পাকিস্তানের গুয়াদার বন্দর ও অবাধ বাণিজ্য অঞ্চল যেভাবে মরুভূমি থেকে বাগান হলো
  2019-04-24 08:52:07  cri

পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের বড় একটি মরুভূমিতে দেখা যায় ছোট একটি মরুদ্বীপ। ওখানে বিখ্যাত গুয়াদার বন্দর অবস্থিত। এখানে নির্মিত হয়েছে ও হচ্ছে কারখানা, রাস্তা-ঘাট; লাগানো হয়েছে ও হচ্ছে ফুল ও ফলের গাছ। মরুভূমিতে এমন মরুদ্বীপ কীভাবে সৃষ্টি হলো? আজকের 'পুবের জানালা' অনুষ্ঠানে আমরা সিআরআই-এর সাংবাদিকের গুয়াদার থেকে পাঠানো একটি প্রতিবেদন থেকে বিস্তারিত জানব।

২০১৩ সালের কথা। তখন চায়না ওভারসিস পোর্টস হোল্ডিং কম্পানি সিঙ্গাপুরের একটি কম্পানির কাছ থেকে গুয়াদার বন্দরের ব্যবস্থাপনা-কাজের দায়িত্ব নেয়। তখন বন্দরের প্রাকৃতিক পরিবেশ বাইরের ওই মরুভূমির মতোই ছিল। বন্দরেও কিছু পুরাতন ভবন ছাড়া কিছুই ছিল না। গুয়াদার অবাধ বাণিজ্য এলাকা কোম্পানির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হু ইয়া জং এখনও ভুলতে পারেন না প্রথম দিন এখানে আসার স্মৃতি। তিনি বলেন, "করাচী থেকে গুয়াদারে এসেছিলাম বিমানে। বিমান থেকে নেমে বাইরের দৃশ্য দেখে তো আমি অবাক! আমাদের কেউ কেউ ঠাট্টা করে বললেন, মঙ্গল গ্রহে আসলাম নাকি! চারিদিকে শুধু মরুভূমি আর মরুভূমি।"

আগে অব্যবস্থাপনার কারণে গুয়াদার অবাধ বাণিজ্য অঞ্চলে গাছপালা তেমন একটা ছিল না। জোরে বাতাস বইলে গোটা অঞ্চলের আকাশ ধুলা-বালিতে একাকার হয়ে যেত। চীনা কোম্পানি এখানকার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমে গুয়াদার বন্দর-এলাকাকে 'সবুজ' করে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ, প্রাকৃতিক পরিবেশ ভাল না-হলে কোনো কোম্পানি এখানে বিনিয়োগ করতে চাইবে না। তা ছাড়া, পরিবেশ উন্নত হলে স্থানীয় মানুষও এর থেকে উপকৃত হবে। তাই বন্দর-ব্যবস্থাপনা, শিল্পপার্ক নির্মাণ এবং বিনিয়োগ আকর্ষণের বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি, বালি নিয়ন্ত্রণ কোম্পানির প্রথম কাজে পরিণত হয়। গুয়াদার অবাধ বাণিজ্য এলাকা কোম্পানির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হু ইয়া জং তাদের গাছ রোপনের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে বলেন, "প্রথমে আমরা প্রায়-মৃত গাছগুলোতে নতুন প্রাণশক্তি যোগানোর উদ্যোগ নিই। এ গাছগুলোর পাতা ছোট এবং রঙ সবুজ ছিল না। শুধু পানির উত্সের কাছাকাছি কয়েকটি গাছ ঠিকঠাকমতো বড় হতে পেরেছিল। তার মানে, এখানে গাছ ও মাঠ সব ঠিক আছে। শুধু পানির সমস্যা সমাধান হলে গাছগুলো বেঁচে থাকতে পারবে। আমি প্রকল্প-পরিচালকের সঙ্গে আলোচনা করি এবং একটি পাইপ-লাইন তৈরি করা হয়। পাইপের মাধ্যমে পানি প্রতিটি গাছের গোড়ায় নিয়ে আসা হয়।"

মৃত-প্রায় গাছগুলো সংরক্ষণ করার পাশাপশি তারা নানান পরীক্ষা শুরু করেন। চীন এবং পাকিস্তানের স্থানীয় নানান গাছ ও ফুলের বীজ নিয়ে বন্দর অঞ্চলে পরীক্ষা চালানো হয়। গুয়াদারের সব জমি স্যালাইন-আলকালিসমৃদ্ধ এবং এখানকার আবহাওয়া গরম। অঞ্চলটি খরাপ্রবণ। কোম্পানির লোকেরা গোবর-সার এবং ইউরিয়া দিয়ে জমিকে উর্বর করার চেষ্টা করেন। একটি মধ্যবর্তী পানি-পরিশোধন কারখানাও প্রতিষ্ঠা করা হয়। বন্দরের ভিতর ও বাইরে একটি জলসেচন-ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। তাদের প্রচেষ্টায় অবশেষে গুয়াদার বন্দর একটু একটু করে সবুজ হয়ে ওঠে।

