চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের পাশাপাশি চীনের হুয়াওয়েই কোম্পানির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও অভিযোগ বিশেষভাবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। হুয়াওয়েই চীনের বেসরকারি টেলিকম অপারেটর কোম্পানি। এ খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন যন্ত্রাংশও তৈরি করে কোম্পানিটি। হঠাৎ করে কোম্পানিটির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণ কী? আর এর মধ্যে দিয়ে মার্কিন চরিত্রের যে বিশেষ দিকটি আবারও ফুটে উঠল- সে সম্পর্কেই থাকছে আজকের সংবাদ পর্যালোচনায়।
চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দেখা যায়, দেশের জনগণ চীনা কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞায় বেশ খেপেছেন। তারা মার্কিন অ্যাপল কোম্পানির আইফোন ভাংচুর করছেন, এমনকি কোথাও আইফোনের পরিবর্তে হুয়াওয়েই ব্যবহারের জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। বলা বাহুল্য এসব চীনাদের দেশপ্রেমেরই বহিঃপ্রকাশের প্রতীক। তবে বাস্তবতা হলো- এটা কোনো যুদ্ধ নয়। শীতলযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বের দুই পরাশক্তির মনস্তাত্তিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের চিহ্নমাত্র। মার্কিন এ আচরণকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সারা বিশ্বে দেশটির একচেটিয়া আধিপত্যের বিপরীতে বহুমেরুর বিশ্ব গড়ে ওঠা, মার্কিন সাম্রাজ্যের পতনের ঘণ্টা বাজিয়ে চীনা জাতির জেগে ওঠার প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের একেবারে নগ্ন আগ্রাসন বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
হুয়াওয়েইয়ের চীনের সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি নয়; যদিও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এটি চীনের উত্থানের প্রতীক। হুয়াওয়েইয়ের বিরোধিতা বিশ্বপ্রভুত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদিনের সংগ্রামেরই নতুন অধ্যায় মাত্র। খ্যাতনামা ফোন ব্রান্ড হলেও হুয়াওয়ের শুধু স্মার্টফোন বানায় না; যোগাযোগপ্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরিতে হুয়াওয়েই বিশ্বসেরা। গত বছর অ্যাপলকে হারিয়ে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে চলে এসেছে কোম্পানিটি। শুধু হুয়াওয়েই নয়, চীনের জেডটিই কোম্পানির বিরুদ্ধেও নিরাপত্তা অজুহাতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র। চীনা কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা না করার জন্য নিজ দেশের কোম্পানিগুলোকে বলছে ট্রাম্প প্রশাসন। সরাসরি নাম না নিয়েই গত ১৫ মে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাহী আদেশে চীনের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রযুক্তি ব্যবসায় যুক্তরাষ্ট্রের অফিস-আদালতের প্রতি এক রকম নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এটাকে 'জরুরি অবস্থা'র সঙ্গে তুলনা করেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায় থেকে সতর্কতা ও অভিযোগ করা হয় যে, চীনের এসব কোম্পানি সবার অলক্ষ্যে মার্কিন নাগরিকদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি চালাচ্ছে! মনগড়া এসব অভিযোগের কোনো প্রমাণ আজ পর্যন্ত উত্থাপন করেনি দেশটি। এ যেন বাংলা প্রবাদ "ঠাকুর ঘরে কে রে? আমি কলা খাই না' কথাটিই মনে করিয়ে দেয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের অর্থনৈতিক উত্থান থামাতেই যে এসব পদক্ষেপ, সেটা গোপন নেই আর। যুক্তরাষ্ট্রের এরূপ প্রচারণার ফলে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড তাদের ফাইভজি নেটওয়ার্ককে হুয়াওয়েই ও জেডটিইমুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডিসেম্বরে কানাডায় হুয়াওয়েইর বড় এক কর্মকর্তার আটক হওয়াও যুক্তরাষ্ট্রের চীনবিরোধী বাণিজ্যযুদ্ধেরই পরোক্ষ বৈশ্বিক বহিঃপ্রকাশ ছিল।
আন্তর্জাতিক এক গবেষক বলেন, সোভিয়েত ইউনয়ন ভেঙে পড়ার ৩০ বছর পর এভাবেই নিজের এত দিনকার একচেটিয়া আধিপত্য রক্ষায় নতুন এক রেষারেষিতে নেমেছে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্র বহুকাল থেকে মুক্তবাণিজ্যের কথা বললেও নিজের ক্রেতাদের পছন্দের স্বাধীনতাই সর্বাগ্রে হরণ করেছে। ব্যবসায়ে প্রতিযোগিতার ধারণারও বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে দেশটির বর্তমান নেতৃত্ব।
এ পরিস্থিতিতে চীন এখনও আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে আছে। চীন এ যুদ্ধ শুরু করেনি এবং এ যুদ্ধে কোনো রসদ সরবরাহ করতেও চায় না চীন। চীন অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ও ইউরোপের বাজার রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর। চীন মনে করে, উত্তেজনা না ছড়িয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করা যায়। চীন বরাবরই সে প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছে। তারপরও মার্কিন একতরফা আগ্রাসনের জবাবে চীন শান্তিপূর্ণ, আত্ম-স্বার্থ ও বিশ্ব স্বার্থরক্ষাকারী পথ অবলম্বন করবে- এমনটাই প্রত্যাশা করছে সবাই।
তৌহিদ/সিআরআই