' নেওয়া হবে, এবং অন্যদিকে, চীনের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করা হবে—এটা চলতে পারে না। তিনি সম্প্রতি বেইজিংয়ে বিরল মাটির রফতানি প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে এ সব কথা বলেন।

৬. চীন-মার্কিন বাণিজ্যের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ক্ষতি হয় এবং দেশটির উত্পাদনশিল্পের কয়েক মিলিয়ন কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়—এমন ধারণা ভিত্তিহীন। চীনের অর্থনীতিবিদরা সম্প্রতি বলেন, চীন-মার্কিন বাণিজ্যে উভয়ের লাভ। রফতানিপণ্যের ওপর পাল্টাপাল্টি অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ বরং উভয়ের জন্য ক্ষতিকর।

গেল ৪০ বছরে চীন-মার্কিন বাণিজ্যের আকার ২৩০ গুণ বেড়েছে। বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় উন্নয়ন গবেষণালয়ের প্রধান লিন ই ফু এক ফোরামে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে পণ্য ক্রয় করে চীনকে কোনো অতিরিক্ত সুবিধা দিচ্ছে না, এতে উভয়েরই লাভ। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে যে পণ্য ক্রয় করে তা নিজে উাত্পাদন করে না। চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্যের দাম কম এবং গুণগত মান তুলনামূলকভাবে ভাল। উদাহরণস্বরূপ, পোশাক ও চামড়ার জুতা যুক্তরাষ্ট্র নিজেও উত্পাদন করতে পারে, তবে তার উত্পাদনব্যয় বেশি। এমন পরিস্থিতিতে, চীন থেকে পণ্য আমদানি করে দেশটি। এটা বাণিজ্যের মৌলিক নীতি এবং সাধারণ ও সহজ বিষয়।

আসলে, দু'দেশের বাণিজ্য থেকে বেশ লাভ করে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন-চীন বাণিজ্য জাতীয় কমিটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দু'দেশের বাণিজ্য থেকে প্রত্যেক মার্কিন পরিবার প্রতিবছর গড়ে ৮৫০ ডলার সাশ্রয় করতে পারে, যা তাদের পারিবারিক আয়ের ১.৫ শতাংশ। দু'দেশের বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি ও চীনের লাভ—বিষয়টা তা নয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতির উন্নয়নের ভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দু'দেশের ভূমিকাও ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্র শিল্প চেনের উজানে থেকে অধিকাংশ মুনাফা অর্জন করে।

ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চীন-মার্কিন সম্পর্ক গবেষণালয়ের ঊর্ধ্বতন গবেষক চৌ সি চিয়ান মনে করেন, দু'দেশের বাণিজ্যের বিপুল ঘাটতি দু'দেশের বাস্তব অবস্থার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, চীনের রফতানিকৃত পণ্যের দাম কম এবং গুণগত মান ভাল। বিশেষ করে দৈনন্দিন ভোগ্যপণ্যের জন্য চীনের ওপর বেশ নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের ৮৬ শতাংশ খেলনা, ৬০ শতাংশ জুতা ও লটবহর, ৪৪ শতাংশ আসবাবপত্র, ৩৭ শতাংশ টেক্সটাইল ও পোশাক, ২১ শতাংশ যান্ত্রিক এবং বৈদ্যুতিক পণ্য, ৪০ শতাংশ ডিজিটাল ক্যামেরা ও ৯৪ শতাংশ ল্যাপটপ চীন থেকে আমদানি করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, চীনের কারণে বিপুল ঘাটতি সৃষ্টি হয়, তা নয়। অত্যধিক খরচ, অপর্যাপ্ত সঞ্চয়, বিশাল আর্থিক ঘাটতি এর মূল কারণ। লিন ই ফু বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে, চীন, কানাডা, ইউরোপ ও জাপানসহ নানা দেশ ও অঞ্চলের রফতানিপণ্যৈর ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে ঘাটতি সমস্যার সমাধান করতে পারবে না যুক্তরাষ্ট্র। এতে বরং মার্কিন জনগণকে বড় মূল্য দিতে হবে।

তিনি বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করলেও, ২০১৮ সালে মার্কিন বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি ১২.১ শতাংশ বেড়েছে এবং চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি ১১.৭ শতাংশ বেড়েছে। সমস্যার সমাধান হয়নি, অথচ বাণিজ্যিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। এখন মার্কিন সাধারণ পরিবারগুলোকে আমদানিকৃত পণ্য কিনতে আগের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়। যদি দেশীয় পণ্য ও সেবা কেনে, তাহলে দেশীয় পণ্যের উত্পাদনব্যয় বেশি হওয়ায় দাম বেশি হবে।

৭. বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা ও বাণিজ্য সম্পর্কের পূর্ণ সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে জাপানের ব্যবসায়ীদের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সম্প্রতি টোকিওর একটি হোটেলে বাংলাদেশ-জাপান বিজনেস ফোরামের (বিজেবিএফ) বৈঠকে তিনি দুই দেশের মধ্যকার সুসম্পর্ক কাজে লাগিয়ে বাণিজ্য সম্পর্ককে উচ্চতর পর্যায়ে নেওয়ার আহ্বান জানান।

একইসঙ্গে জাপানের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের নতুন নতুন খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। জাপানের ব্যবসায়ীরা শেখ হাসিনার নেতত্বে বাংলাদেশের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য প্রবৃদ্ধির উচ্চ প্রশংসা করেন এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণে নেওয়া বিভিন্ন নীতির প্রশংসা করেন।

(আলিমুল হক)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040