0426adda
|
সুপ্রিয় শ্রোতা আমি ইয়াং ওয়েই মিং স্বর্ণা। সাপ্তাহিক 'কফিহাউসের আড্ডা' অনুষ্ঠানে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। এ সপ্তাহে আড্ডার বিষয় হচ্ছে: চীনের 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগ 'ঋণের ফাঁদ' নয় বরং সহযোগিতার নয়া দিগন্ত। আজকের অনুষ্ঠানে আমার সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন ডঃ মোস্তাক আহমেদ গালিব। তিনি বর্তমানে উহান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক দায়িত্বে কাজ করছেন।
দ্বিতীয় 'এক অঞ্চল, এক পথ' শীর্ষ ফোরাম গত ২৫ তারিখে শুরু হয়। তিনদিনব্যাপী ফোরামে বিভিন্ন দেমের শীর্ষনেতা ও প্রতিনিধিরা 'এক অঞ্চল, এক পথ' নির্মাণের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মত বিনিময় করার কথা। 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগ উত্থাপিত ছয় বছরে ইতোমধ্যে প্রাথমিক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। চীন ইতোমধ্যে 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগের আওতায় ১২৫টি দেশ ও ২৯টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে ১৭৩টি সহযোগিতামুলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চীনের সঙ্গে ২০টিরও বেশি দেশের দ্বিপাক্ষিক স্থানীয় মুদ্রা বিনিময়ের ব্যবস্থা এবং ৭টি দেশের সঙ্গে রেনমিনপি দিয়ে হিসাব করার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তা ছাড়া, চীন ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল যৌথকেন্দ্র স্থাপন করেছে। (স্বর্ণা/আলিম/মুক্তা)
নিচে ড. মোস্তাক আহমেদ গালিবের সাক্ষত্কারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ তুলে ধরা হলো-
২০১৩ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রথমবারের মতো 'one belt one road' বা "এক অঞ্চল এক পথ" প্রস্তাবনা উত্থাপন করেন। "এক অঞ্চল এক পথ" চীন, মধ্য এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া, এবং দক্ষিণও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে ইউরোপ ও আফ্রিকার সঙ্গে যুক্ত করার জন্য রেলওয়ে, রাস্তা, পাইপলাইন, এবং ইউটিলিটি গ্রিড এর সমন্বয়ে তৈরি একটি আধুনিক এবং অনন্য যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব। প্রকল্পের দুটি অংশ রয়েছে – সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট (এসআরইবি)এবং সমুদ্রপথে একুশ শতকের মেরিটাইম সিল্ক রোড (এমএসআর)।সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট চীন, মধ্য এশিয়া, রাশিয়া ও ইউরোপ (বাল্টিক অঞ্চল) এর মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে জোর দেয়।মেরিটাইম সিল্ক রোড হলো পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকার যোগসূত্র । "এক অঞ্চল এক পথ" কৌশলপত্র আপাত দৃষ্টিতে বাণিজ্য সংযোগ হলেও এর পেছনে রয়েছে প্রথম ধাপে অবকাঠামো উন্নয়ন ও দ্বিতীয় ধাপে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিসহ বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগীতার প্ল্যাটফর্ম তৈরির একটি মহান লক্ষ্য।