মরুভূমির মধ্যে একটি মরুদ্বীপ তৈরি করা সহজ ব্যাপার নয়। সফলতা একবারে আসেনি। বার বার ব্যর্থতা এসেছে। তবে কোম্পানি কখনও চেষ্টা ছেড়ে দেয়নি। গুয়াদার বন্দরের বাগানের নকশাকার ও নির্মাতা হ্য নান ইউন লিন কোম্পানির কর্মী সি হাও বলেন, "শুরুতে তৃণাচ্ছাদিত ভূমি তৈরি করা খুব কষ্টকর একটি কাজ ছিল। আমরা আবহাওয়ার কথা বিবেচনায় নিয়ে রোদ প্রতিরোধক-জাল তৈরি করি এবং প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা সৃষ্টির ব্যবস্থা গ্রহণ করি। কিন্তু প্রথম দিকে আমাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। আমরা তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, এমন প্রাকৃতিক পরিবেশে তৃণাচ্ছাদিত ভূমি তৈরি করা অসম্ভব একটি কাজ। তবে, আমরা আশা ত্যাগ করিনি, প্রচেষ্টাও ছাড়িনি।"

চীনা মানুষের প্রচেষ্টা দেখে স্থানীয় মানুষও অভিভূত হয়। হু ইয়াও জং বলেন, চীনা কর্মীরা বন্দর-এলাকায় প্রায় ১০ হাজার চারা রোপণ করে। স্থানীয় কর্মীরাও দেখা-দেখি একটি ছোট একটি বাগান গড়ে তোলে। এক্ষেত্রে তারা চীনা কোম্পানির কর্মীদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। কয়েক ডজন পাকিস্তানি কর্মী খুব আগ্রহ নিয়ে ছোট বাগান গড়ে তোলার কাজে অংশগ্রহণ করে।

সি হাও বলেন, "হঠাৎ একদিন একজন পাকিস্তান কর্মী আমাকে একটি ফুল দেখিয়ে বলেন, 'এ ফুল গুয়াদারে অনেক বেশি ফোটে।' আমি তাদেরকে বলি, 'যখন গুয়াদার এলাকার কোথাও কোনো গাছ বা ফুল দেখবেন, ছবি তুলে আমাকে পাঠাবেন।' তাদের সাহায্যে আমরা বন্দর এলাকায় অ্যালোভেরা, ক্যাক্টাসসহ বিভিন্ন গাছ লাগিয়েছি।"

চীন ও পাকিস্তানের কর্মীদের যৌথ প্রচেষ্টায় এখন গুয়াদার বন্দর ও অবাধ বাণিজ্য অঞ্চলে সর্বত্র গাছ ও ফুল দেখা যায়। এখন অবাধ বাণিজ্য অঞ্চলের সামনে তৃণাচ্ছাদিত ভূমি আছে এবং প্রতিদিন দুপুরে স্থানীয় সৈনিক ও কর্মীরা এখানে এসে বিশ্রাম নেন। রোববার ও শনিবার স্থানীয় মানুষও এখানে এসে পিকনিক করে।

গুয়াদার বন্দর ব্যুরোর সাবেক প্রেসিডেন্ট দোস্তাইন খান জামালদিনি স্বচোখে দেখেছেন গুয়াদার বন্দর ও অবাধ বাণিজ্য অঞ্চলের পরিবর্তন। তিনি বলেন, গুয়াদার পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কেন্দ্রের বাইরে অবস্থিত। এখানে পানি, বিদ্যুত, জ্বালানি সবকিছুরই অভাব। এখানে কাজ করা বা বসবাস করা যে-কোনো মানুষের জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ। চীনা কোম্পানি এখানে অনেক কাজ করেছে এবং তাদের প্রচেষ্টায় গুয়াদার সুন্দর ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। গুয়াদার শহরও বন্দরের উন্নয়ন থেকে উপকৃত হয়েছে।

হু ইয়াও জং বলেন, 'সবুজ গুয়াদার'-এর ধারণা এখন সবার মনে প্রবেশ করেছে। গেল অক্টোবর মাসে কোম্পানি ১০ লাখ গাছ রোপন করার একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করে। এখন পাকিস্তানের অনেক কোম্পানি, ব্যাংক ও ব্যক্তি এ পরিকল্পনায় যোগ দিচ্ছে। তারা অর্থ দান করে, গাছ সরবরাহ করে এবং সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি সরবরাহ করে অংশগ্রহণ করছে। তা ছাড়া, চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও বৈজ্ঞানিক গবেষণালয়ের সহযোগিতায় গুয়াদারে ২ হাজার বর্গমিটার আয়তনের একটি উদ্ভিদ চাষকেন্দ্র তৈরি করা হবে। তখন গুয়াদার বন্দর ও অবাধ বাণিজ্য অঞ্চলের আরও বেশি এলাকা সবুজ হবে। (শিশির/আলিম)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040