নূসরাত জাহান রাফির মৃত্যু জাগিয়েছে বাংলাদেশের বিবেক
  2019-04-14 19:05:18  cri
ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আলীম পরীক্ষার্থী নূসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের বিবেক। অধ্যক্ষের যৌনহয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে মর্মন্তিকভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে রাফিকে। তার মৃত্যু কাঁদিয়েছে সারা দেশের মানুষকে। জীবন দিয়ে রাফি নারী নিপীড়ন তথা সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে আজ প্রতিবাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছে।

সোনাগাজীর ওই মাদ্রাসার কুখ্যাত অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার যৌন হয়রানির ঘটনায় অন্য অনেক মেয়ের মতো নীরবে মেনে নেয়নি রাফি। পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। মাদ্রাসা কমিটির কাছে বিচার না পেয়ে তার পরিবার গত মার্চে যৌনহয়রানির মামলা করে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় অভিযুক্ত অধ্যক্ষকে। যৌননিপীড়নের ঘটনা সাধারণত লোকলজ্জার ভয়ে চেপে যায় নির্যাতিতা ও তার পরিবার। কিন্তু রাফি ও তার পরিবার সাহসিকতার সঙ্গে ক্ষমতাশালী অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে প্রতিবাদ করেছে, মামলা দিয়েছে। কিন্তু এই সাহসের জন্য চরম মূল্য দিতে হলো রাফিকে।

মামলা করে সমাজে হেয় করা হয়েছে- এই ক্ষোভে ক্ষমতাদর্পী অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা তার অশুভচক্রের সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছে রাফিকে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিতে। ওই চক্রের অন্যতম শাহাদাত হোসেন শামীম- যে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয় রাফির কাছে। কাজেই প্রতিশোধ গ্রহণের এই মোক্ষম সুযোগটিকে কাজে লাগায় অধ্যক্ষের আশীর্বাদপুষ্ট বাহিনী। ৬ এপ্রিল মাদ্রাসায় মধ্যযুগীয় বর্বরতায় রাফির গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। ৮০ শতাংশের বেশি পুড়ে যায় রাফির শরীর। গণমাধ্যমের কল্যাণে তারপরের সব ঘটনাই অবহিত গোটা জাতি। মৃত্যুর সাথে প্রাণপন লড়ে ১১ এপ্রিল সবাইকে আরেকবার কাঁদিয়ে প্রিয় পৃথিবীকেই ছেড়ে যায় প্রতিবাদী মেয়েটি। সারা শরীরে ব্যান্ডেজ বাধা রাফির সংজ্ঞাহীন ছবিটি নারীর প্রতি নির্মমতার এক মোটিফে পরিণত হয়।

রাফির মর্মন্তুদ মৃত্যু প্রতিবাদী করেছে বাংলাদেশকে। শুধু স্যোশাল মিডিয়া নয়, রাজপথে নেমে এসেছে প্রতিবাদী মানুষ। রাফি হত্যার প্রতিবাদ ও অপরাধীদের বিচার দাবিতে রাজধানীসহ সারাদেশে হয়েছে মানববন্ধন। রাজধানীতে মানববন্ধন হয়েছে গণবভন থেকে বঙ্গভবন পর্যন্ত। বাংলা নববর্ষে রমনার বটমূলে ছায়নটের বর্ষবরণ উৎসবেও রাফির স্মরণে নীরবতা পালিত হয়েছে। নারীর প্রতি নিষ্ঠুরতা ও সামাজিক অনাচার দূর করার প্রত্যয় ধ্বনিত হয়েছে সবার কণ্ঠে।

রাফির মৃত্যুর বিষয়টি গোটা জাতিকে এতটা নাড়া দিল কেন? প্রথমত: আগুনে রাফির মারত্মক দগ্ধ হওয়া সবাইকে ব্যথাতুর করেছে । দ্বিতীয়ত: প্রথম থেকে তার প্রতিবাদী ভূমিকা, এমনকি অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পরও সে নির্ভীক কণ্ঠে বলেছে- তার প্রতি অন্যায়ের কথা সে প্রধানমন্ত্রী, সারাদেশ এমনকি সারা পৃথিবীর মানুষকে জানাবে। তৃতীয়ত: এ ঘটনায় মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজের অন্তহীন কুকীর্তির কথা ফাঁস হয়েছে। সবশেষে অনেক চেষ্টার পরও তার মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি দেশের মানুষ।

রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় শুরু থেকেই ভালো ভূমিকা নিয়েছে সরকার। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এ ঘটনায় যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের কথাও বলেছেন তারা। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাফির চিকিৎসার খোঁজখবর নিয়েছেন। অপরাধীদের কঠোর শাস্তি পেতে হবে বলেও দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। রাফির মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে স্থানান্তর করা হয়। ঘটনার হোতা শাহাদত ও নুরউদ্দিনসহ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে তারা। আশা করা যায় মামলাটি বহুল আলোচিত তনু কিংবা মিতু হত্যা মামলার মতো আড়ালে চলে যাবে না।

এর আগে আমরা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে শিক্ষার্থী সোহাগী জাহান তনু কিংবা চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মিতু হত্যার মর্মান্তিক ঘটনা দেখেছি। কিছুদিন গণমাধ্যমে হইচই হওয়ার পর এক সময় তনু বা মিতু হত্যাকাণ্ড আড়ালে চলে যায়। খুঁজলে এমন অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাবে।

মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই সমাজে নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ন বন্ধ হচ্ছে না। মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল, যানবাহন এমনকি নিজ পরিবারেও নারী নিরাপদ নয়। অপরাধীদের সঙ্গে অনেক সময় প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ থাকে বলেই পার পেয়ে যায় তারা। মানবাধিকার কমিশনের একটি তদন্ত দল রাফির ঘটনা তদন্ত করে জানিয়েছে, যদি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ বা সোনাগাজী থানার ওসি রাফির যৌনহয়রানির ঘটনায় অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত তবে তার মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা এড়ানো যেত। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন তারা। আর দেশবাসী রাফির মতো আর কোনো তরুণী কিংবা নারীর মর্মান্তিক মৃত্যু দেখতে চায় না।

ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040