১২৫ টি দেশ, ২৯ টি আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং এখন পর্যন্ত স্বাক্ষরিত ১৭৩ টি সহযোগিতার স্মারক নিয়ে এই মহাপরিকল্পনা। প্রথম ধাপে "এক অঞ্চল এক পথ" কৌশলপত্র দৃশ্যত যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অঞ্চল ও করিডোর প্রতিষ্ঠার প্রকল্প। পরবর্তীতে এই যোগাযোগের পথ ধরে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতার মাধ্যমে লেনদেন বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে । একারনেই এই মহাপরিকল্পনার 'কি ওয়ার্ড' হিসাবে বেছে নেয়া হয়েছে 'কানেকটিভিটি' শব্দটিকে । মূল পরিকল্পনায় থাকছে এসব এলাকাজুড়ে বিস্তৃত থাকা সমুদ্রবন্দর, আন্তঃসীমান্ত সড়ক, উচ্চগতির রেলপথ, বিমানবন্দর এবং অবকাঠামোর নির্মাণ ও আধুনিকায়ন।
"এক অঞ্চল এক পথ" কৌশলপত্রের আওতায় গত ছয় বছরে প্রধানত অবকাঠামো খাতে, নির্মাণ সামগ্রী, রেলপথ এবং হাইওয়ে, অটোমোবাইল, রিয়েল এস্টেট, বিদ্যুৎ,জ্বালানী এবং লোহা ও ইস্পাতশিল্পে চীন বেশ বড় অংকের বিনিয়োগ করেছে।চীনের নেয়া এই সুবিশাল উদ্যোগের জন্য ৪০ বিলিয়ন ডলারের সিল্ক রোড ফান্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং এটি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে বিনিয়োগও করেছে। এই প্রকল্পের শুরু হওয়া মাত্রই "এক অঞ্চল এক পথ" আরও বিস্তারিত এবং ব্যাপক উন্নয়নের একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে। এর ফলে ইউরেশীয় স্থল সংযোগ, চীন-মঙ্গোলিয়া- রাশিয়া, চীন-মধ্য এশিয়া-পশ্চিমাঞ্চল, চীন-পাকিস্তান এবং ভারত-বাংলাদেশ-চীন-মায়ানমার সহ ছয়টি প্রধান অর্থনৈতিক করিডোরের উন্নয়ন গতি লাভ করে । এই অঞ্চলগুলো ভবিষ্যতে শিল্পকেন্দ্রের স্থান হয়ে উঠতে চলেছে এবং নতুন নতুন রেল, রাস্তা, জলপথ, বায়ুপথ, পাইপলাইন এবং আন্তঃদেশীয় মহাসড়ক ব্যবহার করে তাদের বাণিজ্য সক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে পারবে।
শুরুতে এই মহাপরিকল্পনা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান থাকলেও চীনা নেতৃত্বের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মাত্র ছয় বছরে এই কৌশলপত্রের দ্রুত প্রাথমিক সাফল্যে লাভের পর কেউ কেউ এর দিকে এখন বাঁকা চোখেও তাকাচ্ছেন । তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন চীন এই প্রকল্প দিয়ে অন্যান্য দেশগুলোর উপকার করতে চাইছে, নাকি গলায় পরাতে চাইছে ফাঁস? নিন্দুকেরা বলছেন, ঋণের ফাঁদে ফেলে সংশ্লিষ্ট এলাকার আঞ্চলিক রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে চীন।গার্ডিয়ান পত্রিকা জানাচ্ছে,"এক অঞ্চল এক পথ" প্রকল্পে ব্যয় হতে পারে প্রায় এক লাখ কোটি ডলার। এরই মধ্যে ২১ হাজার কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করে ফেলেছে চীন। আর এই প্রকল্পের কাজগুলো একচেটিয়াভাবে করছে চীনা নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোই। তাঁরা মনে করছেন নানা দেশের সঙ্গে করা এসব ঋণ চুক্তির ফলে লাভবান হচ্ছে চীন। এখন কথা হলো এই যে "ঋণের ফাঁদ" বলা হচ্ছে "এক অঞ্চল এক পথ" কৌশলপত্র আসলেই কি তাই ? সুপ্রিয় পাঠক চলুন তাহলে খতিয়ে দেখা যাক বিষয়টি।
আমরা শুরুতেই বলেছি "এক অঞ্চল এক পথ" কৌশলপত্রের মূল উদ্দেশ্য হলো কানেকটিভিটি বা মানুষে মানুষে যোগাযোগ বৃদ্ধি (মহাপরিকল্পনার প্রথম ধাপ), পরবর্তীতে এই যোগাযোগের পথ ধরেই সাধিত হবে আর্থসামাজিক উন্নয়ন (মহাপরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপ) । এখন এই যোগাযোগের প্রকল্পগুলোই "এক অঞ্চল এক পথ" কৌশলপত্রের মূল প্রাথমিক প্রকল্প। প্রাথমিক ধাপে এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে পরবর্তী ধাপ অর্থাৎ যোগাযোগের পথ ধরে সাধিত হওয়া আর্থসামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। তারমানে দাঁড়াচ্ছে আসলে এখানে যারা "এক অঞ্চল এক পথ" কৌশলপত্রের দিকে আঙ্গুল তুলে দিচ্ছেন তাঁরা আসলে তাড়াহুড়া করে মহাপরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপটিকে আমলে না নিয়েই একটা সাময়িক সিদ্ধান্তে আসতে চাইছেন অথচ আমরা মোটামুটি সকলেই জানি যে একটি যোগাযোগ প্রকল্পকে পর্যাপ্ত সময় না দিয়ে এর ভালো বা খারাপ যাচাই করা বেশ কঠিন এবং অনেকক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভবও।
