কোন ধরনের জীবনকে 'সবচেয়ে সুখী জীবন' বলা যায়? এ প্রশ্নের উত্তর একেক জন একেকভাবে দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। গত ২০ মার্চ ছিল 'আন্তর্জাতিক সুখ দিবস'। এদিন সাংবাদিক চীনের নানা জায়গায় গিয়ে বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলেন; জানতে চান 'সুখ' সম্পর্কে তাদের ভাবনার কথা।
এক
৩০ বছর বয়সি লুও খ্য ছিয়াও ইউননান প্রদেশের সুয়ান ওয়ে শহরের একজন নাগরিক। গত বছর তার জীবনে দুটি সুখের ঘটনা ঘটে। এক. তিনি দারিদ্র্যমুক্ত হন; এবং দুই. তিনি বিয়ে করেন।
১০ বছর আগে, লুও খ্য ছিয়াওয়ের বাবা রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যান। বাবার মৃত্যুতে তার পরিবার সমস্যায় পড়ে; জর্জরিত হয় ঋণভারে। গেল বছর, সরকারের সাহায্যে, লুও খ্য ছিয়াং ১০০ বর্গমিটার আয়তনের নতুন বাড়িতে স্থানান্তরিত হন এবং নতুন বাড়িতে গিয়ে বিয়ে করেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, সুয়ান ওয়ে শহর চলতি বছর সার্বিকভাবে দারিদ্র্যমুক্ত হবে। এখন, লুও খ্য ছিয়াও একজন এক্সপ্রেস সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করছেন এবং তার প্রতিমাসের আয় ৩ থেকে ৪ হাজার ইউয়ান। লু খ্য ছিয়াং এখন নিজের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট। তিনি বলেন, সুখ মানে কাজ করে পয়সাকড়ি উপার্জন করা এবং কাউকে ভালবাসা।
দুই
১৬ বছর বয়সী ছাং থিয়ান সিং ইউননান প্রদেশের ছু চিং শহরের হুই চ্য জেলার হাই স্কুলে পড়ছে। তার বাবা-মা বর্তমানে রাজধানী খুনমিংয়ে কাজ করেন। বাবার শারীরিক অবস্থা ভাল না। তাদের পরিবারটি দরিদ্র। গ্রেড ৭ থেকে ছাও থিয়ান সিং স্কুল থেকে বিভিন্ন ধরনের ভাতা গ্রহণ শুরু করেন। লেখাপড়ার জন্য তাকে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয় না। সে প্রতিসেমিস্টারে জাতীয় বৃত্তি এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীর ভাতাসহ মোট আড়াই'শ ইউয়ান পেয়ে থাকে।
হুই চ্য জেলা শিক্ষা বিভাগের প্রধান জানিয়েছেন, এখন সারা জেলার ২১১১৬ জন হাই স্কুলে পড়ছে এবং এর মধ্যে দরিদ্র শিক্ষার্থী ৬৫০১ জন। গেল বছর দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ১ কোটি ১৯ লাখ ৪৯ হাজার ৩০০ ইউয়ানের শিক্ষা-ফি মওকুফ করা হয়েছে এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীদেরকে মোট ৩ কোটি ইউয়ান বৃত্তি ও ভাতা দেওয়া হয়েছে।
ছাং থিয়ান সিংয়ের জন্য সুখ মানে ক্লাসরুমে বসে লেখাপড়া করতে পারা, শিক্ষা-ফি নিয়ে চিন্তামুক্ত থাকা। সে বলল, ভবিষ্যতে বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়। সে মনে করে, দারিদ্র্য ভয়াবহ ব্যাপার নয়। নিজের পরিশ্রমের মাধ্যমে পরিবার ও নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবে বলে সে বিশ্বাস করে।
তিন
