একটি দৃশ্য। তিব্বতের শাননান শহরের খ্যেসং কমিউনিটিতে হলুদ রঙের পোষাক পরা একটি ছেলে খেলছে। ছেলেটির নাম লাঙ্কা। পাশে তাঁর ৭২ বছর বয়সী প্রপিতামহ সুওলাং দোর্জি। তিনি গ্রেড নাতনীকে দেখে রাখছেন। দোর্জি বলেন, গত ২৮ মার্চ ছিল লাঙ্কার দ্বিতীয় জন্মবার্ষিকী। আর ওই ২৮ মার্চই তিব্বতের লক্ষ লক্ষ ভূমিদাসের মুক্তি পাওয়ার দিবস।
তিনি বলেন, "আমার শৈশবের সঙ্গে লাঙ্কার শৈশবের তুলনা চলে না। তখন বাড়িতে সবচেয়ে ভাল খাবার ছিল সাম্পা (Tsampa) (তিব্বতের এক ধরনের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ খাদ্য)। কিন্তু আমাদের জন্য যথেষ্ট খাবার থাকতো না। তখন আমরা চা-ও খেতে পারতাম না।"
তিনি জানান, তিনি একজন ভূমিদাসের সন্তান। পরিবারের নয় জন সদস্য একটি ছোট মাটির ঘরে থাকতেন,ঘরের ভিতরে পশুসম্পত্তির দুর্গন্ধ ভরে গেছে।
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রকাশিত 'বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণা'-য় বলা হয়, কাউকে দাস বানানো যাবে না এবং দাস কেনাবেচা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। অথচ যখন এই ঘোষণা প্রকাশিত হয়, তখনও তিব্বতে দাসপ্রথা পুরোদমে চালু ছিল।
দোর্জি বলেন, 'প্রতিদিন আমাদের খাবারের অভাব হতো। আমরা অবিরাম কাজ করে যেতাম। আমাদের এমন ঋণও ছিল, যা কোনোদিন শোধ করা সম্ভব হবে মনে হতো না।"
১৯৫৯ সালের ২৮ মার্চ সিপিসি তিব্বতের বিভিন্ন জাতির জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে রাজনীতির মধ্যে ধর্মের সামন্তবাদী অবস্থান বিলুপ্ত করে। তখন ৯৫ শতাংশেরও বেশি তিব্বতি ভূমিদাস মুক্তি পায়।
খ্যেসং কমিউনিটি হলো তিব্বতের গণতান্ত্রিক সংস্কার-কার্যক্রম শুরু-হওয়া প্রথম গ্রাম। সেজন্য গ্রামটি 'তিব্বতের গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রথম গ্রাম' বলে পরিচিত।
সোলাং দোর্জি বলেন, "গণতান্ত্রিক সংস্কারের পর আমরা প্রথমবারের মতো নিজেদের ভূমি পেয়েছি,প্রথমবারের মতো পেট ভরার অনুভব করেছি। আমাদের বর্তমান সুখী জীবন সিপিসি দিয়েছে।"
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তিব্বত ছিল কালো মেঘ আর ঘন কুয়াশার অঞ্চল।
প্রায় এক হাজার বছরের সামন্ততান্ত্রিক ভূমিদাস-ব্যবস্থা একটি লোহার জিঞ্জিরের মতো তিব্বতের ওপর চেপে বসেছিল।
তখন ১৬ বছর বয়সী সোলাং দোর্জি রাতে পশুদের থাকার ঘরে ঘুমাতেন। তিনি প্রতিদিন ঘোড়ার মলমূত্রের দুর্গন্ধ নাকে টের পেতেন। কিন্তু এটি ছিল ক্রীতদাসদের সাধারণ জীবন। তাদের স্বাধীনতা, সম্মান ইত্যাদি আইন দ্বারা নিষিদ্ধ ছিল।
কেউ কেউ বলেন যে, ১৯৫৯ সালের আগে তিব্বতি মানুষের দুধ, চা, মাংস বা সবজির অভাব ছিল না। অথচ ১৯৪০ সালে তিব্বতের পূর্বাঞ্চলে পরিচালিত এক জরিপ থেকে উঠে আসা তথ্যানুসারে, তখন পর্যন্ত ৩৮ শতাংশ পরিবার কখনো দূধ দিয়ে তৈরি চা খায়নি; ৫১ শতাংশ পরিবার সুইয়ৌ (এ ধরণের মাখন) রান্নায় ব্যবহার করার ব্যয় বহনে অক্ষম ছিল; এবং ৭৫ শতাংশ পরিবারের সদস্যদের রীতিমতো ঘাষ খেতে হতো। আর তাই, নামহীন এক তিব্বতি ভবঘুরে অর্ধেক শতাব্দী আগে তুষার-পাহাড়ে গেয়েছিলেন:
'আমাদের জন্মস্থান আছে।
আমাদের বাড়ি এমন একটি জায়গায়, যেখানে অসংখ্য সুন্দর ফুল ফোটে।
আমি আমার বাড়িকে ভালবাসি।
কিন্তু আমার জন্মস্থানে সূর্য ওঠে না......'