প্রথমেই আসা যাক ঋণ বিষয়ে ।আমরা আসলে ঋণ বলতে যা বোঝাই সেটি একধরনের project assistance বা প্রকল্প সাহায্য। উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলো মোটাদাগে দুই ধরনের প্রকল্প সাহায্য নিয়ে থাকে। এর একটি হলো "ট্যাকনিক্যাল" বা কারিগরি সাহায্য এবং অন্যটি হলো "ফাইনান্সিয়াল" বা আর্থিক সাহায্য। প্রথমেই আসা "ট্যাকনিক্যাল" বা কারিগরি সাহায্যর বিষয়টিতে।উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলো অনেকক্ষেত্রেই বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে কারিগরি অভিজ্ঞতার অভাবে ভোগে। চীন একটি বৃহৎ উন্নয়নশীল দেশ হলেও EPC(Engineering, Procurement, Construction)Contracting প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশ পটু। চীনের এসব EPC কোম্পানিগুলো একাজে পৃথিবীর অন্য যে কোনও দেশের কোম্পানির চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ENR's 2018 Top 250 Global Contractors লিস্টে প্রথম দশটি কোম্পানির সাতটিই চীনের। তারমানে বোঝাই যাচ্ছে যে "ট্যাকনিক্যাল" বা কারিগরি দিক থেকে চীনের চেয়ে ভালো অপশন অন্তত এ মুহূর্তে নেই । অতএব চীনা কোম্পানিগুলোর একচেটিয়াভাবে EPC Contracting এর কাজ পাবার অভিযোগটি বেশ দুর্বল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে চীনা EPC Contractor রা সাধারণত স্থানীয় Sub Contractor কে নিয়েই কাজটি করে থাকে (যদি থাকে) এক্ষেত্রে এটি স্থানীয় পর্যায়ের কোম্পানিগুলোর জন্য অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির একটি সুবর্ণ সুযোগ। অভিজ্ঞতা বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে এসব স্থানীয় Sub Contractorরা মূল EPC Contractor এর দায়িত্ব নিতে সক্ষম হয়ে উঠবে ।
এরপর আসা যাক "ফাইনান্সিয়াল" বা আর্থিক সাহায্যর বিষয়টিতে । প্রকল্পের আর্থিক সাহায্য যে কেবলমাত্র ঋণই তা কিন্ত নয় । আসলে আর্থিক সাহায্য কে বেশকটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা ;অনুদান বা গ্রান্ট, সহজ শর্তের ঋণ বা সফট লোন ,বাণিজ্যিক ঋণ বা হার্ড লোন এবং মিক্সড লোন। অনুদান বা গ্রান্টের ক্ষেত্রে ঋণের সুদের হার হয়না , কিন্ত অন্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঋণের একটি নির্দিষ্ট মাত্রার সুদ ও পরিশোধের সময় (গ্রেস পিরিয়ড সহ ;গ্রেস পিরিয়ড হলো নির্মাণ সময়ের সুদ না নেয়ার একটি প্রথা) ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতা দেশ আলোচনা করে ঠিক করে নেয়। বলে রাখা ভালো উভয় দেশের সন্মতি ছাড়া সুদের হার ও পরিশোধের সময় কিছুই ঠিক হতে পারে না। আবার মিক্সড লোনের ক্ষেত্রে তৃতীয় কোনও দাতা সংস্থা বা দেশও এই আলোচনায় শরিক হতে বাধ্য। মোদ্দা কথা ঋণদাতা এক্ষেত্রে ঋণের ধরন, সুদের হার ও পরিশোধের সময় কোনটিই একা ঠিক করতে পারে না এবং ঋণগ্রহীতা সকল শর্ত জেনে বুঝেই চুক্তি স্বাক্ষর করে থাকেন বিধায় এখানে কাউকে ঠকিয়ে "ঋণের ফাঁদে" ফেলার কোনও সুযোগ নেই।
