স্বপ্ন থাকলে পঙ্গুত্ব মানুষকে আটকে রাখতে পারে না: সিয়ে ইয়ান থিং
  2019-05-08 13:10:35  cri

সিয়ে ইয়ান থিং। কানসু প্রদেশের রাজধানী লানচৌ শহরের একজন নাগরিক। তবে সাধারণ মানুষের চেয়ে তিনি একটু ভিন্ন। উনি একজন সেরিব্রাল পালসি রোগী। এর মানে তিনি তাঁর শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্বাধীনভাবে কাজে লাগাতে পারেন না। তবে তিনি নিজের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে একটি আঙ্গুল দিয়ে কোম্পিউটারে গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করেন এবং তা প্রকাশ করেন। অডিটর হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কোর্স শেষ করেন এবং স্নাতক গবেষণা গ্রুপে যোগ দেন। এমনকি পিএইচডি'র জন্যও ভর্তি হন।

১৯৯২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। নির্দিষ্ট সময়ের ৫০ দিনি আগে জন্মগ্রহণ করেন সিয়ে ইয়ান থিং। ১১ মাস বয়সে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ডাক্তার তার বাবা-মাকে জানান, তাদের ছেলে একজন সেরিব্রাল পালসি রোগী। সিয়ের মা লিও সিয়াও ফেং বলেন, ছেলেকে নিয়ে প্রায় সব বড় হাসপাতালে গিয়েছেন তারা, কিন্তু কোনো উন্নতি হয়নি। ৬ বছর বয়সে সিয়ে ইয়ান থিং হাঁটতে শেখে।

শুরুর দিকে কোনো স্কুল সিয়ে ইয়ান থিংকে গ্রহণ করতে রাজি হচ্ছিল না। সিয়ের দাদা গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের একজন বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক। তাই তার পরিবার শিক্ষার গুরুত্ব বোঝে। সিয়ের বাবা-মা নিজেরাই তাকে শিক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তারা বই কেনেন এবং ইন্টারনেট ক্লাসরুমে ছেলের নাম রেজিস্ট্রেশান করান। লিউ সিয়াও ফেং আবিষ্কার করেন যে ছেলে ইন্টারনেটে যখন লেখাপড়া করে তখন সাধারণ মানুষের মতো বুঝতে পারে।

২০১১ সালে সিয়ে ইয়ান থিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন। তিনি কলম দিয়ে লিখতে পারতেন না বলে শুধু মাল্টিপল চয়েস কোয়েশ্চেনগুলোর উত্তর দেন; ২৮০-এর মধ্যে স্কোর করেন ২৬২। অংকে শতভাগ উত্তর ঠিক হয়। কিন্তু রচনামূলক প্রশ্নগুলোর উত্তর না-দিতে পারায় মাত্র ২৬২ স্কোর নিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ব্যর্থ হন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হতে না-পেরে সিয়ে হতাশ হননি। তিনি ভাবলেন, মহান পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং পুরো অচল শরীর নিয়েও গবেষণা করেছে। তিনি কেন পারবেন না? তার অবস্থা তো হকিংয়ের চেয়ে ভালো!

তিনি মাকে বলেন, তিনি লান চৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে যেতে চান। তবে তার মা চিন্তা করেন পদার্থবিদ্যা শিখলে অনেক পরীক্ষা দিতে হবে, অনেক কাজ করতে হবে, তাঁর ছেলের শরীর যার জন্য উপযুক্ত নয়। মা ও ছেলে আলোচনা করে গণিতের ব্যাপরে একমত হন। ছেলের স্বপ্ন পূরণে মা লান চৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ও পরিসংখ্যান একাডেমির প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা সিয়ের গল্প শুনে খুব অভিভূত হন। তারা তাকে একজন অডিটর হিসেবে ক্লাশে উপস্থিত থাকার জন্য পারমিশান দেন।