১৯৫১ সালের মে মাসে 'কেন্দ্রীয় সরকার ও তিব্বতের স্থানীয় সরকারের মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে তিব্বতিদের মুক্তির উপায়সংক্রান্ত চুক্তি' সাক্ষরিত হয়।
১৯৫৬ সালের এপ্রিল মাসে তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রস্তুতি কমিটির সম্মেলন লাসায় আয়োজিত হয়। কমিটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিব্বতসংশ্লিষ্ট কর্মতত্পরতা একটি নতুন পর্যায়ে উঠে আসে। তিব্বতের সকল জাতির মানুষ একে স্বাগত জানায়; বাকি চীনেও এই কাজ প্রশংসিত হয়।
কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অপতত্পরতা বন্ধ হয়নি। সোলাং দোর্জি ও অন্যান্য তিব্বতি জনগণ জানেন, তখন তিব্বতের স্থানীয় সরকারকে সমাজের সুবিধাবাদী শ্রেণির বিদ্রোহ দমনে মাঠে নামতে হয়। ১৯৫৯ সালের ১০ মার্চ বিদ্রোহীরা লুওবুলিনকায় তথাকথিত 'জনপ্রতিনিধি সম্মেলন' আয়োজন করেছিল এবং 'স্বাধীন তিব্বতের ঘোষণা' প্রকাশ করেছিল। ২৮ মার্চ কেন্দ্রীয় সরকার তিব্বতের স্থানীয় সরকার ভেঙ্গে দেওয়ার ঘোষণা দেয় এবং তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের প্রস্তুতি কমিটি তিব্বতের স্থানীয় সরকারের স্থলাভিষিক্ত হয়। কমিটি তিব্বতের বিভিন্ন জাতির জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে গণতান্ত্রিক সংস্কার-কার্যক্রম চালাতে থাকে।
এর ফলে ছিংহাই-তিব্বত মালভূমিতে ভূমিদাসপ্রথার অপমানজনক ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে। লক্ষ লক্ষ ভূমিদাস এসময় মুক্তি পায়।
সোলাং দোর্জি পরে শুনেছেন যে, মুক্তি পাবার পর কোনো কোনো মানুষ তিব্বতের বাইরে গেছেন এবং কোনো কোনো মানুষ লাসা শহরে এসেছিলেন। চিলিয়েদুনচু নামের একজন ভূমিদাস মুক্তি পাবার পর শহরে একটি কাজ পান। তিনি তখন থেকে নিয়মিত মাসিক বেতন পেতে থাকেন। তিনি বলেন, "আমি প্রথম মাসের বেতন দিয়ে সন্তান ও স্ত্রীকে বিস্কিট ও ক্যান্ডি কিনে দিয়েছি। আগে আমরা এ জিনিস খাইনি।"
আসলে গণতান্ত্রিক সংস্কারের আগে গণমুক্তি ফৌজ চেকু হ্রদে এসেছিলো। তাঁরা চিকিত্সাদল, শিল্প ও সংস্কৃতির দল ও চলচ্চিত্র দল পাঠিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতি একাত্বতা ঘোষণা করেছিল। সিপিসি ও কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি ও ব্যবস্থা তারা ব্যাখ্যা করেছিলো। তখন থেকেই গণমুক্তি ফৌজ স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলে।
গণতান্ত্রিক সংস্কার-কার্যক্রম চলার পর গণমুক্তি ফৌজ মালিকদের উচ্ছেদ করে। তখন থেকেই ভূমিদাসেরা মুক্তি পায়।