এবার আসা যাক ঋণ পরিশোধে অপারগতার ক্ষেত্রে কি "ঋণের ফাঁদ" আছে কিনা,সেই প্রসঙ্গে। কোনও দম্পতি যেমন তালাকের উদ্দেশ্য নিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননা তেমনি কোনও ঋণদাতাই চান না তাঁর ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধে অক্ষম হন। উভয়পক্ষই চেষ্টা করে প্রকল্পটি যথাসময়ে শেষ করে ঋণটিও যথা সময়ে আদায় করে নিতে, কেননা ঋণদাতার এই বিনিয়োগ আসলে একটি ঘূর্ণায়মান তহবিল । ঋণদাতা এই টাকা ফেরত পেয়ে আবার অন্য কোনও দেশে অন্য কোনও প্রকল্পে বিনিয়োগ করে থাকেন। এখন ঋণগ্রহীতা যথাসময়ে ঋণ পরিশোধে অপারগ হলে ঋণদাতার পরবর্তী বিনিয়োগ পরিকল্পনাটি ভেস্তে গিয়ে আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি হতে পারে। উভয়পক্ষের এসব দিক বিবেচনা করেই ঋণ পুনঃতফসিলিকরনের উদ্দেশ্যে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে Club de Paris বা প্যারিস ক্লাব নামে পশ্চিমা দাতা গোষ্ঠীর একটি সংগঠন থাকলেও গণচীন এখনও এর সদস্য নয় বিধায় চীনা ঋণের বিষয়ে চীন সরকার ঋণগ্রহিতা সরকারের সাথে সরাসরি আলোচনায় বসে "কেস বাই কেস" ভিত্তিতে একটি পারস্পরিক সমঝোতায় উপনীত হয়ে সমস্যাটির সমাধান করে থাকে। কেউ কেউ বলে থাকেন ঋণ পরিশোধে অপারগতার ক্ষেত্রে চীন তার "উপনিবেশিকতাবাদ" চাপিয়ে দেয়, এক্ষেত্রে তারা একটি বিশেষ বন্দরের উদাহরণ দিতে পছন্দ করেন । সত্যি বলতে কি , একবিংশ শতাব্দিতে জাতিসংঘের ছায়াতলে এই "উপনিবেশিকতাবাদ" চাপিয়ে দেয়ার কথাটি যে কেবল ভিত্তিহীন তাই নয় , কথাটি আন্তর্জাতিক শিষ্টাচারবোধেরও চরম লঙ্ঘন। আর যে বিশেষ বন্দরের উদাহরণটি এক্ষেত্রে দেয়া হয়ে থাকে সেটি একটি বেশ বড় প্রকল্প, ঋণগ্রহীতা দেশটি ঋণপরিশোধে নিজের অক্ষমতা টের পেয়ে প্রকল্পটি একটি সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য লিজ দিয়ে দেয়। এটি মোটেও কোনও "উপনিবেশিকতাবাদ" নয় বরং বিষয়টির সাথে প্রকল্প ব্যবস্থাপনার বহুল পরিচিত একটি টার্ম BOT (Build, Operate, Transfer)এর বেশ মিল রয়েছে । এ প্রকল্পটি শুরুতে সম্ভবত BT(Built, Transfer) ছিল ।এ প্রসঙ্গে আমি আরও উল্লেখ করতে চাই যে "এক অঞ্চল এক পথ" কৌশলপত্রের মূলনীতি যে পাঁচটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে সেগুলো হলো একে অন্যের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি সন্মান প্রদর্শন , পারস্পরিক অনাগ্রাসন, একে অন্যের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানো ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান । কাজেই এখানে "উপনিবেশিকতাবাদের" কোনও সুযোগই নেই।
যারা চীনের বিরুদ্ধে " ঋণের ফাঁদের" অভিযোগ আনেন ,তারা সুকৌশলে একটি বিষয় কিন্ত এড়িয়ে যান। আমি আগেই বলেছি চীনা ঋণ বলতে আমরা যা বুঝিয়ে থাকি তার সবটাই কিন্ত আসলে ঋণ নয়, এখানে কিছু অনুদান বা গ্রান্টও আছে। আমাদের মনে রাখা উচিৎ, চীন নিজেই একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র, তারপরও ঋণ গ্রহীতার বিশেষ অপারগতার ক্ষেত্রে চীন ঋণ অবলোপন করে থাকে। IMF এর debt relief Aid-Data database পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বিগত পনের বছরে চীন এরকম ৮৪ টি ক্ষেত্রে (ঋণ গ্রহীতার বিশেষ অপারগতার কারণে)ঋণ অবলোপন করেছে বা পুনঃতফসিল করে দিয়েছে । নিজে উন্নয়নশীল দেশ হয়েও এমন মানবিক উদ্যোগ কি চীনের সদিচ্ছা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয় ?
