ঢাকায় বনানী-গুলশানে আগুন : জানমালের নিরাপত্তায় কার্যকর ব্যবস্থার দাবি
  2019-03-31 18:56:09  cri

পুরান ঢাকার চকবাজারে ২০ ফেব্রুয়ারির ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ঝরে গিয়েছিল ৮১টি তাজা প্রাণ। ওই অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে গুণশুনানি ছিল ২৮ মার্চ। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে অগ্নিঝুঁকিমুক্ত নিরাপদ পুরান ঢাকা নিয়ে যখন গণশুনানি চলছিল ঠিক তখনি আগুন লাগে রাজধানীর অভিজাত পাড়া বনানীর এফ আর টাওয়ারে। ২৩ তলা ভবনটিতে ভয়াবহ আগুনে ঝরে যায় আরো ২৬টি তরতাজা প্রাণ। রাজধানীবাসীসহ গোটা দেশের মানুষ দেখলো কতটা অনিরাপদ বনানীর তথাকথিত আধুনিক ভবনও। একদিন না যেতেই আগুন গুলশান ১ এর ডিএনসিসি কাঁচাবাজারে। এখানে কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও পুড়ে যায় কাঁচাবাজারের ৩০০ দোকানের সবকটি। মাত্র দু'বছর আগেও আগুনে পুড়েছিল মার্কেটটি।

অল্প ক'দিনের ব্যবধানে পুরান ঢাকা থেকে শুরু করে গুলশান-বনানীতে পরপর তিনটি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডে হতচকিত রাজধানীর বাসিন্দারা, হতভম্ব দেশবাসী। পুরান ঢাকার চকবাজার একটি ঘনবসতিপূর্ণ ঘিঞ্জি এলাকা। আবাসিক এলাকায় ছিল নানারকম রাসায়নিকসহ দাহ্যপদার্থের গুদাম। সে কারণে চকবাজারে চুড়িহাট্টার আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে অনেক প্রাণহানি হয়েছে। তর্কের খাতিরে এ কথা মেনে নিলেও বনানীর আগুনের এতগুলো মানুষের মৃত্যু মানা যাবে কোন যুক্তিতে?

অগ্নিকাণ্ডের পর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউকের ভাষ্যে জানা গেলো এফআর টাওরটি ২৩ তলা হলেও অনুমোদন ছিল ১৮ তলার। অর্থাৎ ৫টি তলা বানানো হয়েছে অনুমোদনহীনভাবে। ভবনটিতে অগ্নিনির্বাপনের জন্যও ছিল না প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবস্থা। নামকা ওয়াস্তে ফায়ার হাইড্রেন্ট ছিল কিন্তু তা ছিল অকার্যকর। ছিল না ব্যবহারযোগ্য কোনো জরুরি নির্গমণ পথ। আগুনে আটকে পড়া আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য মরিয়া চেষ্টা দেখে হতবিহ্বল হয়েছে দেশবাসী। কতটা নিরূপায় হলে মানুষ বাঁচার আশায় বহুতল ভবন থেকে লাফ দেয়। অনেকে ভবনের গায়ে ঝুলে থাকা তার ধরে নামার চেষ্টা করেছে। এমন ঝুঁকিপূর্ণ চেষ্টায় পড়ে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েক জন। বাদবাকি বেশির ভাগ মানুষ মারা গেছেন তীব্র ধোয়ায় দম বন্ধ হয়ে। যেন একটা হরর ফিল্মের দৃশ্য দেখেছে দেশের মানুষ। প্রিয়জনের এমন নির্মম মৃত্যুর ঘটনা প্রত্যক্ষ করা স্বজনেরা এই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারবেন তো!

আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিস তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে আগুন নেভাতে এবং আটকে পড়াদের উদ্ধারে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী। আটকে পড়া অনেককেই তারা উদ্ধার করেছেন অত্যাধুনিক মই দিয়ে। তাদের এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাবে। তবে উদ্ধার তৎপরতায় শুরুর দিকে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ না করা এবং সমন্বয়হীনতার অভিযোগ উঠেছে।

একটি দুটি করে শেষ পর্যন্ত আগুন ভয়াবহ রূপ নিলে ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট আগুন নেভানোয় যোগ দেয়। ফায়ার সার্ভিস হয়তো ভেবেছিল তারা কয়েকটি ইউনিট দিয়েই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হবে। কিন্তু কার্যত তা হয়নি। এখানে প্রশ্ন উঠেছে- যেখানে এতগুলো মানুষের জীবনহানির প্রশ্ন, এত ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা সেখানে পরিস্থিতি কতটা গুরুতর হয় তা দেখার পর সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত কি?

অনেকে বলছেন, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে যদি আশপাশের সবগুলো ইউনিটি চলে আসতো; সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীও যোগ দিতো তাহলে হয়তো আগুন এতটা ভয়াবহ হতো না। বেঁচে যেতে পারতো আরো কিছু মানুষ। সবচেয়ে হাতশার কথা আগুন নেভানোর জন্য পানি সঙ্কটেও পড়ে ফায়ার সার্ভিস। অর্থাৎ আপতকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেই ফায়ার সার্ভিসে।

বিশেষজ্ঞদের তরফ থেকে আরো একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, ফায়ার সার্ভিস কেন জাম্প প্যাড ব্যবহার করেনি দুর্ঘটনা স্থলে। আগুন থেকে বাঁচতে বহুতল ভবন থেকে জাম্প-প্যাডে লাফিয়ে পড়া একটা সাধারণ ব্যবস্থা বিশ্বের অনেক দেশে। কিন্তু জাম্পপ্যাড থাকা সত্ত্বেও ফায়ার সার্ভিস বনানিতে কেন জাম্পপ্যাড ব্যবহারের কথা ভাবলো না- এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। বনানীতে লাফ দিয়ে এবং তার বেয়ে নামতে গিয়ে যে সব মানুষ মারা গেছেন, জাম্পপ্যাড থাকলে তাদের কেউ কেউ বেঁচে যেতেও পারতেন।

বনানী ও গুলশান কাঁচাবাজারে আগুনের পর আবারো সরকার তৎপর। মেয়র, গণপূর্তমন্ত্রী এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট মহলের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন। দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণসহ রাজধানীর সব ভবনের অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়ার কথা বলছেন মেয়র-মন্ত্রী। গ্রেপ্তার করা হয়েছে বনানীর এফআর টাওয়ারের দুই মালিককে। কিন্তু তাৎক্ষণিক এই ব্যবস্থা নয়, শুধু প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি নয়, মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় কার্যকর উদ্যোগ দেখতে চায় দেশবাসী।

ঢাকা থেকে মাহমুদ হাশিম।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040