'সিপিসি আমাদেরকে সুখ এনে দিয়েছে।' বর্তমানের শাননান শহরের লংজি জেলার চুনবা পাহাড়ে থাকা কুসাপেমু গণতান্ত্রিক সংস্কারের আগে বাইরে ভিক্ষা করতেন। ১৯৫৯ সালে তাঁর পরিবার নিজস্ব ভূমি পায়। প্রতিবছর সেই জমিতে ফসল ফলে। ১৯৬২ সালে তাঁর পরিবার সঞ্চয় করা শুরু করে।
"আমাদের কখনো ভাবিনি যে, এমন সুন্দর জীবন হবে আমাদের," কুসাংপেমু বলেন।
১৯৬২ সালে কেসং থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। সোলাং দোর্জি বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। তখন থেকে তিনি নিজের নাম লিখতে পারেন।
মানুষ মুক্তি পায় এবং উত্পাদিত পণ্যের সাথে তাদের সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনের কারণে মালভূমির অর্থনীতিতে নতুন চালিকাশক্তি যুক্ত হয়।
পরিসংখ্যান অনুসারে, ১৯৫৯ সালে তিব্বতের জিডিপি মাত্র ১৭.৪ কোটি ইউয়ান আরএমবি ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে জিডিপি ১৪০ বিলিয়ন ইউয়ান ছাড়িয়ে যায়। ১৯৭৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিব্বতে খাদ্যশস্যের উত্পাদন বাড়ে দ্বিগুণ। ২০১৮ সালে তিব্বতে খাদ্যশস্য উত্পাদিত হয় ১০ লাখ টনের বেশি।
বর্তমানে তিব্বতি কৃষক ও পশুপালকদের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ১০ হাজার ইউয়ানের বেশি।
৬০ বছর আগে তিব্বতে প্রথম গণ কৃষক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। সোলাং দোর্জি সেই ৩০২ জন মুক্তিপ্রাপ্ত ভূমিদাসের একজন যারা প্রথম গণতান্ত্রিক অধিকার অনুশীলন করেছেন এবং ভোট দিয়েছেন।
তিব্বতে নির্বাচন হল মৌলিক পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১৯৬৫ সালে তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে অঞ্চলের গণকংগ্রেসের স্থায়ী কমিটির পরিচালক ও স্থানীয় সরকারা-প্রধান তিব্বতি জাতির নাগরিকদের মধ্য থেকে নিযুক্ত হয়ে আসছেন। বিভিন্ন পর্যায়ের কংগ্রেসের স্থায়ী কমিটির প্রধান ও সরকার-প্রধান এবং অভিশংসক ও আদালতের প্রধান দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হলেন তিব্বতি জাতির মানুষ। ১৯৬৫ সালে অঞ্চলটিতে মাত্র ৭৬০০ জন সংখ্যালঘু জাতির ক্যাডার ছিলেন। কিন্তু এখন হতা ১৩ গুণ বেড়েছে।
বর্তমানে ৫৭ বছর বয়সী কেলসাং দোল্কার (kelsang Dolker) হলেন লাসা শহরের ছেংকুয়ান এলাকার নাজিন সড়ক অফিসের তামা কমিউনিটি'র সিপিসি কমিটি'র প্রথম সম্পাদক। তিনি টানা তিন বার জাতীয় গণকংগ্রেসের প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। তাঁর বাবা-মা ছিলেন ভূমিদাস। বাবা-মা তাঁকে জানিয়েছিলেন যে, শিক্ষাগ্রহণ ও নিজের জীবনের পথ বাছাই করা এমন কিছু, যা তাদের প্রজন্মের লোকরা চিন্তাও করতে পারতেন না।