২০১১ সালের সেম্টেম্বর মাস থেকে, লান চৌ বিশ্ববিদ্যলয়ের ক্লাসরুমে বিশেষ একজন ছাত্র হাজির হয়। অধ্যাপক সু সো জুন তার এ বিশেষ ছাত্রকে আবিষ্কার করেন এবং তার অবস্থা জানার পর তাকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন। সিয়ে কলম দিয়ে লিখে নোট নিতে পারে না। তাই অধ্যাপক সু আস্তে আস্তে কথা বলেন। ক্লাসের ফাঁকে তিনিও সিয়ের সঙ্গে কথা বলেন। সিয়ে স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারেন না, তাই অধ্যাপক কখনও কখনও কথা বলার সময় ইশারা ভাষার সাহায্য নেন। ধাপে ধাপে শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে বিশেষ একটি যোগাযোগ-পদ্ধতি তৈরি হয়ে যায়।

একবার সিয়ে একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নিজে অনেক তথ্য সংগ্রহ করে এবং এ নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চালায়। অধ্যাপক সু তাকে উত্সাহ দেন এবং দু'জন একসাথে আলোচনা করেন। পরে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পান তারা। সিয়ে একটি আঙ্গুল দিয়ে গবেষণার ফলাফল নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করে এবং অধ্যাপক তার প্রবন্ধ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।

২০১৫ সালের জুন মাসে, সিয়ে সব কোর্স শেষ করেন। অন্য ছাত্রছাত্রীর মতো সনদ না-পেলেও সিয়ের একটি স্বপ্ন পূরণ হয়। তিনি শিক্ষকের কাছে আরও লেখাপড়া করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। অধ্যাপক সু'র অনুমোদনে তিনি স্নাতক ছাত্রদের একটি গবেষণা গ্রুপে যোগ দেন।

পরে তিন বছর তিনি অন্য স্নাতক ছাত্রের সঙ্গে গবেষণা করেন। গ্রুপের অনানুষ্ঠানিক সদস্য হলেও সিয়ে নিয়মিতভাবে সপ্তাহে দু'বার গ্রুপ মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন এবং অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করেন, নিজের ধারণা প্রকাশ করেন।

২০১৮ সালের জুলাই মাসে, সিয়ে অন্য স্নাতক ছাত্রের মতো স্নাতক সাক্ষাত্কারে অংশগ্রহণ করেন। তিনি স্নাতক কমিটির শিক্ষকদের সামনে নিজের গবেষণা-প্রবন্ধ তুলে ধরেন এবং তাদের স্বীকৃতি পান।

সিয়ে ইয়ান থিং লেখাপড়ার যাত্রা শেষ হয়নি। তিনি পিএইচডি কোর্স শেষ করতে চাইলেন। ২০১৬ সালে অধ্যাপক সু তাকে নিয়ে সপ্তম জাতীয় সম্মিলিত গণিত এবং গ্রাফ তত্ত্ব সম্মেলনে অংশ নেন। ২০১৭ সালে তার একটি প্রবন্ধ অস্ট্রেলিয়ান একাডেমিক জার্নালে প্রকাশিত হয়। ২০১৮ সালে তিনি হ্য ফেই শহরে অনুষ্ঠিত একটি একাডেমিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। অধ্যাপক সু মনে করেন, সিয়ে এখন পিএইচডি গবেষণার প্রথম বছরের পর্যায়ে পৌঁছেছেন।

অধ্যাপক সু বলেন, সিয়ে ইয়ান থিংকে শিক্ষা দেওয়া অর্থবহ একটি কাজ।

স্বপ্ন থাকলে জীবনে কোনোকিছুই অসম্ভব নয়। সিয়ে ইয়ান থিং বলেন, তিনি স্টিফেন হকিংয়ের মতো একজন গবেষক হতে চান; গবেষণার মাধ্যমে সমাজে নিজের অবদান রাখতে চান। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040