পরিশেষে প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয় চীনা ঋণ বা প্রকল্প সহায়তার বিপরীতে অন্যান্য যেসব বৃহদাকার বৈশ্বিক ঋণদাতা সংস্থা আছে তাদের কথা। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ পল ব্যারেন, ওয়াল্টার রডনি, রাউল প্রোবিস, গ্রাহাম হ্যানকক,পল সুইজি, এজি ফ্রাঙ্ক, ডঃ মোসাদ্দেগ, সামির আমিনরা মনে করেন এসব বৈশ্বিক ঋণদাতা সংস্থা মোটেও সমাজসেবা করে না, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তারা যে সাহায্য দিয়ে থাকে সেটা আসলে তাদের বিনিয়োগ।সুদ সহ তারা তাদের আসল ঠিকই একসময় বুঝে নেয়। এই বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদগনের লেখা পাঠ করলেই বোঝা যায় এসব দাতা সংস্থা ঋণ পরিশোধে আপারগ দেশগুলোকে কিভাবে পরবর্তীতে কঠিন শর্তের বেড়াজালে আটকে ফেলে বিভিন্ন আর্থসামাজিক পরিবর্তনে বাধ্য করে। এসব দেশের বিভিন্ন কেস হিস্ট্রি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় পশ্চিমা দাতারা ঋণ গ্রহিতা সরকার কে অনিচ্ছাস্বত্বেও বেশ কিছু কাঠামোগত পরিবর্তনে বাধ্য করে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় এসব কাঠামোগত পরিবর্তনে বেশ কিছু দেশের সরকারের পতন পর্যন্ত হয়ে গেছে, এর ভেতর বিশেষ ভাবে ইরানের মোসাদ্দেগ সরকার (১৯৫৩),গুয়াতেমালার আরবানেজ সরকার (১৯৫৪),ব্রাজিলের গাউলাট সরকার (১৯৬৪), ইন্দনেশিয়ার সুকর্ণ সরকার (১৯৬৫),ঘানার নক্রুমা সরকার (১৯৬৬),মালির কাইটা সরকার (১৯৬৮),চিলির আলেন্দে সরকার (১৯৭৩) এর নাম উল্লেখ না করলেই নয়। এবার দেখা যাক এই দাতাগোষ্ঠী সাধারনভাবে কি কি কাঠামোগত পরিবর্তনে ঋণগ্রহিতা দেশের সরকারকে বাধ্য করে থাকেঃ
ক। ঋণ গ্রহিতার জাতীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ।
এটি আসলে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। ডলারে ঋণ গ্রহিতা এম্নিই আর্থিক চাপে থাকে,এর ওপর যদি ডলারের বিপরীতে তার জাতীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ণে বাধ্য করা হয় তাহলে তার রপ্তানি কমে যাবে এবং আমদানি খরচ বেড়ে যাবে।
খ। সরকারি ব্যয় হ্রাসে বাধ্য করা।
সরকারি খরচ, ভর্তুকি ইত্যাদি তুলে দিয়ে শিক্ষা ,স্বাস্থ্য সহ অন্যান্য ব্যয় হ্রাসে ঋণগ্রহীতা দেশকে বাধ্য করা হয়। এর কুফলে সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার হয়ে সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। দেশে অরাজকতা বৃদ্ধি পায় ,মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগতে শুরু করে ।
গ। মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠা।
ঋণ গ্রহিতা দেশের সরকারের মূল্য নিয়ন্ত্রন ক্ষমতা কেটেছেঁটে দিয়ে মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়। একে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি তারওপর সরকারের মূল্য নিয়ন্ত্রন ক্ষমতা কমে যাবার ফলে জিনিসপত্রের দাম সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
ঘ। জনসেবা মূলক খাতের বেসরকারিকরণ।
প্রতিটি সরকারেরই কিছু না কিছু জনসেবামূলক খাত থাকে। ঋণ গ্রহিতাকে চাপ দিয়ে এই খাতগুলোকে বেসরকারিকরনে উদ্বুদ্ধ করা হলে খাতগুলো পুরোপুরি বাণিজ্যিক হয়ে যায়। সাধারন মানুষ তখন কমমূল্যে বা বিনামূল্যে সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়।
ঙ। কর ও সুদের হার বৃদ্ধিকরণ।
এ দুটো খাতের সাথে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কর ও সুদের হারের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে দেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্থ হয়ে উন্নয়ন মার খেয়ে যায়।
"এক অঞ্চল এক পথ" কৌশলপত্রের ঋণের ক্ষেত্রে চীন কিন্ত কোনও ঋণগ্রহীতা দেশকেই উপরে উল্লিখিত কোনওপ্রকার কাঠামোগত পরিবর্তনে বাধ্য করেনি। চীন উন্নয়নশীল দেশ হয়েও যে বিপুল ধৈর্য ,পেশাদারিত্ব ও প্রজ্ঞার সাথে ঋণগ্রহীতা দেশের ঋণ পরিশোধে অক্ষমতার সমস্যাটি মোকাবেলা করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে তা আসলেই একটি অনুকরণীয় মানবিক দৃষ্টান্ত । কাজেই আমরা বলতে পারি চীনের "এক অঞ্চল এক পথ" কৌশলপত্র মোটেই "ঋণের ফাঁদ" নয় বরং জয়-জয় (win-win)ভিত্তিতে পারস্পরিক সহযোগিতার এক নয়া দিগন্ত।