জাতীয় গণকংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে কেলসাং দোল্কার একবার এনপিসি'র প্রতিনিধি সম্মেলনে লাসা'র পুরাতন নগর সুরক্ষার প্রস্তাব করেন। সম্মেলন শেষ হওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকার সময়মতো পুরাতন নগর সুরক্ষার পরিকল্পনা প্রণয়ন করে।
তিনি বলেন, সিপিসি'র কেন্দ্রীয় কমিটি ও কেন্দ্রীয় সরকার তিব্বতের প্রতিটি বিষয়ের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে থাকে।
১৯৮০ সাল থেকে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার পৃথক পৃথকভাবে ছয় বার তিব্বতসংশ্লিষ্ট কাজকর্ম নিয়ে ফোরাম করেছে। তিব্বতের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার বিভিন্ন ব্যবস্থা ও নীতি নির্ধারিত হয়েছে সেসব ফোরামে।
সিপিসি'র অষ্টাদশ জাতীয় প্রতিনিধি সম্মেলনের পর তিব্বতের অর্থনীতি ও সমাজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য অর্জিত হয়।
২০১৮ সালে তিব্বতে দরিদ্র লোকসংখ্যা ১.৮ লাখ কমেছে। দরিদ্র লোকসংখ্যা ৬ বছর আগে ছিল ৮.৬ লাখ। ৭৪টি জেলার মধ্যে ৫৫টি দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সরকার ২০১৯ সালে মৌলিকভাবে চরম দারিদ্র্য নির্মূল করার লক্ষ্য প্রণয়ন করেছে।
তিব্বতে জনগণের জীবনযাত্রার মান অব্যাহতভাবে উন্নত হচ্ছে। চীনে তিব্বতেই প্রথম ১৫ বছরের বিনামূল্যের শিক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়। শহর এবং গ্রামের অধিবাসীরা সম্পূর্ণ মৌলিক চিকিত্সাবীমার আওতায় এসেছে। বর্তমানে তিব্বতের মানুষের গড় আয়ু দাঁড়িয়েছে ৬৮ বছরের বেশি। গত শতাব্দীর ৫০'র দশকে যা ছিল ৩৫.৫ বছর।
সিছুয়ান-তিব্বত রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। ৬২টি জেলায় বিদ্যুত পৌঁছেছে। বিদ্যুতের সুবিধা ভোগ করছে ২.৭২ মিলিয়ন তিব্বতি। ২০১৮ সালে তিব্বতের জিডিপি ১৪০ বিলিয়ন ইউয়ানে ছাঁড়িয়ে গেছে। ২০১২ সালে ছিল ৭০.১ বিলিয়ন ইউয়ান।
তিব্বতে প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নত হচ্ছে। সিপিসি'র কেন্দ্রীয় কমিটি ও কেন্দ্রীয় সরকার বরাবরই ছিংহাই-তিব্বত মালভূমির প্রকৃতি সুরক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে থাকে। এ কাজে বিপুল অর্থও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এখন ছিংহাই-তিব্বত মালভূমি বিশ্বের সবচেয়ে পরিস্কার এলাকাগুলোর মধ্যে একটি।
২০১৩ সালে চীনের দু'টি অধিবেশনের সময় চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছিলেন, ২০২০ সালে সারা চীনে সার্বিকভাবে স্বচ্ছল সমাজ গঠন করার মহান লক্ষ্য বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা উচিত।
"তিব্বতের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা আশাবাদী," বললেন কেলসাং দোল্কারআ।