থিয়ান হুয়া এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন এবং চলতি বছরেই তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করবেন। চাকরি খুঁজতে খুঁজতে তিনি বেইজিং এবং তার জন্মস্থান নিং সিয়া প্রদেশের উ চুং শহরের মধ্যে আসা-যাওয়া করেছেন অনেক বার। ২০১৯ সালের বসন্ত কালে তিনি চীনের পিপলস ব্যাংকের ইন ছুয়ান শাখা থেকে একটি ফোন পান। ব্যাংকে তার চাকরি হয়। তিনি পরিবারের সঙ্গে এ সুখের খবর শেয়ার করেন। তিনি বলেন, চাকরি পাওয়ার পর তার মানসিক চাপ অনেক কমেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ সময়টুকু তিনি বেশ উপভোগ করছেন। স্থানীয় সরকার বেশ কয়েক বার বড় ধরনের 'চাকরি মেলা' আয়োজন করে। থিয়ান হুয়া এ মেলায়ই নিজের পছন্দের কাজ খুঁজে পায়। কর্মস্থলও তার বাড়ির কাছাকাছি। মানে তিনি পরিবারের সদস্যদের কাছাকাছি থাকতে পারবেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার হল, এ কাজ ঠিক থিয়ান হুয়া যে বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন, সেই বিষয়সংশ্লিষ্ট। থিয়ান হুয়া আশা করেন, ভবিষ্যতে পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি নিজের ও পরিবারের সবার জন্য সুখী জীবন নিশ্চিত করতে পারবেন।
চার
কিছুদিন আগে, হু নান প্রদেশের ছাং ত্য শহরের সিয়ে চিয়া পু উপজেলার একজন কৃষক লি খ্য রং নিজের একটি ছোট ভিডিও তৈরি করেন এবং ইন্টারনেটে প্রকাশ করেন। ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি নিজের লেখা একটি কবিতা পড়ছেন। তিনি বলেন, ধনী হওয়া মানেই সুখী হওয়া নয়। নিজের সন্তান না-থাকায় তার বেশ নিঃসঙ্গ লাখে। ৭০ বছর বয়সী লি খ্য রং নিজের অভিজ্ঞতার কথা কবিতায় লিখেছেন। এখন গ্রামাঞ্চলে তার মতো একাকী বৃদ্ধের সংখ্যা অনেক বেশি। তার দুটি ছেলে। দু'জনই বাইরে কাজ করেন। তিনি থাকেন একা। আবার পুরোপুরি একাও নন তিনি। তিনি 'সুখী হাউস'-এ যান। 'সুখী হাউস' প্রবীণদের জন্য স্থানীয় সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি প্রকল্প। এখানে রয়েছে বিনোদন রুম, পড়ার ঘর, দাবা রুম, লাউঞ্জ, চিকিত্সা রুম ইত্যাদি। গ্রামের প্রবীণরা এখানে মিলে একসাথে সুন্দর সময় কাটান। প্রতিদিন এক ইউয়ান দিয়ে এখানে সবকিছু উপভোগ করা যায়, লাঞ্চ খাওয়া যায়। লি খ্য রংয়ের মতো প্রবীণদের কাছে 'সুখ' মানে 'সুখী হাউস'-এ সময় কাটানো।
পাঁচ
সকাল ১০টা। শানতুং প্রদেশের ছিং তাও শহরে উ ছেং পেং ও তার স্ত্রী ইউয়ান লেই তাদের বৈদ্যুতিক সাইকেল দিয়ে শুরু করেন দিনের কাজ। তারা ছিং তাওয়ে ১০ বছরের মতো কাজ করছেন। ২০১৬ সালে তারা খাবার এক্সপ্রেস সরবরাহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং দু'বছরে দু'জন একসাথে বৈদ্যুতিক সাইকেল চালিয়ে এক লক্ষাধিক কিলোমিটার অতিক্রম করেছেন, কাজের জন্য।
মাসে দু'জনের মোট আয় ২০ হাজার ইউয়ান এবং দু'বছরের মধ্যে তারা জন্মস্থানে একটি বাড়ি কিনতে সক্ষম হন।
তারা বলেছেন, এখন যারা খাবার অর্ডার করেন, তারা আগের চেয়ে আরও বেশি সম্মান করেন তাদের। তাদের কাছে সুখ হচ্ছে তাদের কাজের স্বীকৃতি। তাদের বড় ছেলে ৯ বছর বয়সী এবং চলতি বছর তারা দ্বিতীয় সন্তান আশা করছেন। ইউয়ান লেই মনে করেন, নিজের পরিশ্রমের মাধ্যমে ভাল জীবনযাপন করা সুখের ব্যাপার। তিনি আশা করেন, দ্বিতীয় সন্তান মেয়ে হবে। চারজন একসাথে সুখী জীবন যাপন করবেন এবং সুস্থ থাকবেন, এটাই তাদের আশা। (শিশির/আলিম)